‘ইসি-বাহার’ বিতর্কের মধ্যেই আজ বুধবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এই নির্বাচন নতুন কমিশনের (ইসি) জন্য অনেকটা প্রথম পরীক্ষার মতো। সরকারদলীয় সংসদ সদস্যকে নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাতে ব্যর্থ ইসি ভোটের দিন কী করে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছেন পর্যবেক্ষকেরা।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই ভোট সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের (বাহার) জন্যও চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ, আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আরফানুল হক (রিফাত) বাহাউদ্দিনের প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। আরফানুলের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক (সাক্কু), যিনি এই ভোটের আগপর্যন্ত বাহাউদ্দিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে আসছিলেন বলে এলাকায় প্রচার আছে। তাই মনিরুলের এবারের প্রার্থী হওয়াকে বাহাউদ্দিনের একচ্ছত্র প্রভাব-প্রতিপত্তিকে চ্যালেঞ্জ করা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের এটি তৃতীয় নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী পাঁচজন। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন গত দুবারের মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক (টেবিল ঘড়ি) ও আওয়ামী লীগের আরফানুল হক (নৌকা)। অন্য তিনজন হলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রাশেদুল ইসলাম (হাতপাখা), স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন (ঘোড়া) ও কামরুল আহসান (হরিণ)। এর মধ্যে মনিরুল হক বিএনপির ও নিজামউদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা ছিলেন। সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় দুজনকেই বহিষ্কার করে বিএনপি।
স্থানীয় রাজনৈতিক মহল বলছে, নৌকার বিপরীতে ধানের শীষ প্রতীক না থাকায় মাঠে নির্বাচনী উত্তাপ ছিল কম। কিন্তু শেষ দিকে এসে সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বিতর্কে উত্তাপ ছড়ান। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এলাকায় দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সভা-বৈঠক করার অভিযোগে বাহাউদ্দিনকে একবার সতর্ক করে ইসি। পরে এলাকা ছেড়ে যেতে চিঠি দেয়। কিন্তু তিনি এলাকা ছাড়েননি। বাহাউদ্দিন শহরেই রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়, নিজের প্রার্থী আরফানুল হকের জন্য কতটা শক্ত অবস্থান নিয়ে এলাকায় থাকছেন সংসদ সদস্য। আর সংসদ সদস্যের এ অবস্থানের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে ইসি তার সামর্থ্যের বিষয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক গতকালও সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বর থেকে কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
গতকাল সন্ধ্যার পর গুঞ্জন ছড়ানো হয় যে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্যে কেন্দ্রের অদূরে একযোগে বাঁশি বাজানো এবং বিএনপি সমর্থকদের বাড়ির সামনে পাহারা দেওয়া হতে পারে।
অবশ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যাপক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে প্রশাসন। সিটি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৩ হাজার ৬০৮ জন সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। এ ছাড়া ৭৫টি তল্লাশিচৌকি, ১০৫টি ভ্রাম্যমাণ দল, ১২ প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের ৩০টি দল, অর্ধশতাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন।
গতকাল শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ। তিনি নির্বাচনী দায়িত্ব পালনে অবহেলা করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সতর্ক করেন পুলিশ সদস্যদের।
নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্নের কথা জানিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তাঁর কার্যালয় থেকে সেগুলো মনিটরিং করা হবে।
আজ ভোট হলেও কুমিল্লায় সবকিছু খোলা থাকছে। গতকাল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা ভোটকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার বা নির্বাচনী কাজের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হলো। বাকি সব প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয় প্রজ্ঞাপনে। সরকারি এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন বিরোধী প্রার্থীরা। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কমাতেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।
তবে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, নির্বাচন কমিশনের পরামর্শেই এই প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এতে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। বহিরাগতদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তবু নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে ভোটারদের মধ্যে। এ বিষয়ে কুমিল্লা সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি আলী আকবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, শেষ পর্যন্ত শান্ত না–ও থাকতে পারে। এখানে আধিপত্য রয়েছে, শক্ত প্রতিপক্ষ রয়েছে।’
কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে বিএনপি না থেকেও আছে। মনিরুল হক ও নিজাম উদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও প্রচারে ভোটারদের খালেদা জিয়ার সালাম দিয়েছেন দুই প্রার্থীই। কার্যত বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মী ও সমর্থকেরা এই দুজনের ভোটের ভিত্তি। এর মধ্যে মনিরুল হক দাবি করেন, সাধারণ ভোটারের পাশাপাশি দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা তাঁর সঙ্গে আছেন।
যদিও প্রথম ভোটে আসা নিজাম উদ্দিনও নিজের ভোট বাড়াতে সচেষ্ট। তিনি তরুণ নেতা এবং কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য আমিন উর রশীদের (ইয়াছিন) শ্যালক। শহরে আমিন উর রশীদের শিল্পকারখানা আছে এবং সেখানে স্থানীয় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। দলীয় একটা অংশের পাশাপাশি ভগ্নিপতির সুবাদেও নিজামের কিছু নিশ্চিত ভোট রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
নিজাম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসন আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা না করলে ভোট সুষ্ঠু হবে। তাঁর দাবি, ‘সাক্কু-রিফাত দুজনই বাহারের শিষ্য। কুমিল্লার মানুষ এই চক্রের পরিবর্তন চায়।’
দলীয় রাজনীতিতে আমিন উর রশীদের সঙ্গে মনিরুল হকের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। এ কারণে তাঁকে ঠেকাতে নিজামকে মাঠে নামানো হয়েছে বলে দাবি করেন মনিরুল হক। ভোটের মাঠে দুজনের এই বিভক্তির সুবিধা পেতে পারেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক।
কুমিল্লা আওয়ামী লীগে একসময়কার আফজল খান ও বাহাউদ্দিন বিরোধ আগের পর্যায়ে না থাকলেও সেটা শেষ হয়ে যায়নি। আফজল খানের মৃত্যুর পর তাঁর মেয়েছেলেরা রাজনীতিতে সক্রিয়। এবার সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা, ছেলে মাসুদ পারভেজ খানসহ মোট ১৪ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থী ছিলেন। বাহাউদ্দিনের অনুগত আরফানুল হক মনোনয়ন পাওয়ায় ১৩ জন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। যদিও শেষ দিকে দু–একজন প্রচারে নেমেছেন, এমনটা দেখানোর চেষ্টা করেছেন।
এর বাইরেও উপদল আছে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগে। এর মধ্যে মহানগরের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নূর উর রহমান, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আনিসুর রহমান এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ সম্পাদক কবিরুল ইসলাম সিকদারের পৃথক অনুগত দল রয়েছে। তাঁরা দলে বাহাউদ্দিনবিরোধী বলে পরিচিত। তবে এ বিরোধ যতটা সরবে, তার চেয়ে বেশি নীরবে।
অবশ্য বাহাউদ্দিনের নেতৃত্বে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী বলে দাবি করেছেন মেয়র পদপ্রার্থী আরফানুল হক। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, বাহাউদ্দিন হলেন সভাপতি।
অবশ্য ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ ভোটারের এ নির্বাচনে ফল প্রকাশের পর স্থানীয় রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশের মীমাংসা হবে। পাঁচজন মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি ২৭টি ওয়ার্ডে ১৪২ জন কাউন্সিলর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১০৬ জন লড়ছেন নির্বাচনে। সবার দৃষ্টি মেয়র পদে।
আপনার মতামত লিখুন :