ভারতীয় এক নারী তার গোঁফের কারণে একই সঙ্গে লোকের প্রশংসা এবং নিন্দা দুটিরই মুখোমুখি হয়েছেন। তবে তিনি বলছেন, তার গোঁফ নিয়ে মানুষের এই আগ্রহে তিনি মোটেই বিচলিত নন। “আমি আমার গোঁফ পছন্দ করি”, হোয়াটসঅ্যাপের স্ট্যাটাসে নিজের ছবির নিচে লিখেছেন ৩৫ বছর বয়সী শায়জা।
ফেসবুকে তার ছবি দেখে, বা যখন কারও সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়, তখন লোকে জানতে চায়, কেন তিনি গোঁফ রেখেছেন। “আমি একটা কথাই বলি, এটা আমার ভালো লাগে, বেশ ভালো লাগে”, বলছেন তিনি।
শায়জা, যিনি কেবল এই নামেই পরিচিত, থাকেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার কান্নুর জেলায়। আরও বহু নারীর মতোই তারও ঠোঁটের ওপর বেশ কিছু চুল আছে।
তিনি নিজের ভ্রু নিয়মিত চেঁছে চিকন রাখেন, কিন্তু উপরের ঠোঁটের ওপর গজানো চুল তুলে ফেলার প্রয়োজন কখনো অনুভব করেননি। বছর পাঁচেক আগে তার গোঁফ বেশ দৃশ্যমান হয়ে ওঠে, এবং শায়জা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি গোঁফ রেখে দেবেন।
“এখন আমি তো এটা ছাড়া নিজেকে ভাবতেই পারি না। যখন কোভিড মহামারি শুরু হলো, তখন আমি সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকা পছন্দ করতাম না, কারণ এটি আমার মুখ ঢেকে রাখতো”, বলছেন তিনি।
তবে যারা তাকে দেখেছেন, তাদের অনেকেই গোঁফ কামিয়ে ফেলার পরামর্শ দেন, কিন্তু শায়জা রাজী হননি। “আমার এটা আছে বা এটা নেই বলে আমি সুন্দরী নই, এটা আমার কখনো মনে হয়নি।”
মেয়েদের প্রায় সময়েই বলা হয়, তাদের মুখে চুল থাকা বাঞ্ছনীয় নয় এবং তাদের নিয়মিত এগুলো পয়সা খরচ করে কামিয়ে ফেলা উচিৎ, অথবা একটা নির্দিষ্ট আকারের মধ্যে রাখা উচিৎ। মেয়েদের চুল তোলার জন্য বাজারে বহু রকমের জিনিস আছে- ক্রিম, ওয়াক্স স্ট্রিপ, রেজর এবং এপিলেটর। মেয়েদের টার্গেট করে বাজারজাত করা এসব পণ্য এখন শত কোটি ডলারের ব্যবসা।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক নারী এই নিয়ম আর মানছেন না, তারা তাদের মুখের চুল নিয়ে বিড়ম্বিত নন, এমনকি এ নিয়ে তারা গর্ব অনুভব করেন।
হরনান কাউর একজন বডি পজিটিভিটি ক্যাম্পেইনার – অর্থাৎ যে যেরকম দেখতে, সেটাই যে সুন্দর, সেই প্রচারণা চালান তিনি। ২০১৬ সালে কনিষ্ঠতম নারী হিসেবে পুরো মুখে দাড়ি রেখে তিনি বিশ্ব রেকর্ড করেন, তার নাম ওঠে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি অনেকবার বলেছেন, নিজের মুখের চুলকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়ার কারণেই তিনি মানুষের নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মুখেও নিজেকে ভালোবাসতে পেরেছেন।
তবে শায়জার কাছে গোঁফ রাখার ব্যাপারটা কেবল একটি বার্তা দেয়ার চেষ্টা নয়, তিনি আসলেই যা, এটা তারই অংশ।
তিনি বলেন, “আমার যা পছন্দ হয়, আমি সেটাই করি। আমার যদি দুটি জীবন থাকতো, তাহলে না হয় আমি আরেকটি জীবন অন্যদের কথামত যাপন করতাম।”
