আরিফুজ্জামান মামুন
বাংলাদেশে গুম-খুন তথা স্পর্শকাতর ঘটনা এবং এ নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী ব্যক্তি ও মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিল জাতিসংঘ। এতে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকা-সহ গত বছরের ১ মে থেকে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সংঘটিত ৭৬টি গুমের ঘটনার সবশেষ তথ্য চাওয়া হয়।
সংস্থার মহাসচিবের ‘জাতিসংঘের সঙ্গে সহযোগিতা, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে তার প্রতিনিধি এবং প্রক্রিয়া’বিষয়ক রিপোর্টে এ সম্পর্কে বাংলাদেশের বক্তব্য স্থান পাবে জানিয়ে জবাবের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ১৫ জুলাই। আগামী সেপ্টেম্বরে মানবাধিকার কাউন্সিলে জাতিসংঘ মহাসচিবের
এ নিয়ে বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করার কথা। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও তা প্রস্তুত করতে পারেনি ঢাকা। এর আগে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘটনায়ও সঠিক সময়ে তথ্য দিতে পারেনি বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, ঈদের ছুটিসহ নানা কারণে জাতিসংঘের চিঠির উত্তর পাঠানো সম্ভব হয়নি। তবে দ্রুতই সমন্বিত তথ্য জাতিসংঘকে পাঠানো হবে।
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমরা এখনো উত্তর দিইনি। অপেক্ষা করছি, সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে সাড়া পেলে পাঠিয়ে দেব। আমরা ওদেরকে বলে রেখেছি, ঈদের বন্ধের কারণে সামান্য দেরি হতে পারে। কিন্তু কাজ চলছে। অনেক সময় যে ফরম্যাটে উত্তরগুলো চাওয়া হয়, আমরা হয়তো সে ফরম্যাটে বিভিন্ন সংস্থা থেকে উত্তরগুলো পাই না। তখন আমাদের একটু সময় লাগে ফরম্যাটিংটা করতে। গুম-খুনের ঘটনার পাশাপাশি এগুলো নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী পদক্ষেপ নিয়েছে অর্থাৎ সরকারের অবস্থান কী, তা তুলে ধরার সুযোগ আছে এই প্রতিবেদনে। সময়টা যাতে আরও কমিয়ে আনা যায়; ধরেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেল, সেখানে ওইটা আবার যাচাই-বাছাই হলো তিন দিন। সেখানে আবার চেঞ্জ হলো। সেখানে আবার চার দিন। তো এর মধ্যে পাঁচ-সাতদিন চলে যায়। এ জন্য লাস্টের দিকে প্রায় যখন তৈরি হয়ে যায়, তখন অতিরিক্ত ৮-১০ দিন লাগায় ডেডলাইন মিট করতে একটু কষ্ট হয়। এসব জটিলতায় বা সমন্বয়ে আরও উন্নতি দরকার।’
গত ২৭ জুন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে লেখা অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটসের (ওএইচসিএইচআর) চিঠিতে বলা হয়, জাতিসংঘ মহাসচিবের রিপোর্টে ১ মে ২০২১ থেকে ৩০ এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে সংঘটিত মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট স্পর্শকাতর ঘটনাগুলো স্থান পাবে। ওই সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত মানবাধিকার সংবেদনশীল কিছু ঘটনা রয়েছে। সে সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ আছে। ওএইচসিএইচআর আশা করে ঢাকা সেই সুযোগ গ্রহণ করবে। সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা ওসব কেসের বিষয়ে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে বাংলাদেশের বক্তব্য পাওয়া জরুরি। অন্যথায় হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিব যে বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করতে যাচ্ছেন, তাতে বাংলাদেশের ভাষ্য অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে না।
চিঠির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পরিশিষ্ট ১-এ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর হত্যাকাণ্ডে জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এ কেসের বিস্তারিত তুলে ধরে এর আপডেট জানতে চায় তারা। এতে ৭৬টি গুমের ঘটনার আপডেট চেয়ে বলা হয়, ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর সরকার ঘোষণা দেয়, মুলতবি থাকা ৭৬টি ঘটনা তারা জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্সেসের (ডব্লিউজিইআইডি) সঙ্গে তদন্ত করছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে কর্তৃপক্ষ কিছু ভিকটিমের আত্মীয়দের বাড়িতে উপস্থিত হয় এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। অভিযোগ রয়েছে যে, তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ভিকটিম, বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধানে কাজ করা এবং জবাবদিহিতায় পরামর্শ দেয় এমন কিছু এনজিও প্রতিনিধিরা এতে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অধিকার। ম্যান্ডেট হোল্ডাররা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, ডব্লিউজিইআইডিসহ জাতিসংঘের বিভিন্ন এনটিটিকে সহযোগিতা করেন মানবাধিকারের পক্ষে থাকা এমন কর্মী এবং ভিকটিমের আত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করা হয়ে থাকতে পারে। ২০২২ সালের ১৪ মার্চ মানবাধিকারকর্মী এবং জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাদের কর্মকা- এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা এবং জাতিসংঘের মেকানিজমকে সহযোগিতার জন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া বন্ধ করতে প্রকাশ্যে কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায় স্পেশাল প্রসিডিউরস ম্যান্ডেট হোল্ডাররা।
২০২২ সালের ১২ মে সরকার জবাবে বলে, নিখোঁজ অথবা অজ্ঞাত রয়েছেন এমন ব্যক্তিদের উদ্ধারে বা শনাক্ত করতে তাদের পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সহযোগিতা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার। এতে বলা হয়, নিখোঁজ ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য তাদের বিষয়ে আরও তথ্য প্রয়োজন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে ওই ৭৬টি ঘটনার অনেকেরই রেকর্ড নেই। সরকার জানিয়েছে, তারা তথ্য চেয়ে তাদের আত্মীয়দের কাছে চিঠি ইস্যু করেছে। ভিকটিমদের পরিবারের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়া তাদের উদ্দেশ্য নয়। তাদের আইনগত সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :