নিজাম উদ্দীন, চৌগাছা,যশোরঃ প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধা মা’য়ের নামে রয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের ৮ বিঘা জমি। সেই জমি সহোদর সেজো ভাই ও হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাই এবং দুই বোনকে ফাঁকি দিয়ে বড় দুই ভাই ফজলুর রহমান ও বজলুর রহমান লিখে নিতে চান। সেই মোতাবেক বড় ভাইয়ের ছেলে জাকির হোসেন তার ছোট চাচা (মা’য়ের ছোট ছেলে) জামির হোসেনের বাড়ি থেকে দাদীকে নিয়ে আসেন নিজেদের বাড়িতে।
তার কাছ থেকে স্বাক্ষর করে মেঝো ছেলে বজলুর রহমানের নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করে নেন মায়ের নামে থাকা ৮ বিঘা জমি। যে জমির প্রতি শতকের মূল্য স্থানীয়দের মতে ৭০ হাজার টাকা করে। যাতে ৮ বিঘা অর্থাৎ ২৬৪ শতাংশ জমির বাজার মূল্য এক কোটি ৮৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। জমির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি করেই ছাড়েনি বজলু ও ফজলু।
জমি লিখে নেয়ার প্রক্রিয়া শেষ করে মা’কে তারা ফেলে রাখে একটি জরাজীর্ণ (মাটির ঘর, জংধরা টিনের ছাউনি, যেখানে পানি পড়ে, আলো নেই) একটি ঘরের বারান্দায়। সেখানে বৃদ্ধা মা’ আছিরন বেগম মলমূত্র ত্যাগ করে একটি ছেড়া কম্বলের মধ্যেই পড়ে থাকেন খেয়ে না খেয়ে। গোসল করানো বা পরিস্কারও কেউ করায় না। বাড়ির পাশের কেউ যদি কখনও পরিস্কার করিয়ে দেয় তো সেটাই শোয়।
একটি মাধ্যমে এ ঘটনার সংবাদ পেয়ে চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইরুফা সুলতানা বুধবার (২২ জুন) দুপুরে যান উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের তজবীজপুর গ্রামে। সেখানে গেলে দেখা যায় মা আছিরন বেগম একটি মলমূত্রে পরিপূর্ণ (ভিজে টপটপ করে পড়ছে) একটি ছেড়া কম্বলে জড়িয়ে প্রায় নগ্ন অবস্থায় বসে রয়েছেন। অথচ তিন ছেলেরই রয়েছে ফ্লাট বাড়ি।
মেঝ ছেলে বজলুর ফ্লাট বাড়ির চার কক্ষের দুটিই থাকে ফাঁকা। একটিতে তিনি এবং একটিতে তার ছেলের স্ত্রী থাকেন। ছেলে চাকুরির সুবাদে খুলনায় থাকেন। বৃদ্ধার বড় ছেলের তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে প্রবাসে থাকেন। অন্য ছেলে জাকির হোসেন বাড়িতে থাকেন। তাদেরও ফ্লাট বাড়ি। অন্য একটি ফ্লাটবাড়ি নির্মাণের কাজ চলছে। সেজ ছেলে জামিরেরও ফ্লাট বাড়ি।
ইউএনও ইরুফা সুলতানা ওই মা’য়ের জন্য কয়েক রকমের ফল কিনে নিয়ে যান। সেখানে ওই মা’য়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন তিনি। মা’য়ের শরীর এবং কম্বল থেকে গন্ধ বের হওয়ায় তিনি তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন সেগুলো পরিবর্তন করে দিতে। তবে ইউএনওর সামনেও মিথ্যা বলতে থাকে বৃদ্ধার ছেলে বজলুর রহমান। তিনি বলতে থাকেন আমরা দুইভাই (ফজলু ও বজলু) মা’কে সব সময় দেখে রাখি।
তাহলে মা’য়ের এই অবস্থা কেনো? কম্বলে মলমূত্র কেনো? ইউএনও এই প্রশ্ন করলে আর কোনো জবাব দিতে পারেননি বজলুর রহমান। এসময় মা’য়ের সেজো ছেলে জামির হোসেনের দুই মেয়ে ও স্ত্রী এসে বলেন, বজলু ও ফজলু ওই মা’য়ের জমি থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করতে তাদের বাড়ি থেকে বৃদ্ধা আছিরনকে নিয়ে এসেছে।
তারা বাধা দেয়ায় তাদেরকে মারপিটও করেছে চাচা বজলু ও চাচাতো ভাই জাকির। তবে তাদের আরেক চাচা রয়েছে এ বিষয়টি তারাও এড়িয়ে যান। তারা দাবি করেন তাদের মারপিট করায় তারা এ বিষয়ে থানায় জিডিও করেছিলেন।
পরে স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, সম্পূর্ণ মিথ্যা বলছেন বজলু। বজলুরা চারভাই, দুই বোন। তাদের সবথেকে ছোটভাই রমজান হোসেন প্রায় ৩০ বছর আগে হারিয়ে যায়। তারও দুটি মেয়ে রয়েছে। তাদের বাবা মারা যাওয়ার পর মা’য়ের সাথে তারা কোটচাঁদপুরে মামা বাড়িতে থাকতো। তাদের দুই বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। ওই ছোট ভাই রমজানের জমিও বড়ভাই ফজলুর রহমান নিজের নামে করে নিয়েছেন।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় শুধুমাত্র জমি লিখে নেয়ার জন্যই তারা ব্যস্ত। বৃদ্ধা মা’র সেবা যত্ন, খাওয়া-পরা নিয়ে কোন ছেলের কোনো ভাবনা নেই। স্থানীয়দের কথার সত্যতা মেলে ইউএনওর উপস্থিতিতে বৃদ্ধার ছেলেদের মেয়েদের (বৃদ্ধার নাতি) ঝগড়া ঝাটিতে। বজলু ও ফজলু দুই ভাইয়ের স্ত্রী মারা যাওয়ায় তাদের মেয়েরা সেজো ভাই জামিরের স্ত্রী ও দুই মেয়ের সাথে কাইজ্জা শুরু করেন।
শেষে ইউএনও ইরুফা সুলতানা আইনের ব্যাখা করে বৃদ্ধার মেঝো ছেলে বজলু এবং বড় ছেলে ফজলুর ছেলে জাকিরকে নির্দেশ দেন বৃদ্ধার জমি বৃদ্ধার নামে ফেরৎ দিয়ে কাগজপত্র তাকে দেখাতে হবে। আর তিন ছেলে প্রয়োজনে পর্যায়ক্রমে একমাস করে মা’য়ের দেখভাল করবেন। এর অন্যথা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তখন মেঝো ছেলে বজলু কথা দেন অন্য কোন ভাই না দেখলেও তিনি বাকি জীবন মা’য়ের দেখভাল করবেন এবং বৃহস্পতিবারই (২৩ জুন) মা’য়ের নামের জমি মা’য়ের নামে ফেরৎ দিয়ে কাগজপত্র ইউএনওর কার্যালয়ে গিয়ে দেখিয়ে আসবেন। সর্বশেষ ছেলে বজলু ও নাতি জাকির কোলে করে বৃদ্ধাকে ছেলে বজলুর ঘরে নিয়ে একটি পরিস্কার বিছানায় শুইয়ে দেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরুফা সুলতানা বলেন, একটি মাধ্যমে শুনে ওই বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধা মা’কে তার ছেলের ঘরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে ঠিকমত তার দেখভাল করা এবং জমি নিজের নামে ফিরিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর অন্যথা হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আপনার মতামত লিখুন :