চৌগাছায় তিনদিনব্যাপী খেজুর গুড় মেলার উদ্বোধন


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ১৬, ২০২৫, ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ /
চৌগাছায় তিনদিনব্যাপী খেজুর গুড় মেলার উদ্বোধন

মোঃ নিজাম উদ্দীন, চৌগাছা (যশোন) : যশোরের চৌগাছায় তিন দিনব্যাপী খেজুর গুড় মেলার উদ্বোধন করা হয়েছে। বুধবার (১৫ জানুয়ারি) সকাল ১১ টায় যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম এই মেলার উদ্বোধন করেন। খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য ধরে রাখতে তৃতীয় বারের মতো এ মেলার আয়োজন করা হয়েছে। চলবে ১৭ জানুয়ারী শুক্রবার পর্যন্ত।

স্বাদে সেরা, গন্ধে ভরা খেজুর গুড়ে মনোহরা “যশোরের যশ খেঁজুরের রস” এ ঐতিহ্যকে ধারন করে চৌগাছা উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে স্থানীয় গাছিদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী এই গুড়ের মেলা চলবে। ২০২৩ সালে উপজেলায় প্রথমবার গুড় মেলার আয়োজন করা হয়েছিল।

জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বলেন, যশোরের ব্রান্ডপণ্য খেজুর রসের গুড় জাতীয় অর্থনীতির একটি সম্ভাবনাময় খাত হয়ে উঠতে পারে। খেজুর গাছ প্রস্তুত থেকে শুরু করে রস সংগ্রহ ও গুড় পাটালি তৈরির কাজে যদি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা যায়, তাহলে কাজটি আরো সহজ হবে। গাছ প্রস্তুত থেকে গুড় তৈরি পর্যন্ত যে ধাপ গুলো রয়েছে তা যশোরে ঐতিহ্যবাহি প্রসিদ্ধ একটি শিল্প।

যশোরের জিআই পণ্যের এই শিল্প টিকিয়ে রাখতে খেজুর গাছ রক্ষার বিকল্প নেই। গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উপজেলার সকল রাস্তা, নদীর ধার ও খাস জমিতে খেজুর গাছ রোপনের প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রতিবছর খেজুর গাছের চারা রোপন করা হচ্ছে। এই চারাগুলো রক্ষানাবেক্ষণের দায়িত্ব এই উপজেলার মানুষের।

তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারলে এই পেশা কষ্টসাধ্য থাকবেনা। গাছ প্রস্তুত ও রস সংগ্রহের কাজ সহজ হলে চাষীরা এই পেশা থেকে সরে যাবেনা বরং অন্যরা আগ্রহী হবে। খাঁটি গুড় তৈরি করতে পারলে দেশ বিদেশে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে যারা এই পেশায় জড়িত রয়েছে উপজেলা প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যানদেরকে তাদের পাশে থাকার আহ্বান করেন তিনি।উপজেলা চত্বরে বৈশাখী মঞ্চে অনুষ্ঠিত গুড় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপত্বি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুষ্মিতা সাহা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসাব্বির হুসাইনের পরিচালনায় বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন, উপজেলা কমিশনার (ভূমি) তাসনিম জাহান, যশোরের সহকারি কমিশনার আব্দুল আহাদ, চৌগাছা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউর রহমান, চৌগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি কামাল হোসেন, উপজেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালাম, উপজেলা জামায়াতে আমির মাওলানা গোলাম মোরশেদ, যশোর প্রেসক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন প্রমুখ। এ সময় উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, কর্মচারী, ১১ টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য সংবাদকর্মী, স্থানীয় গন্যমান্যসহ গাছিরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের অন্যান্য বক্তারা বলেন, যশোরের খেঁজুর রস ও গুড়ের ঐতিহ্য শতশত বছরের পুরাতন। যশোর জেলা ধরেই খেঁজুরের রস গুড় উৎপাদিত হলেও রস গুড় উৎপাদনে চৌগাছার রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য। তৎকালিন বৃটিশ ভারতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজ ব্লাক সাহেব পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ধোবা নামক স্থানে চিনির কল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ক্ষতির মুখে কো¤পানী বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। ঐ সময়ই কলকাতার গ্লাডস্টোন উইলি অ্যান্ড কোং যশোরের চৌগাছায় এসে চিনির কল স্থাপন করেন।

একই সময় ১৮৬১ সালে নিউহাউজ সাহেব ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদের সংযোগস্থল চৌগাছার তাহেরপুরে একটি চিনির কল স্থাপন করেন। পর্যায়ক্রমে এ অঞ্চলে বেশ কিছু চিনির কল প্রতিষ্ঠিত হয়। ইষ্ট ইন্ডিয়া কো¯পানী ইউরোপে চিনি রপ্তানী শুরু করে। কালের বিবর্তনে যশোর জেলাসহ চৌগাছার খেঁজুর গুড়ের ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। খেঁজুর গুড়ের সেই পুরোনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে এবং দেশিয় ও আন্তজাতিক বাজারে গুড়ের চাহিদা বাড়াতে উপজেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানায় বক্তারা।

মেলায় গাছিরা তাদের উৎপাদিত নির্ভেজাল গুড় বিক্রির জন্য হাজির হয়েছেন। উপজেলার ঝিনাইকুন্ড গ্রামের গাছি সলেমান, পুড়াহুদা গ্রামের নুরুল ইসলাম, সাঞ্চাডাঙ্গ্ গ্রামের গাছি আব্দুর রাজ্জাক, পাতিবিলা গ্রামেরশুকুর আলী, হায়াতপুর গ্রামের সব্দুল, রামকৃষ্ণপুর গ্রামের লাভলুর রহমান, আজিজুর রহমান জানান, তাদের নিজস্ব উৎপাদিত খাঁটি খেজুর গুড় নিয়ে মেলায় হাজির হয়েছেন। তাদের গুড় বিক্রিও হচ্ছে। মেলার এই তিনদিনে লাখ টাকার গুড় বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন গাছি আব্দুল কুদ্দুস। এছাড়া মেলায় খেজুর গুড়ের তৈরি বিভিন্ন পিঠা পুলির স্টলও রয়েছে।

মেলায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল রস জ্বালানোর পাত্র তাপাল থেকে খেঁজুর গাছের পাতা দিয়ে গরম গরম গুড় খাওয়া । এ গুড় খেতে গিয়ে আগত দর্শনাথীরা যেন নস্টালোজিয়ায় ডুবে যান। গুড় খেতে খেতে অনেকে বলেন, সেই শৈশবে আর কৈশরের দিনগুলিতে জালই (মাটির তৈরী পাত্র) আর তাপাল (টিনের তৈরী পাত্র) থেকে খেঁজুর পাতা দিয়ে গরম গরম গুড় খেয়েছি আর এখন চৌগাছার গুড়মেলায় এসে গরম গুড়ের স্বাদ নিতে পারছি।

গুড়ের মেলার যে নয়নাভিরাম দৃশ্য সবার নজর কাড়ে সেটা ছিল ঐতিহ্যপ্রেমীদের জমপেশ আড্ডা। এই ঐতিহ্যপ্রেমীরা তাদের সকল কাজ ফেলে রেখে মেলার মাঠে দাড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করেন। এদিকে দর্শনার্থীদের কাছে একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে সংবাদকর্মীরা। সবাই বলেন ব্যাতিক্রমী এ মেলায় এসে খুব ভাল লাগছে।