কেশবপুরে তালগাছ লাগিয়ে, রাস্তা বানিয়ে অনন্য নজির


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ১৩, ২০২২, ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ /
কেশবপুরে তালগাছ লাগিয়ে, রাস্তা বানিয়ে অনন্য নজির

যশোরঃ পরিবেশের বন্ধু ও পরোপকারী মিজানুর রহমান গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্য করে চলেছেন অসাধারণ কিছু কাজ। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে এবং পরিবেশ রক্ষায় প্রায় পাঁচ হাজার তালবীজ রোপণ করেছেন তিনি। ১৪ বছরের ব্যবধানে সেগুলো আজ বড় গাছ। বর্ষায় ফাঁকা মাঠে বজ্রপাত থেকে রক্ষায় কৃষকের সহায় এই গাছগুলো।

স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা তৈরিতেও অনন্য তিনি। কৃষকের কষ্টের কথা ভেবে বিলের মধ্য থেকে ফসল আনতে তৈরি করেছেন দেড় কিলেমিটার রাস্তা। উদ্যোগ নিয়ে ফসলের মাঠে তৃষ্ণার্ত কৃষকের জন্য বসিয়েছেন নলকূপ। এতসব কাজ তিনি নীরবেই করে চলেছেন। এভাবে এলাকার মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছেন ‘কৃষকবন্ধু’।

৪৩ বছর বয়সী মিজানুর রহমানের বাড়ি যশোরের কেশবপুর উপজেলার মেহেরপুর গ্রামে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বাবার কাছ থেকে পাওয়া দুই বিঘা জমিতে কৃষিকাজ শুরু করেন, যা দিয়ে সংসার চলে তাঁর। পাশাপশি জমি জরিপের কাজ করেন। স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে তাঁর ছোট সংসার।

মিজানুরকে একজন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ মনে করেন সাগরদাঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘মিজানুর এতগুলো তালগাছ লাগিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমরা তাঁকে সব সময় উৎসাহ দিই।’

প্রথম দিকে নিজের জমিতে একটি তালবীজ রোপণ করেছিলেন মিজানুর। সেটি বড় হতে থাকলে তাঁর মনে একটি ভালো লাগার অনুভূতি কাজ করে। এরপর ২০০৮ সালে স্বল্প পরিসরে নিজের জমির পাশ দিয়ে তালবীজ রোপণ করেন তিনি। সেগুলো গাছ হয়ে উঠতে থাকলে তাঁর উৎসাহ বেড়ে যায়। একপর্যায়ে তিনি বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের মেহেরপুর থেকে বিষ্ণুপুর ছয় কিলোমিটার অংশে তালবীজ রোপণ করেন।

এক বছরে দুই হাজার বীজ রোপণের পর কপোতাক্ষ নদের সাতক্ষীরার কলারোয় উপজেলা অংশের নদীর পাড়েও তিনি বীজ লাগান। এরপর মিজানুর মেহেরপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সামনের রাস্তার দেড় কিলোমিটার অংশ বেছে নেন বীজ রোপণের জন্য। এভাবে ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তাঁর রোপণ করা তালবীজ এরই মধ্যে বড় গাছে পরিণত হয়েছে।

প্রথম দিকে ‘আঁটিপ্রতি এক টাকা করে দেবেন’ ঘোষণা দিলে শিশুরা তাঁকে তালবীজ দিত। একপর্যায়ে অন্য গ্রাম থেকে বীজ কিনে এনে তিনি রোপণ করতেন। নিজের সাইকেলে বস্তায় করে তালের আঁটি আনতেন। সঙ্গে থাকত একটি ছোট কোদাল। গর্ত খুঁড়ে তিনি পুঁতে দিতেন বীজ।

মিজানুর রহমানের এসব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম এম আরাফাত হোসেন। তিনি বলেন, মিজানুর চাইলে বন বিভাগের মাধ্যমে তাঁকে তালের চারা দিয়ে সহায়তা করা হবে।

৪ ও ৬ জুন মেহেরপুর বাঁধ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাঁধজুড়ে ১৪ বছরের পুরোনো তালগাছগুলো বড় হয়ে গেছে। বাঁধের মেহেরপুর বাদামতলার ঘাট থেকে বিষ্ণুপুরের ধানদিয়া ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার অংশে রয়েছে ৪০৪টি তালগাছ। এভাবে সাড়ে ছয় কিলেমিটার এলাকায় মিজানুরের লাগানো আড়াই হাজারের বেশি তালগাছের দেখা মেলে। কয়েকটি গাছে তালও ধরেছে।

বাঁধের পাশের বাসিন্দা মেহেরপুর গ্রামের জসিম উদ্দীন বলেন, ‘এলাকার মানুষ মিজানুর রহমানকে বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে জানেন। তাঁর অবদানকে ভালো উদ্যোগ হিসেবে দেখি।’

একইভাবে কেশবপুর উপজেলার মেহেরপুর থেকে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদের পাড়ে সাত কিলেমিটার এলাকাজুড়ে তালবীজ রোপণ করেছেন মিজানুর। সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার জয়নগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিশাখা তপন সাহা বলেন, সবার অলক্ষ্যে বিরাট কাজ করে চলেছেন মিজানুর।

পদ্মবিল থেকে ফসল ঘরে তুলে আনতে কৃষকদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হতো। মিজানুর উদ্যোগ নিয়ে তিন বছর ধরে স্বেচ্ছাশ্রমে দেড় কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করেছেন। জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, তিনিসহ এলাকার কৃষকেরা বাঁশের লাঠি ব্যবহার করে মাথায় করে ফসল বাড়িতে আনতেন। তাঁদের অনেক কষ্ট হতো।

এ কারণে বিলের মধ্য দিয়ে রাস্তা তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি। পরে এলাকার মানুষের সহযোগিতায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা তৈরি হয়েছে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে ফসল আনা–নেওয়া করা হয় এখন।

বৃহত্তর পদ্মবিলে খেতে কাজ করা কৃষকেরা তৃষ্ণায় কষ্ট পান, এটা বোঝার পর উদ্যোগী হয়ে সেখানে একটি নলকূপ স্থাপন করেন মিজানুর। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় আরেকটি নলকূপ স্থাপন করা হয়। মিজানুর রহমান জানান, মানুষ যাতে তাল খেতে পারেন, সে জন্য প্রথমে বীজ রোপণ করেছিলেন। পরে বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে উদ্যোগটা আরও বড় করেন।

এভাবে তিনি পাঁচ হাজারের মতো গাছ লাগিয়েছেন। রাস্তা তৈরি ও নলকূপ বসানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর বলেন, এসব কাজের প্রচার চান না। ভালো কাজ করতে ভালো লাগে, তাই করেন।