দেশে চাল উৎপাদন বাড়ছে। যদিও বাজারের প্রকৃত চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ভরা মৌসুমেও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে চালের বাজার। এবারো চাল উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় স্থান লাভ করেছে বাংলাদেশ। এ নিয়ে টানা চার বছর বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরেও চাল উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
অর্থনীতির ভোগপ্রবণতার তত্ত্ব অনুযায়ী, মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান সঠিক হলে দেশে চালের বাজার স্থিতিশীল থাকার কথা। যদিও বাজারের প্রকৃত চিত্র এর সম্পূর্ণ বিপরীত। ভরা মৌসুমেও অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে চালের বাজার। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির (এফপিএমসি) সভায় বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে উৎপাদনের তথ্যে গরমিল থাকার বিষয়টি উঠে আসে। ওই সময় উঠে আসে গত অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন নিয়ে বিবিএস ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যে গরমিলের পরিমাণ ৪০ লাখ ২০ হাজার টন। এদিকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ রাখতে সারাদেশে ৮টি টিম মাঠে অভিযান পরিচালনা করছে।
গত ৬ জুন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে, বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করা হবে। শুল্কমুক্তভাবে যেন আনা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে। এতেকরে কৃষক, বাজার ও সংশ্লিষ্ট অন্যরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে। অভিযানের মাধ্যমে লাইসেন্সের আওতায় আনা হচ্ছে মজুতদারদের। কাজেই চাইলেই যাচ্ছেতাই করতে পারবে না কেউ।
গত বৃহস্পতিবার প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা সংসদে বলেছেন, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে চাল ও গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৩০ লাখ ৯৫ হাজার টন চাল-গম সংগ্রহ করেছিল। আগামী অর্থবছরের জন্য এই দুই খাদ্যপণ্য সংগ্রহের পরিমাণ ৪৭ হাজার টন বাড়িয়ে ৩১ লাখ ৪২ হাজার টন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে চলতি বছর ৩ কোটি ৮৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। গত শুক্রবার এফএও প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ফুড আউটলুক-জুন ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু আয় বাড়ছে। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশে চালের মাথাপিছু ভোগও কমছে বলে সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপে (২০১৬) উঠে এসেছে। চালের বাজারের এ অস্থিতিশীলতায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত পরিসংখ্যানগুলো।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে কৃষি মন্ত্রণালয় চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ৮১ হাজার টন। আবার ইউএসডিএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর দেশে চাল উৎপাদন হতে পারে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন। গরমিল রয়েছে ২০২০-২১ অর্থবছরের তথ্যেও। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৯৮ লাখ ৩৭ হাজার টন। বিবিএসের তথ্যে এর পরিমাণ ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৮ হাজার টন। আবার ইউএসডিএর পরিসংখ্যানে এর পরিমাণ ৩ কোটি ৪৬ লাখ টন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. এম আসাদুজ্জামান মনে করছেন, মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদনের যে তথ্য আসে, প্রকৃত উৎপাদন তার চেয়ে অনেক কম। চাহিদা স্থির থাকে। আবার উৎপাদনের তথ্যে গরমিল থাকায় সরবরাহও ঠিক থাকে না। ফলে বাজারে দেখা দেয় অস্থিতিশীলতা। বিবিএসের তথ্যগুলো অনেকটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংগ্রহ করা। আবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যে হিসাব দেন, তা সঠিকভাবে পরিমাপ করে দেন না।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেছেন, বিবিএস পদ্ধতিগতভাবে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই কৃষির পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সংস্থাটির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যকেই নির্ভরযোগ্য বলে ধরে নিতে হবে।
অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী এসব পরিসংখ্যান সঠিক হলে বাজারে অস্থিরতা দেখা দিত না। মন্ত্রণালয়ের উৎপাদন তথ্যে অবশ্যই অতিরঞ্জন বা গরমিল রয়েছে। চালসহ খাদ্যশস্য উৎপাদন নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও মার্কিন কৃষি বিভাগসহ (ইউএসডিএ) দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর তথ্যে এখন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি এক পর্যায়ে কৃষি ও খাদ্যোৎপাদন খাতে বড় ধরনের ব্যবস্থাপনাগত সঙ্কটের কারণ হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত কয়েক বছরে দেশে চালের বাজার বারবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা গেছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের পর থেকে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, প্রতি বছরই দেশের চাল উৎপাদন নিয়ে তথ্যের এ গরমিল আমরা দেখে আসছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য যদি সঠিক হতো তবে চাল আমদানির প্রয়োজন হতো না। তারা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে এসব তথ্য দেয় না। এক্ষেত্রে বরং ইউএসডিএ স্যাটেলাইট ব্যবহার করে যে তথ্য দেয়, সেটি বেশি গ্রহণযোগ্য। সঠিক তথ্য না থাকায় তা দেশের কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি করছে। আবার কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে, দেশে চাল উৎপাদন বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরেও চাল উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে মন্ত্রণালয়ের।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারে গতকাল সরু চালের সর্বনিম্ন মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৬৪ টাকা। এক মাস আগেও তা বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। এক বছর আগে ছিল ৫৮ টাকা। সে হিসেবে গত এক মাসে বাজারে সরু চালের দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। বাজারে এখন মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৮ টাকায়। এক মাস আগে তা বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকায়। এক বছর আগে ছিল ৪৫ টাকা। সে হিসেবে গত এক মাসে পণ্যটির দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এক বছরে বেড়েছে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
গত ২০১৭ সালের আগাম বন্যায় হাওরের বোরো ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদনে বড় ধস নামে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই অর্থবছর ও ২০১৭-১৮ সালে খাদ্যশস্য আমদানি ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যায়। এর পরের অর্থবছরগুলোয় প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হলেও আমদানিনির্ভরতাও ছিল অনেক। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্যের বাজারে আমদানিনির্ভরতার হার ছিল ১৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ১০ শতাংশে। গত অর্থবছরে এর হার ছিল ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এভাবে চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে আমদানিনির্ভরতার হার ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এরই মধ্যে ইউএসডিএ’র এক প্রক্ষেপণে বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্য আমদানির প্রয়োজন পড়তে পারে প্রায় এক কোটি টন।
আপনার মতামত লিখুন :