দ্রুত নির্বাচনই মঙ্গল


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৫, ৮:৪০ পূর্বাহ্ণ /
দ্রুত নির্বাচনই মঙ্গল
  • বিশেষজ্ঞদের মতামত: সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয় আমি মনে করি, বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচিত সরকার আসা উচিত :ডা. জাহেদ উর রহমান, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করতে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প কিছুই হতে পারে না :প্রফেসর ড. সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরী

রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিভিন্ন কমিশন গঠন করেছে। এর মধ্যে ছয় সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন ৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করা হয়েছে। ওই দিন সংস্কার কমিশনের প্রধানরা রাষ্ট্র সংস্কারে আশু করণীয়, মধ্যমেয়াদি বা ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকার কী করতে পারে তার সুপারিশমালা পেশ করেন। যে সব কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে সেগুলো হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এই সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে প্রায় দুই হাজার সুপারিশের বিষয়টি এখন সর্বমহলে আলোচিত। এত সুপারিশমালা বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা।

তাদের অভিমত একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কার করাই এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। সংস্কারের নামে অযথা সময় ক্ষেপণ করলে ফ্যাসিবাদী শক্তি তাতে সুযোগ নিতে পারে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, অযথা সময় ক্ষেপণের বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তাদের নেই। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে রাষ্ট্র মেরামতের মৌলিক শর্ত পূরণ করার জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে সংস্কারগুলো অতি জরুরি, সেগুলো করার সাথে সাথে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা চলে যেতে চাই। এ নিয়ে কোনোরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত বছর ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। এরপর তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে দেন। এসব কমিশনকে ৯০ দিন বা তিন মাসে অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। এরপর নির্ধারিত সময়ের ১৫ দিন পর গত ১৫ জানুয়ারি সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ সংস্কার ও দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক এই চারটি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে পেশ করা হয়। অপরদিকে জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয়।

তবে বিশিষ্ট জনদের অভিমত এসব সংস্কার কমিশন যে সব সুপারিশমালা পেশ করেছে তার বেশির ভাগই বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এর মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন সংশ্লিষ্ট অনেক সুপারিশ রয়েছে যেগুলো খুবই অবস্তাব ও অলিক বলে মনে করছেন অনেকে। যেমন প্রজাতন্ত্রের নাম সংশোধনের বিষয়, চারটি প্রদেশে দেশ ভাগ করার বিষয়। এরকম আরো অনেক প্রস্তাবনা রয়েছে যেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব নয়। এ ছাড়া প্রশাসন সংস্কারে যে সব প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে তাতে প্রশাসনে আরো বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ক্যাডার সার্ভিসগুলো ভেঙে ফেলার প্রস্তাব বাস্তসম্মত নয়। ক্যাডার ভেঙে ফেলার প্রভাব কী, তা প্রতিবেদন জমা দেয়ার আগে বিশ্লেষণ করা হয়নি। ১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুবিধা প্রসঙ্গে ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারের এ ধরনের আর্থিক সামর্থ্য আছে? একজন কর্মকর্তাকে রাষ্ট্র লেখাপড়া করিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করল, এরপর ১৫ বছর চাকরি করে তিনি অবসরে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে লাভবান হবেন এমন সুযোগ দেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য কি রাষ্ট্রের আছে। তাছাড়া এলজিইডির প্রকৌশলীরা নন-ক্যাডার, নন-ক্যাডার প্রকৌশলীদের ক্যাডারভুক্ত করা এবং নন-ক্যাডার কর্মচারীদের সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ রাখার ফলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা হবে।

ছয়টি সংস্কার কমিশন যে শত শত প্রস্তাব দিয়েছে তা নিয়ে যথাযথ আলোচনা করলেও বছর পেরিয়ে যাবে। এ ছাড়া এসব সংস্কার বাস্তায়নে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন তার সঙ্কুুলানও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকে মনে করছেন, সংস্কারের এত ব্যাপক বিষয় নিয়ে আলোচনা করে সরকার অহেতুক সময় নষ্ট করে নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে চায়। তারা বলছেন, প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন দেয়াটাই এ সরকারের জন্য হবে মঙ্গলজনক।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, রাজনৈতিকদলগুলো যে যার অবস্থান থেকে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে এক ধরনের বাগি¦ত-া হচ্ছে। কোনো একটি পক্ষ তাদের মতো করে কিছু চাইলেই তা হবে না। সরকারের কাছ থেকে কে কতটুকু কী অর্জন করতে পারবে, তা আসলে নির্ভর করছে, মাঠে কার কতটুকু শক্তি আছে, তার ওপর। নির্বাচন নিয়ে অধ্যাপক ইউনূস একটি সময়সীমার কথা বলেছেন।

আমি মনে করি, বাংলাদেশে যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচিত সরকার আসা উচিত। এই বছরের মধ্যে নির্বাচনের যে কথা বলা হচ্ছে, সেটিই আমার কাছে অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। আসলে নির্বাচনের আগে ও পরে দুই ক্ষেত্রেই সংস্কার করতে হবে। সরকার কমিশনের প্রতিবেদনগুলোকে দুভাগে ভাগ করতে পারে; কিছু বিষয়ের জন্য হচ্ছে সংবিধান সংস্কার করতে হবে আর কিছু বিষয়ের জন্য আইন, বিধিমালা, ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতে হবে। আইন করার জন্য সংসদ লাগে। এখন যেহেতু সংসদ নেই, অধ্যাদেশ দিয়ে আইন করতে হবে। আর যে বিষয়গুলোর জন্য সংবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে, সেগুলো ভবিষ্যতের জন্য রাখতেই হবে। কিছু অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। আমি নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য ছিলাম। সেই জায়গা থেকে একটি উদাহরণ দিই।

আমাদের সংসদ নির্বাচন যে আইন দিয়ে হয়, তা হলো গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও)। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকগুলো সংশোধনীকে প্রস্তাব আকারে দিতে পারি। ধরে নিলাম, পাঁচটি বিষয়ে সবাই একমত হলো। এই পাঁচটি বিষয় আইন মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং সেকশনে পাঠাতে হবে। সেগুলো ঠিকঠাক করে তা উপদেষ্টা পরিষদে পাঠাতে হবে। সেখানে এক দিন আলোচনা করে অধ্যাদেশ জারির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। সব পক্ষের মতামত নিয়ে ছয়টি কমিশনের প্রস্তাবিত আইনগত পরিবর্তনগুলো এভাবে করা যায়। যদি এক মাস ইনটেনসিভ (ব্যাপক) আলাপ-আলোচনা করা হয়, তাহলে পরবর্তী এক-দুই মাসের মধ্যেই এ সংস্কারগুলো করা সম্ভব।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত বিভিন্ন কমিশন রাষ্ট্র সংস্কারের যে বিশাল প্রস্তাবনা পেশ করেছে সেখান থেকে অতি জরুরি বিশেষ করে ভেঙে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়নের পক্ষেই মত দিয়েছেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনরা। কারণ ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন করে দেশের অভ্যন্তরে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পাশপাশি স্বাধীনতা সার্বোভৌমত্ব হেফাজতে এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে যাওয়াই জরুরি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন করে দেশের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং স্বাধীনতা-সার্বোভৌমত্বকে সুসংহত করতে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প কিছুই হতে পারে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই নির্বাচনের কথা বলে আসছেন। জনগণের প্রত্যাশাও তাই। এ অবস্থায় নির্বাচন সংশ্লিষ্ট এবং রাষ্ট্র সংস্কারে অতি জরুরি সংস্কার প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। আবার সংবিধান সংশোধনের মতো কিছু প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচিত সরকার এবং সংসদ দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসে এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের অঙ্গীকার আদায় করা যেতে পারে। তবে সংস্কারের জন্য কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক ধারায় ফেরার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি কারো জন্যই কল্যাণকর হবে না।

বগুড়ার বিশিষ্টজনরা রাষ্ট্র ও সংবিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর উপস্থাপিত সুপারিশমালার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সবাই বলছেন, বিশেষ করে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে জটিলতা সবচেয়ে মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এটি হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে বলেও অনেকের অভিমত। অনেকে বলছেন, সংস্কার কমিটিগুলোর কার্যক্রম এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের উপস্থাপনা দৃষ্টে মনে হয়, বর্তমান সরকারের দীর্ঘকালীন মেয়াদ নিশ্চিত করার মিশন হিসেবে সবকিছু হচ্ছে। ওয়ান-ইলেভেনের পলিসির নতুন রূপায়ন বলেও মনে করছেন অনেকে। প্রায় সবারই ধারণা, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের পক্ষে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার আন্তরিকতায় ঘাটতি রয়েছে।

সরকার মূলত ফ্যাসিস্ট, আওয়ামী লীগ, ভারত ও শেখ হাসিনাকেন্দ্রিক ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে অজ্ঞাত উদ্দেশ্য হাসিলেই বেশি আগ্রহী। এ বিষয়য়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য প্রশাসন (সুপ্র) বগুড়া জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কে জি এম ফারুক ইনকিলাবকে বলেন, ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে নিয়ে জনমনে সৃষ্ট আশাবাদ ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যক্রম মোটেও সন্তোষজনক নয়।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন প্রধানদের কর্মক্ষমতা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যা সত্যিই উদ্বেগজনক। বগুড়া জেলা বার সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আতাউর রহমান খান মুক্তা বলেন, সংস্কার কমিশনগুলোর কার্যকলাপ হতাশাজনক। তাছাড়া দেশ পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ বর্তমান সরকারের উচিত হবে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচিত সরকার ছাড়া ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত একটি দেশের জনআকাক্সক্ষা পূরণ অসম্ভব। তিনি বলেন, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত সরকার সংস্কার কার্যক্রম চালু রাখবে না বা সংস্কার করবে না এটি মনে করা ঠিক নয়।