জঙ্গিদের সুপথে আনার উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়েছে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ১, ২০২২, ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ /
জঙ্গিদের সুপথে আনার উদ্যোগ ঝিমিয়ে পড়েছে

ছয় বছর আগে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর নড়েচড়ে বসে সরকার। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি জঙ্গিদের সুপথে ফেরাতে নানা কার্যক্রম চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু ছয় বছরের মাথায় এসে এসব কার্যক্রম অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। সেই সুযোগে আবার মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে জঙ্গিরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) জরিপ বলছে, জঙ্গিবাদে জড়ানো ২৩ শতাংশ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। আর সাধারণ শিক্ষার্থী অর্থাৎ স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে ৭৩ দশকি ২ শতাংশ। জঙ্গিবাদে জড়ানো ৬৮ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। আর ৮২ শতাংশ মানুষ জঙ্গিবাদে জড়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে।

গত ২০ বছরে জঙ্গিবাদের ২ হাজার ১০০ মামলায় গ্রেপ্তার হয় ৯ হাজার আসামি। তবে অনেকেই জামিন পেয়ে আবার জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত হচ্ছেন। দুর্বল নজরদারি কারণে তারা আবার নাশকতার সুযোগ পাচ্ছেন।

সিটিটিসির প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘জঙ্গিদের ফিজিক্যাল একটিভিটি নেই বললেই চলে। তারা অনলাইনে সক্রিয় আছে। অনলাইনে একে অপরের সঙ্গে ট্রেনিং মডিউল শেয়ার করছে। নতুন সদস্য কাছে টানার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো জঙ্গি সংগঠনেরই বড় ধরনের হামলা চালানোর সক্ষমতা নেই। যখনই কেউ হামলার পরিকল্পনা করছে, আমরা তাদের গ্রেপ্তার করছি।

সর্বশেষ গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্সে জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ৪০তম অবস্থানে রয়েছে। সেখানে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আমাদের তৎপরতার কারণে বর্তমানে নব্য জেএমবি বড় ধরনের অস্তিত্ব সংকটে আছে। তবে অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের মতো তারাও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।’

ডিএমপির এক কর্মকর্তা বলেন, তুরস্ক থেকে নব্য জেএমবিকে নিয়ন্ত্রণ করছেন মাহাদী হাসান জন। নব্য জেএমবির ছোট ছোট সেল তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তৎপর আছে। দেশে তাদের কে নিয়ন্ত্রণ করছে সে তথ্য মিলছে না। অপরদিকে পুরনো জেএমবি নতুন করে অফলাইনে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। আনসার আল ইসলাম (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) অনলাইনে তৎপর আছে। তাদেরও বড় ধরনের কোনো হামলার সক্ষমতা তৈরি হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গিরা জামিনে বের হলে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যদের জানিয়ে রাখে। এর পর জামিন পাওয়া জঙ্গি সদস্যের ওপর নজরদারি করা হয়। সব জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নজরদারির সুযোগ কম, শীর্ষ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নজরদারি করা হয়। তবে জনবল স্বল্পতার কারণে কার্যকর মনিটরিং করা যাচ্ছে না।

এন্টি টেররিজম ইউনিটের গোয়েন্দা সেলের বিশেষ পুলিশ সুপার হাসানুল জাহিদ বলেন, ‘আমরা জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত মনিটরিং করে থাকি। একই সঙ্গে তাদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ করছি। জামিনে বেরিয়ে এসে যাতে নতুন করে জঙ্গিবাদে জড়াতে না পারে বা সংগঠিত হতে না পারে, তা নজরদারি করা হচ্ছে।’

তবে জঙ্গিবাদ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন- এমন বিশ্লেষকরা বলছেন, জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত নজরদারির কথা বলা হলেও তা আসলে অপ্রতুল। যারা আগেও গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানায় ছিলেন, জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।

জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলছেন, জামিনে থাকা জঙ্গিদের সব সময় নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। বিশেষ করে যারা সুপথে ফিরতে চান, তাদের সমাজে সাধারণ জীবনযাপনে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ডেডিকেটেড সংস্থা প্রয়োজন। জঙ্গিবাদ দমনে একাধিক সংস্থা কাজ করছে। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও দেখা যায়।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বাইরে থাকা জঙ্গি ও জঙ্গি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের ডির‌্যাডিক্যালাইজেশন বা সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন। ইতোমধ্যে ৪২টি জেলায় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে। স্থানীয় সরকারের ওয়ার্ড মেম্বারসহ সব শ্রেণিপেশার মানুষকে কার্যক্রমে যুক্ত করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও কারা সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারে মোট ২ হাজার ৩০০ জঙ্গি সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে চারটি কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে ৩৬৬ জন। এসব জঙ্গি সদস্যদের মধ্যে শতাধিক জঙ্গির বিচার শেষে মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অনেক বেশি সংগঠিত। এ দলের সদস্যরা অন্যদের তুলনায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। এ দলের শীর্ষ নেতা সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়ারও প্রযুক্তিবিষয়ক পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে। ফলে সংগঠনের সদস্যদেরও তিনি সেভাবেই তৈরি করেন।

মেজর জিয়াকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও তাকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি। এখনো জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয় তাকে। বিভিন্ন সময় তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিন্তু বারবারই এ জঙ্গি নেতা ফসকে গেছেন। সম্প্রতি মেজর জিয়া গ্রেপ্তার এড়াতে অনলাইনে যুক্ত হচ্ছেন না বলে তার অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পেতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেগ পেতে হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, কারাবন্দি জঙ্গিরা সংগঠিত হয়ে বাইরে বিভিন্ন নির্দেশনা পাঠিয়ে সংগঠনকে সচল করার চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া কারাগারে জঙ্গিদের ইন্টারনেটসহ মোবাইল ব্যবহারের তথ্যও পাওয়া গেছে। একাধিক শীর্ষ জঙ্গি কারাগারে বসে হামলার পরিকল্পনাও করেছিল।