তার এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে কিছু স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগার পর। এক দশকে তার শরীরে প্রায় ছয়বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। এর মধ্যে একটি ছিল তার স্তন থেকে একটি টিউমার, আরেকটি তার জরায়ু থেকে একটি সিস্ট অপসারণের জন্য। পাঁচ বছর আগে তার জরায়ুও কেটে ফেলা হয়।
“প্রতিবার অপারেশন শেষ বাড়ি ফেরার পর আমি আশা করতাম আমাকে আর অপারেশন থিয়েটারে ফিরে যেতে হবে না।”
এরকম অনেক স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে লড়াইয়ের ফলে শায়জার মনে এই বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, তাকে এমনভাবে বাঁচতে হবে, যাতে নিজেকে সুখী রাখা যায়।
শায়জা জানান, যখন তিনি বেড়ে উঠছেন, তখন বেশ লাজুক ছিলেন। তাদের গ্রামে সন্ধ্যা ছয়টার পর নারীদের ঘরের বাইরে কমই দেখা যেত। কেরালা যদিও ভারতের সবচেয়ে অগ্রসর রাজ্যগুলোর একটি, অনেক এলাকাতেই এখনো পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বেশ প্রবল। মেয়েদের একা চলাফেরা করতে বা একা থাকতে নিরুৎসাহিত করা হয়।
বিয়ের পর তিনি চলে গেলেন পাশের রাজ্য তামিলনাডুতে। সেখানে যেন স্বাধীনভাবে জীবন-যাপনের সুযোগ পেলেন তিনি।
“আমার স্বামী কাজে যেত, ফিরতো অনেক দেরিতে। কাজেই আমি ঘরের বাইরে বসে থাকতাম সন্ধ্যার পর, বা একা দোকানে যেতাম, যদি কিছু কেনার দরকার হতো। কেউ কিছু বলতো না। যখন আমি একা একা সব কিছু করার শিখলাম, তখন আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল।”
শায়জা বলছেন, তিনি এখন তার কিশোরী মেয়েকেও একইভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে চান। শায়জার পরিবার এবং বন্ধুরা তার গোঁফ মেনে নিয়েছে। নিজের মেয়েও তাকে প্রায়ই বলে, গোঁফে তাকে ভালোই মানিয়েছে।
তবে রাস্তায় যখন বেরোন, তখন লোকজনের মুখে অনেক ধরণের মন্তব্য শুনতে হয়। তিনি বলেন, “লোকে আমাকে নিয়ে মজা করে, অনেকে বলে, গোঁফ রাখবে ছেলেরা, একটা মেয়ের মুখে কেন গোঁফ থাকবে।”
স্থানীয় গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার খবর বেরিয়েছে। সম্প্রতি তাকে নিয়ে লেখা এক প্রতিবেদন ফেসবুকে শেয়ার হওয়ার পর সেখানে অনেকে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছে।
একজন প্রশ্ন করেছে, সে তো নিজের ভ্রু চেঁছে ঠিকই সুন্দর রাখছে, তাহলে ব্লেড দিয়ে গোঁফ কামাতে অসুবিধা কোথায়? “কিন্তু এটা তো আমার পছন্দের ব্যাপার, আমি কী রাখবো আর কী রাখবো না, সেটা তো আমার ব্যাপার”, পাল্টা মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়ে বলছেন শায়জা।
শায়জার বন্ধুরা ফেসবুকে এসব মন্তব্যের পাল্টা জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে শায়জা বলছেন, এগুলোতে তার কিছু আসে-যায় না। “সত্যি কথা বলতে কি, মাঝে-মধ্যে আমি এগুলো দেখি, আর আমার হাসি পায়।” বিবিসি
আপনার মতামত লিখুন :