ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার শেষ কোথায়?


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ১৯, ২০২২, ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ /
ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক জিঘাংসার শেষ কোথায়?
কাজল ঘোষ

নড়াইলের ঘটনায় ক’দিন ধরেই বুক ভারী হয়ে আছে। কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরানোর পরপরই ধর্মানুভূতির নামে সেখানে ফের সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষত- বিক্ষত নড়াইলের লোহাগড়া। এই নড়াইলের কথা মনে হলেই ভেসে ওঠে শিল্পী এস এম সুলতানের মুখচ্ছবি।

কিন্তু সাম্প্রতিক দুটি ঘটনায় সুলতানের নড়াইল কি বার্তা দিচ্ছে? অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে এলাকা প্রদক্ষিণ হয়েছে পুলিশের পাহারায়। ঘটনার দু’সপ্তাহ পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, সেদিন পরিস্থিতি এমন ছিল যে পুলিশের এ ছাড়া কিছু করণীয় ছিল না। তাহলে এই রাষ্ট্রের কার কাছে মানুষ নিরাপদ। পুলিশ যদি একজন শিক্ষকের নিরাপত্তা না দিতে পারে তাহলে কে দেবে? মানুষ কি তাহলে বিচার না পেয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেবে? নড়াইলে একজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেয়াকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে বাড়িঘরে হামলা, আগুন, লুটের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় এমপি ক্রিকেটার মাশরাফি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, এই ঘটনা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হবে। ক্রিকেটার মাশরাফি প্রচলিত রাজনীতিকদের মতোই কথা বলেছেন। ক্রিকেট দুনিয়া থেকে তিনি রাজনীতিকদের দুনিয়ায় হাতেখড়ি ভালোই নিয়েছেন তা বুঝতে কারও বাকি নেই।

যার ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে, যার সম্পদ লুটে নেয়া হয়েছে, যারা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে, যাদের রাতের ঘুম হারাম হয়েছে, নিজের বাড়ি রেখে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আতঙ্কে তারাই জানেন এটা কী ধরনের নিপীড়ন। আর একজন জনপ্রতিনিধি তার এলাকায় ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে বাত কি বাত টাইপ কথা বললেন। যা ঘটেছে তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালিয়েছে, আগুন দিয়েছে। আর তা করেছে ধর্মের নামে। তাদের গ্রেপ্তার করুন, বিচারের আওতায় নিন। সবার আগে এই হামলা ও নিপীড়নের বিচার করুন। সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, যার বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ার অভিযোগ তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কিন্তু যারা বাড়িঘরে হামলা চালালো, আগুন দিলো তাদের কি হলো? তার বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য আক্ষেপ করে লিখেছেন, গত সাত দশকে সংখ্যালঘুর ওপর যত হামলা হয়েছে, তার না হয়েছে কোনো তদন্ত, না হয়েছে কোনো বিচার, কোনো একটি হামলা নিয়ে না হয়েছে কোনো গবেষণা! কোনো বিচারপতিকে কখনো দেখলাম না সুয়োমটোর  জোরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা এলাকার পুলিশ প্রধান বা  জেলা প্রশাসককে তলব করতে! বিচার বিভাগ নাকি স্বাধীন!

আমরা জানিই না, হামলা  কেন হয়, কারা করে! কে এর পরিকল্পনা করে, কে ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব  নেয়, কতো খরচ হয় একেকটি হামলায়?
প্রতিটি হামলার কী প্রভাব পড়ে এলাকার জনবিন্যাসে? হামলায় সংখ্যালঘুদের কতোটুকু মনোবৈকল্য ঘটে? সম্পদের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়?
পঞ্চাশের দশকের হামলার যারা কুশীলব ছিলেন আমাদের এলাকায়, তারা শ্রদ্ধেয়-মান্যগণ্য ছিলেন! পুলিশ তখনো নীরব দর্শক ছিল, আজও আছে! তখনো লোকে বলেছে, সরকারি দলের উদ্যোগে-ইন্ধনে সংখ্যালঘুর ওপর হামলা হয়, এখনো বলে! সত্য না মিথ্যা কে জানে!

