জাপানের মানুষ শিনজো আবেকে যেভাবে মনে রাখবে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ৮, ২০২২, ৮:২১ অপরাহ্ণ /
জাপানের মানুষ শিনজো আবেকে যেভাবে মনে রাখবে

একজন রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী হিসাবে পরিচিত, ৬৭ বছরের শিনজো আবের নেতৃত্বে লিবারের ডেমোক্রাটিক পার্টি (এলডিপি) দু-দুবার নির্বাচনে জেতে। প্রথম দফায় তিনি খুব অল্প সময় ক্ষমতায় ছিলেন – ২০০৬ সালের শুরু থেকে এক বছরের কিছুটা বেশি- এবং তার ঐ শাসনকাল নিয়ে কেলেঙ্কারি আর বিতর্ক ছিল।

কিন্তু ২০১২ সালে তার ক্ষমতায় ফেরা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। তারপর ২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করা পর্যন্ত টানা আট বছর তিনি জাপানের ক্ষমতায় ছিলেন।

দ্বিতীয় দফায় আবে যখন প্রধানমন্ত্রী হন জাপান তখন অর্থনৈতিক মন্দার কবলে। মূদ্রা সরবরাহ সহজ করে এবং ব্যবসায় নানারকম অর্থিক প্রণোদনা দিয়ে তিনি জাপানের স্থবির সেই অর্থনীতিকে প্রবৃদ্ধির পথে নিয়ে আসেন।

২০১১ সালের সুনামি এবং ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞে জাপানে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যায়। সে সময় ফুকুশিমা পারমানবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনায় দেশটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ধাক্কা গিয়ে পড়ে অর্থনীতিতে। কিছুদিন পর ক্ষমতায় এসে সেই সংকট সামলেছিলেন শিনজো আবে।

আবে নতুন করে জটিল পাকস্থলির আলসারে আক্রান্ত হয়েছেন- বেশ কিছুদিন ধরে এমন সন্দেহ-কানাঘুষো চলার পর ২০২০ সালে পদত্যাগ করেন তিনি। একই রোগের কারণে ২০০৭ সালেও তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।

তার পদত্যাগের পর তার উত্তরসূরি হন ঘনিষ্ট রাজনৈতিক মিত্র ইয়োশিহিদে সুগা। ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও, জাপানের রাজনীতিতে আবের প্রভাব-প্রতিপত্তি কখনই কমেনি।

japan

শোকাহতরা শিনজোকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন

ক্ষমতার চূড়ায় ওঠার পক্রিয়া

শিনজো আবের বাবা ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিনতারো আবে। তার নানা অর্থাৎ মাতামহ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নবুসুকে কিশি। সুতরাং জাপানের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে ছিল তার জন্ম এবং বড় হওয়া।

জাপানের পার্লামেন্টে তিনি প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৯৩ সালে। পরে ২০০৫ সালে মন্ত্রীসভার সদস্য হন যখন তৎকালীন প্রধনমন্ত্রী জুনিচিরো কোইজুমি তাকে প্রধান কেবিনেট সচিব পদে নিয়োগ দেন। পরের বছরই অর্থাৎ ২০০৬ সালে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে চমকে দিয়েছিলেন।

কিন্তু ক্ষমতা নেয়ার পরপরই বিশাল সংখ্যায় পেনশন রেকর্ড নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত বেশ কিছু স্পর্শকাতর কেলেঙ্কারির মধ্যে পড়ে যায় তার সরকার। তার জেরে ২০০৭ সালের জুলাইতে পার্রামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে বড় ধরণের পরাজয় হয় ক্ষমতাসীন এলডিপির। সেপ্টেম্বরে ‘আলসারেটিভ কলিটিস’ রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথা জানিয়ে পদত্যাগ করেন শিনজো আবে।

কিন্তু ২০১২ সালে তিনি ঘোষণা দেন তিনি সেরে উঠেছেন এবং আবারো প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে আসেন। পরে ২০১৪ সালে এবং ২০১৭ সালে তিনি পুনঃনির্বাচিত হন। হয়ে ওঠেন জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী।

যদিও তার জনপ্রিয়তার পারদ ওঠা-নামা করেছে, কিন্তু এলডিপিতে তার একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে ক্ষমতা ধরে রাখতে তেমন কোনো বড় চ্যালেঞ্জ তাকে মোকবেলা করতে হয়নি। তৃতীয় দফাতেও যেন তিনি এলডিপির নেতা হতে পারে সেজন্য দলের নীতি পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়েছিল।

একজন বিতর্কিত জাতীয়তাবাদী 

একটি আক্রমণাত্মক বিদেশ এবং প্রতিরক্ষা নীতির সূচনা করেন আবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান সংবিধানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোনো একটি যুদ্ধবিগ্রহ করবে না। ক্ষমতায় এসে মি. আবে ঐ সংবিধান সংশোধন করতে উদ্যত হন।

যুদ্ধের পর আমেরিকা জাপানের ঐ সংবিধানের খসড়া করে দিয়েছিল। ফলে, সেদেশের রক্ষণশীলদের কাছে ঐ সংবিধান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের লজ্জাজনক পরাজয়ের একটি প্রতীক।

