জলাবদ্ধতা নিরসনে বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরানো চলছে তাতেও আশার আলো দেখছে না ভবদহবাসী


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৪, ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ /
জলাবদ্ধতা নিরসনে বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে পানি সরানো চলছে তাতেও আশার আলো দেখছে না ভবদহবাসী

এক মাসের বেশি সময় ধরে জলাবদ্ধতার শিকার নবীজান বেগম। পানি কমার বদলে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোমর ছাড়িয়ে প্রায় বুক সমান পানি জমেছে বাড়িঘরে। নিরুপায় হয়ে সপ্তাহখানেক আগে ঘরবাড়ি ছেড়ে তার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে মণিরামপুরের নেহালপুর ইউনিয়নের বলিদাহ পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ভবনে।

শুধু নবিজানের পরিবার নয়, বিদ্যালয় ভবনটির দোতলায় আশ্রয় নিয়েছে আরও ছয়টি পরিবার। চোখে মুখে তাদের হতাশার ছাপ। কবে নিজের ভিটে মাটিতে ফিরতে পারবেন তা অনিশ্চিত। তাদের মতো পাঁচাকড়ি গ্রামের আরও প্রায় ৮৯০টি পরিবার নিজেদের বাড়িঘর না ছাড়লেও পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগের কবলে। পরিবার-পরিজন ও গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।

সোমবার যশোরের মণিরামপুরের কুলটিয়া, নেহালপুর এবং অভয়নগরের পায়রা, প্রেমবাগ, চলিশিয়া, সুন্দলী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে এ অঞ্চলের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ আবারও স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশংকায় দিন পার করছেন। গত আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের তিন-চার দিনের টানা বৃষ্টির পানিতে তলিয়েছে এ অঞ্চলের অন্তত ৫০টি গ্রাম।

এসব গ্রামে পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে বাড়িঘর, স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, ধর্মীয় উপাসনালয়। তলিয়ে গেছে কয়েক হাজার মাছের ঘের। এখনো বিলগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে পানি। আর এতে আরও কয়েকমাস জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা। নিরাপদ চলাফেরার পাশাপাশি গোখাদ্য, সুপেয় পানির অভাব আর নাজুক স্যানিটেশন ব্যবস্থার কারণে অনেকেই এলাকা ছেড়ে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন।

কুলটিয়া টু মশিয়াহাটি সড়কের উঁচু স্থানে গরুর জন্য আলাদা ঘর তৈরি করেছেন অনেকে। বাড়ি ঘরে হাঁটু থেকে কোমর পানি থাকায় গরুর জন্য নিরাপদ স্থান এখন উঁচু রাস্তা। সুষমা নস্কর নামে একজন বলেন, ‘পরিস্থিতি এখন ইরাম যে গরু আর মানুষ পারলি একসাথেই থাকতি হচ্চে। পরিস্থিতি যা তাতে জল যদি বেশি দিন থাকে গরুগুলো বাচাতি তা বিক্কিরি করা ছাড়া উপায় থাকপে না। একে তো রাখার জাগা নেই। তারপরে বিচেলির দাম আকাশ ছুঁয়েছে।’

কপালিয়ার তিন ভেন্ট স্লুইচ গেটের পাশে নিজেদের উদ্যোগে বাঁধ দিচ্ছিলেন রাম প্রসাদ সরকার, বিধান সরকারসহ আরও কয়েকজন। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের উপায় কী জানতে চাইলে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, ‘এর কোনো সমাধান নেই। সামাধান খুঁজতে গেলে কারও পক্ষে আর কারও বিপক্ষে যাবে। বছরঅন্তর জল বাড়বে, মিডিয়া লিখবে আর প্রকল্প পাশ হবে। যারা জলে ডোবে তারা এক-দু’বছর পরপর ডুবতেই থাকবে।’

বলিদহ পাঁচাকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জিএম হারুন অর রশীদ এবং আব্দুস সবুর জানান, বিলাঞ্চলে পরিকল্পিত জোয়ারাধার প্রকল্পের দাবি অযৌক্তিক নয় তা সকলে বুঝলেও দায়িত্বশীলরা বোঝেন না। ভবদহ অঞ্চলের বিলগুলোতে টিআরএম (টাইটাল রিভারস ম্যানেজমেন্ট তথা জোয়ার আধার প্রকল্প) চালু হলে জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান সম্ভব।

ভবদহের ২১ ভেন্ট স্লুইচ এর ওপর চারটা বড় পাম্প চলছে। এছাড়া ৯ ভেন্টের ওপর সবসময় চলছে পাঁচটা পাম্প। ‘জনদুর্ভোগ লাঘবে’ এ সেচ প্রকল্প নেওয়া হলেও এটা কতখানি কাজে আসছে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিৎ বাওয়ালি বলেন, ‘পাম্পের সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশস্ত ও সুগভীর নদী হত্যা করা হয়েছে। তাছাড়া আর কিছু হয়নি। সেচের মাধ্যমে পানি অপসারিত হলেও পলি থেকেই যাচ্ছে। এতে নদী ও খালের পানি গেলেও নাব্যতা হারাচ্ছে’।
টিআরএমকে উপেক্ষা করে নদীখনন, পলী অপসারণ, বাঁধ নির্মাণসহ বিভিন্ন সময়ে ভবদহের জলাবদ্ধতা নিরসনে কোটি কোটি টাকার প্রজেক্ট কিছু স্বার্থন্বেসীর নিজস্ব ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল হলেও বৃহৎ স্বার্থে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ করেন প্রবীণ এই নেতা।

বিভিন্ন গ্রামের ভুক্তভোগীরা জানান, যশোর সদর উপজেলার আংশিক, অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুর উপজেলা এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার ৫৪টি বিলের পানি নিষ্কাশিত হয় শ্রী নদীর ওপর নির্মিত ভবদহ স্লুইসগেট দিয়ে। ২০১৩ সালের পর এলাকার কোনো বিলে টিআরএম চালু না থাকায় পলি পড়ে এলাকার পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর বুক উঁচু হয়ে গেছে। ফলে নদী দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হচ্ছে না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ ব্যানার্জি জানিয়েছেন, হরি নদের ২ দশমিক ১ কিলোমিটার পুনর্খনন কাজ চলমান। জলাবদ্ধতা নিরসনে বৈদ্যুতিক সেচযন্ত্র দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরানোর কাজ চলছে। বিভিন্ন খাল সংস্কারের বিষয়ে সভা চলমান। দ্রুত সমস্যা সমাধানে আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন দাবি ইতিমধ্যে জানিয়েছেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কাজ করে যাচ্ছে। সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানানো হবে বলে জানান তিনি।