প্রথমেই আমরা দেখব- আবুল সরকারের অশুদ্ধ আরবিতে পড়া যে চারটি বাক্যকে তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর কথা বলে দাবি করেছেন, সেগুলো আসলে কতটুকু সত্য। এ প্রসঙ্গে আমরা কথা বলেছি হাদিস বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও রাজধানীর দারুল উলুম ঢাকার মুহাদ্দিস মুফতি জহির রায়হানের সাথে।
মুফতি জহির রায়হান শুরুতেই আবুল সরকারের দাবিকে মিথ্যা আখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, ওই বয়াতি যে আরবি বাক্যগুলো আল্লাহর কথা বলে চালিয়ে দিয়েছেন, তা আদৌ কোরআনে তো নেই-ই; বরং সহিহ হাদিসের গ্রন্থগুলোতেও সেগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। সুতরাং সেগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বিস্তারিত ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আওয়ালু মা খালাকাল্লাহুল ইশক (প্রথম যে জিনিস আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তা হলো প্রেম/ইশক)’- এটি জাল বর্ণনা। এটিকে হাদিস বলার কোনো অবকাশ নেই। প্রামাণ্য কোনো হাদিসের গ্রন্থে (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ, তাবরানী, বায়হাকী প্রভৃতি) এই বাক্যের একটি শব্দও পাওয়া যায় না। মুহাদ্দিসগণ এটিকে ‘বাতিল’ আখ্যা দিয়েছেন।
মুফতি জহির রায়হান আরো বলেন, দ্বিতীয়ত, ‘আওয়ালু মা খালাকাল্লাহু মিন রূহি (আল্লাহ প্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন, তা আমার রূহ কিংবা রূহ থেকে)’- এটিও মাওজু তথা জাল বর্ণনা। হাদিসের ইমামগণ (ইবনে তায়মিয়াহ, ইবনে কাসীর, আল-শাওকানী, ইবনে জাওযী, আস-সাখাওয়ী প্রমুখ) একে পুরোপুরি বাতিল ও জাল বলেছেন। এটির বিশ্বস্ত কোনো সিলসিলা নেই।
পাশাপাশি ‘আওয়ালু মা খালাকাল্লাহুর আরশ (প্রথম যে জিনিস আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তা হলো আরশ)’ ও ‘আওয়ালু মা খালাকাল্লাহু মিন নুরি (প্রথম যে জিনিস আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তা আমার নূর থেকে কিংবা আমার নূর)’ প্রসঙ্গেও পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসগণের একই অভিমত। তা হলো- দু’টিই জাল বর্ণনা। ইমাম ইবনে জাওযী, সাখাভি, ইবনে তায়মিয়াহ, আল-আলবানী প্রমুখ স্পষ্ট বলেন- ‘লা আসলা লাহু’। মানে এর কোনো মূল/ভিত্তি নেই।- যোগ করেন মুফতি জহির রায়হান।
আল্লাহ ও রাসূল সা:-এর ওপর অপবাদ আরোপ
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হলো যে, বাউল আবুল সরকার প্রথমত মিথ্যা বলেছেন এবং দ্বিতীয়ত, তিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়; এরপর কেন আল্লাহ এই কথা বললেন- সেজন্যও তাঁর প্রতি অত্যন্ত অশোভন ও আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন বাউল আবুল সরকার।
আবুল বয়াতির বক্তব্য কেন আপত্তিকর
আবুল সরকার ওই ভিডিওতে মানুষের মুখের সাথে আল্লাহর মুখের তুলনা করেছেন। কিন্তু বাস্তবে আল্লাহ হলেন নিরাকার এবং তিনি কারো মতো নন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহর মতো কিছুই নেই।’ (সূরা শূরা, আয়াত : ১১)। মুফতি জহির রায়হান বলেন, স্রষ্টাকে সৃষ্টির মতো ভাবা, তাঁর সম্পর্কে বিদ্রূপাত্মক ভাষা ব্যবহার করা—এগুলো ইসলামের কাছে শুধু ভুল নয়; বরং আত্মিক ধ্বংসের নামান্তর। নবীজী সা: সতর্ক করে বলেছেন— মিথ্যা কথা তাঁর নামে বানানো সবচেয়ে বড় অপরাধের একটি। আর আবুল বয়াতির বক্তব্য ঠিক সেই অপরাধের ওপর দাঁড়িয়ে আবার নতুন অবমাননা সৃষ্টি করেছে। ইসলামের আলোকে তার বক্তব্য আপত্তিকর হওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে, যেগুলো অত্যন্ত স্পষ্ট- সেগুলো হলো-
এক. তিনি এমন কথাকে ‘হাদিস’ বলছেন যা হাদিস নয়—সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও জাল। দুই. জাল বর্ণনাকে সত্য বলে চালানো বড় গুনাহ; এর ওপর আল্লাহকে নিয়ে বিদ্রূপ করা অপরাধের সীমা ছাড়িয়ে যায়। তিন. তার ভাষণ সাধারণ মানুষকে বিশ্বাসের মূল থেকে বিচ্যুত করছে, বিভ্রান্তির আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে, এবং সমাজে বিশ্বাসভিত্তিক অশান্তি তৈরি করছে।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে আবুল সরকারের শাস্তি
এজন্য মুফতি জহির রায়হান দাবি করেন- আবুল সরকার শুধু একটি নয়; বরং বেশকিছু জঘন্য অপরাধ করেছেন। আর এমন ব্যক্তির কী শাস্তি হতে পারে সে প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ড. এবিএম হিজবুল্লাহ বলেন, তার (বাউল আবুল সরকার) মন্তব্যে আল্লাহকে একপ্রকার অবজ্ঞা করা হয়েছে। আসলে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আল্লাহর প্রতি এ ধরনের অবজ্ঞার কোনই সুযোগ নেই।

কোরআনের উদ্ধৃতি দিয়ে দেশের প্রবীন এই আলেম বলেন, ‘অবশ্যই যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয় দুনিয়া ও আখেরাতে, আল্লাহ তাদেরকে লানত করেন এবং তাদের জন্য অপমানকর শাস্তির ব্যবস্থা প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সূরা আহযাব, আয়াত : ৫৭)। অন্য এক আয়াতে তিনি বলেছেন, ‘যদি আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন তখন তারা বলবে, আমরা তো এমনিতেই ক্রীড়া কৌতুক করছিলাম। আপনি বলুন, আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত এবং তাঁর রাসূলের সাথে তোমরা ঠাট্টা বিদ্রুপ করছো? তোমাদের কোনো অজুহাত চলবে না। তোমরা ঈমানের পরে কুফুরি করেছ।’ (সূরা তাওবা, আয়াত : ৬৫-৬৬)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যখন সে আমাদের কোনো আয়াত অবগত হয়, তখন সে সেটাকে পরিহাসের পাত্র রূপে গ্রহণ করে। তাদেরই জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা জাছিয়া, আয়াত : ৯)
ড. এবিএম হিজবুল্লাহ বলেন, এই আয়াতগুলো দ্বারাই স্পষ্ট বোঝা যায়- আল্লাহ সম্পর্কে এ ধরনের বিদ্রূপাত্মক কথাবার্তা সন্দেহাতীতভাবে কুফরি। এর দ্বারা ঈমান থেকে সুস্পষ্টভাবে বেরিয়ে যায়। অর্থাৎ তিনি কুফরিতে লিপ্ত হন। উপরোক্ত আয়াতের আলোকে এ ধরনের মন্তব্য ঈমান ভঙ্গের কারণ হিসেবে বিবেচিত। শরীয়তের পরিভাষায় এদেরকে মুরতাদ ও ধর্মত্যাগী বলা হয়। আর মুরতাদের শাস্তি বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়। আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে।’ (সূরা বাকারা, আয়াত : ২১৭)। আর দুনিয়াতে মুরতাদের শাস্তি হলো- তাকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। মুরতাদের এ শাস্তির বিষয়ে পুরো উম্মতের সুপ্রতিষ্ঠিত ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। (আত-তামহীদ : ৫/৩০৬)
দেশীয় আইনে তার অপরাধ ও শাস্তি
এটা তো গেলো দুনিয়ার শাস্তি, কিন্তু দেশীয় আইনে আবুল সরকার কী ধরনের অপরাধ করেছেন এবং তার কী শাস্তি হতে পারে, সে বিষয়ে আমরা কথা বলেছি চট্টগ্রামের এডিশনাল পিপি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীনের সাথে। তিনি বলেছেন, পবিত্র কোরআন ও হাদিস শরিফের অপব্যাখ্যা এবং আখেরাত নিয়ে তিনি (আবুল সরকার) স্পষ্ট কটূক্তি করেছেন।

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন
ডভোকেট মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ৪১, ১ ক- এখানে বলা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে যেকোনো ব্যক্তি যে কোনো ধর্ম পালন ও প্রচারের অধিকার রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, আমি নামাজ পড়ি, আমি নামাজ পড়তে পারব, অন্যজন হিন্দু ব্যক্তি বা অন্য ধর্মের লোক নিজেদের ধর্ম নির্দ্বিধায় পালন করতে পারবেন। কিন্তু ৫-১০ জন মিলে একটা ধর্ম তৈরি করল আর সেখানে নিয়ম করল ব্যভিচার করা জায়েজ তাহলে সেটা পারবে না। কারণ, আইনে আছে যে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে ধর্ম পালন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এরপর বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯,২, ক অনুসারে প্রত্যেকের বাকস্বাধীনতা থাকবে। কিন্তু বাকস্বাধীনতার নামে আমি আপনার পরিবার নিয়ে গালমন্দ করলাম সেখানে বাধা আছে। বাধাটা হলো- যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে ব্যক্তির বাকস্বাধীনতা। তো এই আবুল বয়াতি যা করেছে, সেগুলো এই সংবিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত।
এডভোকেট মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, কোনো মানুষ যদি অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, তাহলে সেটা ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫ ধারায় একটি কথা বলা আছে যে, কোনো ধর্মীয় উপাসনালয়; মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডাসহ আরো যা আছে সেগুলোর অসম্মান হয়- এমন কোনো কাজ আপনি করতে পারবেন না। এই ধারায় আরো বলা হয়েছে যে, কোনো ধর্মীয় ব্যক্তির ধর্মে আঘাত হয়- এমন কোনো কথা বলতে পারবেন না। আপনি যদি এমন করেন তাহলে দণ্ডবিধি ২৯৫ এবং ২৯৫,ক ধারা এর বিধানমতে ২ বছর কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে।
এই আইনজীবি আরো বলেন, এখন প্রশ্ন আসে যে আবুল বয়াতি আমাদের ধর্মকে অবমাননা করেছেন কিনা? তো যে ব্যক্তি আল্লাহকে মিথ্যাবাদী বলছেন এবং রাসূল সা: ও কোরআন-হাদিস নিয়ে জঘন্য বক্তব্য দিয়েছেন; তাহলে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে তো স্বাভাবিকভাবেই আঘাত লাগবে। তাই এসব ব্যক্তিদের শুধু ২ বছরের সাজা দিলে হবে না; বরং ইসলামী আইনে তাকে সাজা দিতে হবে, যা ব্লাসফেমি আইন। হাদিসে এসেছে- কেউ যদি নবীকে গালি দেয় তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দাও।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ ডভোকেট মোহাম্মদ নেজাম উদ্দীন বলেন, রাসূলের এই পবিত্র হাদিসের আলোকে আমি সরকারকে অনুরোধ করব যে, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে একটি আইন করা হোক এবং উলামায়ে কেরাম ও ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর নিকট আমার উদাত্ত আহ্বান থাকবে যে, তারা যেন এই নতুন আইন করার জন্য আন্দোলন করেন।



আপনার মতামত লিখুন :