আবের এই কট্টর জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার কারণে চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে জাপানের সম্পর্কে চাপ তৈরি হয়। বিশেষ করে ২০১৩ সালে মি.আবে টোকিওর বিতর্কিত ইয়োসুকুনি মন্দিরে গেলে তা নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ঐ মন্দিরকে জাপানের সামরিক আধিপত্যবাদের ইতিহাসের একটি প্রতীক হিসাবে দেখা হয়।

একবার নয় আবে বারবার ঐ মন্দিরে গেছেন যা নিয়ে জাপানের বাম ধরার দলগুলো পর্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বলতে শুরু করে আবে যুদ্ধের সময় জাপানি নৃশংসতার ইতিহাস অস্বীকার করতে চাইছেন।

দু’হাজার পনের সালে, তিনি জাপানের ‘যৌথ আত্মরক্ষার অধিকারের’ নীতি নেওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করেন যাতে জাপান তার নিজের এবং মিত্রদের প্রতিরক্ষায় দেশের বাইরে সৈন্য পাঠাতে পারে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর আপত্তি এবং দেশের মধ্যে বহু মানুষের আপত্তি সত্বেও প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত নতুন ঐ বিতর্কিত প্রতিরক্ষা নীতি পার্লামেন্টে পাশ হয়ে যায়।

তবে জাপানের সামরিক বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সংবিধান পরিবর্তনে তার ইচ্ছা অপূর্ণ রয়ে যায়।

হোক্কাইডো উপকূলের কাছে কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে রাশিয়ার সাথে জাপানের বহুদিন ধরে মতবিরোধ চলছে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আসার যে সংকল্প তার ছিল, তাও পূরণ হয়নি।

অর্থনীতি এবং কোভিড সামাল

২০১২ সালের পর ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে যে অর্থনৈতিক নীতি আবে নিয়েছিলেন – যা আবেনোমিক্স নামে পরিচিত পেয়েছিল – তা বেশ প্রশংসা পেয়েছিল। বলা হয়, তিনিই সেসময় জাপানকে মন্দা থেকে উদ্ধার করেছিলেন। সুদের হার কমিয়ে দিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের এবং কোম্পানিগুলোকে সস্তায় ঋণ নেওয়ার সুবিধা করে দেয়া হয়। সরকার নিজে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরিতে ব্যায় বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যবসায় কর ছাড় দেয়া হয়।

 শ্রমবাজারে বিভিন্ন সংস্কার এনে তিনি নারীদের চাকরির সুবিধা বাড়িয়ে দেন। সেইসাথে, বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করে দেন। এসবের লক্ষ্য ছিল – উৎপাদন এবং ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে অর্থনীতিতে যেন প্রবৃদ্ধি ফিরে আসে।

কিন্তু ২০২০ সালে জাপান আবারো মন্দার কবলে পড়ে যায়। ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে মি. আবের অর্থনৈতিক নীতি আসলে কতটা টেকসই। কোভিড মহামারি সমালানোর ক্ষেত্রেও তার সরকারের ভুমিকা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন ওঠে, এবং তার জনপ্রিয়তা বড়রকম পোড় খায়।

সমালোচনা শুরু হয়, অভ্যন্তরীন পর্যটন বাড়াতে গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সমালোচকরা বলেন, নারীদের শ্রমবাজারের নিয়ে আসা বা স্বজনপ্রীতি কমাতে যেসব বব্যস্থা মি. আবে নিয়েছিলেন তাতে তেমন কাজ হয়নি।

তবে, প্রশান্তমহাসাগরীয় অঞ্চলের দুই প্রান্তের দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসা বাড়াতে ১১টি দেশের একটি জোট থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর যেভাবে  আবে জোটটিকে ধরে রেখেছিলেন, সেজন্য দেশের বাইরে তিনি অনেক প্রশংসিত হন।

পদত্যাগ এবং মৃত্যু

গত বছর ২৮শে আগস্ট যখন আবে পদত্যাগ করেন তার দলের মধ্যে প্রচণ্ড কোন্দল শুরু হয়ে যায়। কারণ, তিনি নিজে কাউকে উত্তরসূরি হিসাবে পছন্দ করে যাননি।

তবে তার জায়গা নিন অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং মন্ত্রীসভার সদস্য ইয়োশিহিদে সুগা। সুগাকে সরিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা ক্ষমতা নিলেও জাপানের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে মি. আবের প্রভাব অব্যাহত থাকে।

৮ই জুলাই জাপানের পার্লামন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচনে এক প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণার জন্য দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর নারায় যান মি. আবে। সেখানে এক বক্তৃতা দেওয়ার সময় ৪১ বছর বয়সী একজন বন্দুকধারী তাকে গুলি করে। জানা গেছে, হত্যাকারী একজন সাবেক নৌ সেনা। হাসপাতালে নেয়ার সময়ও আবে সচেতন ছিলেন, কিন্তু পরে তিনি মারা যান।

বিবিসি