 

কিছুই কেউ জানে না! তথ্যের, গবেষণার এত ঘাটতি নিয়ে কীভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছা যাবে? কীভাবেই বা এই সমস্যার সমাধান হবে?
নড়াইলের ঘটনায় বারবার মনে হচ্ছিল, দেশটির স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর এসব কি দেখছি আমরা। স্বাধীনতার যে স্বপ্ন, যে আকাঙ্ক্ষা তা তো সাম্প্রদায়িক হামলার ভয়ে সন্তান সন্ততি নিয়ে নিজ ভিটে ছেড়ে পালিয়ে বেড়াবার জন্য নয়? দিন যায় মানুষ আগায়, সভ্য হয়, সুশাসন বাড়ে, অনিশ্চিত জীবনের আঁধার কেটে আলোর পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু আমার সোনার দেশে একটি বড় প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে আছে। যারা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় যত দিন যাচ্ছে ততই শক্তিশালী হচ্ছে। যারা ধর্মের নামে অপকর্ম করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। গত বছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুর জেলায় মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার ৯ মাস চলে গেছে এখনো তদন্ত শেষ হয়নি। এ চিত্র কিসের সাক্ষ্য দেয়। বিচারের নামে কালক্ষেপণ চলছে আর বিচার না হওয়ার দীর্ঘসূত্রতায় রাজনৈতিক মদতপুষ্ট সাম্প্রদায়িক মহলই শক্তিশালী হচ্ছে। তার ফসল কি ধারাবাহিকভাবে হামলা?

প্রকৃত ধার্মিক কখনো অন্যের সম্পদ লুট করে না, কারও ইজ্জত ও সম্ভ্রম নিয়ে খেলে না, কারও ঘরে আগুন দিতে পারে না। বিদায় হজের ভাষণে নবীজী স্পষ্ট বলেছেন,  ‘হে মানবজাতি, ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কেননা, অতীতের অনেক জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কারণে ধ্বংস হয়েছে।’ কে শোনে কার কথা। আমরা কি দেখছি বছরের পর বছর ধর্মানুভূতিতে আঘাতের নামে কতিপয় বিশৃঙ্খলাকারীরা টুপি, দাড়ির লেবাস নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটাচ্ছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এর জন্য পুরো সমাজ বা গোষ্ঠী দায়ী নয়। তবে ধর্ম একটি সর্বজনীন বিষয়। কাজেই ধর্ম নিয়ে যেকোনো ধরনের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া দেয়ার ক্ষেত্রে সকলের বিবেচনাবোধ তীব্র হওয়া দরকার। আর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখেই কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়াটা কোনো ধরনের সভ্য নাগরিকসুলভ কাজ নয়। ভাবতে হবে, বর্তমানে ডিজিটালি কারসাজি করেও স্বার্থান্বেষী মহল নানান উস্কানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টায় লিপ্ত। এর আগেও বেশ কয়েক জায়গায় স্ট্যাটাসের নামে যা ঘটছে তা ছিল অতিরঞ্জিত। ফেসবুকের একটি পোস্ট বা স্ট্যাটাস  দেখে এর সত্যতা যাচাই না করেই হামলা, ভাঙচুর, জ্বালাও, পোড়াও শুরু করে  দেয়া কতোটা যৌক্তিক? পোস্টটিতো একজনের হ্যাক হওয়া আইডি ও  ফেক আইডি থেকেও হতে পারে বা ভুলবশত আইডি খোলা থাকলে অন্য কেউ করতে পারে যা কিনা একটি কুচক্রী মহলের কাজ। তদন্তসাপেক্ষে সত্যতা যাচাই করে এরূপ  ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। অন্যথায় নিরীহ নিরপরাধী মানুষগুলোই বারবার অত্যাচারিত হবে, দুষ্কৃতকারীরা পার পেয়ে যাবে। আর যদি এ ধরনের স্ট্যাটাস যিনি দিয়েছেন তাকে শনাক্ত করা যায় তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সঙ্গত। নিজেরা লুটে নেমে যাওয়া, আগুন দেয়া, সম্পদ দখলের চেষ্টা কোনো সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে না।

কথায় আছে, ধর্ম যার যার, মানবতা সবার। কাজেই সকল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া বা শ্রদ্ধাশীল থাকা সকল মতের মানুষের নৈতিক দায়িত্ব। এক্ষেত্রে কোথাও বাড়াবাড়ি হলে দেশের প্রচলিত আইন রয়েছে। যেকোনো নাগরিক এর প্রতিকার চাইতে পারে। কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া কেন? এর নেপথ্যে রয়েছে বহুমুখী সুবিধা। যারা রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে এসব অপকর্ম করেও বহাল তবিয়তে টিকে আছে।

পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সরকারে যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল থাকে তখন একের পর এক এ ধরনের ঘটনা কীভাবে ঘটে? সবশেষ গত এক বছরে বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মীয় শিক্ষকরা হামলার শিকার হচ্ছেন, নাজেহাল হচ্ছেন, হত্যার শিকার পর্যন্ত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নড়াইল ও সাভারের ঘটনা আমলে নিলে আমরা কী দেখতে পাই। কোথাও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, কোথাও সরকারি দলের নেতাকর্মীদের পৃষ্ঠপোষকতা, কোথাও পরিকল্পিতভাবে নাজেহাল করা, কোথাও কিশোর গ্যাংয়ের হাতে শিক্ষকের জীবন দেয়া। এর কোথাও আইনি পদক্ষেপ জোরালো ছিল না। ঘটনা ঘটার অনেক পরে দেশের সবখানে প্রতিক্রিয়া হওয়ার পর প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রশাসনের শৈথিল্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

নড়াইলের ঘটনায় অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস যখন দোষীকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন তখন তাকেই উল্টো জুতার মালা পরিয়ে দিলো দুষ্ট চক্র। ওরা শুধু নড়াইলের স্বপন বিশ্বাসকে জুতার মালা পরায়নি ওরা আমার বাংলা মাকে জুতা পরিয়েছে। যারা এই অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত তাদের বেশির ভাগই সরকার সমর্থিত। অন্যদিকে মুন্সীগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল ক্লাসে পড়াতে গিয়ে জেলের ভাত খেলেন। ছাত্ররাই সেখানে বাইরের মহলের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলতে গেলে এন্তার বিতর্ক হয়ে থাকে। বিজ্ঞান, বিশ্বাস, যুক্তি নিয়ে কথা বলতে গেলে নানা প্রসঙ্গের অবতারণা হওয়াই স্বাভাবিক। তাই বলে তা রেকর্ড করে পুলিশে অভিযোগ দিয়ে শিক্ষককে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়ার অনন্য নজির দেখিয়েছে সেখানকার মহলবিশেষ। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থাকে, আদালত কীভাবে তড়িঘড়ি করে এ ধরনের মামলা আমলে নিয়ে যথাযথ তদন্ত না করেই শিক্ষককে কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। এসব চিত্র দেখে মাঝেমধ্যেই মনে হয় আমরা কি গ্যালিলিও যুগে ফিরে যাচ্ছি? যেখানে চার্চই সবকিছু। আমাদের এখানকার চিত্রও তো তাই হতে চলেছে মনে হয়।

বলা হচ্ছে, আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি। বিজ্ঞানের অবাধ জোয়ারে আমরা ভাসছি। জিন ভূতের আসর আমাদের মাথায় থেকে গেছে। কিন্তু না উল্টোটাই হতে চলেছে দেখছি। কথায় আছে, ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে। অর্থাৎ সত্য যতই চাপা থাকুক তার প্রকাশ ঘটেই থাকে। এখন তো দেখছি এর অন্য অর্থ তৈরি হয়ে যাচ্ছে, ধর্মের কল এখন কি ফেসবুকে নড়ছে? কারণ, কেউ কিছু একটা ফেসবুকে লিখে দিলো আর দুর্বৃত্তরা আগুন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এটা কি ধরনের বিপজ্জনক খেলা শুরু হয়ে গেল। ফেসবুক তো এমন কোনো ধর্মাবতার না যে তাতে ভুল কিছু হবে না। আর ফেসবুকের ভুলচুক লেখায় অথবা মতে আপনি পা দিচ্ছেন কেন? আপনি সচেতন নাগরিক হলে তা যাচাই করুন। যে লিখেছে তাকে চিহ্নিত করে আইনের হাতে দিন। আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোন্‌ ঈমানি দায়িত্ব পালন করছেন- একটিবার ভাববেন কি?

নড়াইলের এক মায়ের আত্মচিৎকার, কান্নার ভিডিও এখন সবখানে। এই ছবিটি দুনিয়ার কাছে আমাদের দেশ সম্পর্কে সঠিক বার্তা দেয় না। যারাই এ ধরনের ঘটনায় যুক্ত তারা দেশটিকে কোথায় নিয়ে যেতে চাইছেন এটি গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। মা- বোনদের এমন কান্না দেখার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। দিনের পর দিন সুযোগ পেলেই ওত পেতে থাকা ধর্মের লেবাসধারী ভণ্ডরা হামলে পড়বে তা হতে দেয়া যায় না। সংবিধান সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছে। আমি সংখ্যালঘু হিসেবে না, একজন নাগরিক হিসেবে সমঅধিকার নিয়ে সমানভাবে বাঁচতে চাই। আর একটিও নড়াইল চাই না, একটিও কুমিল্লা চাই না।

ফিরি ফেসবুকেই। একটি স্ট্যাটাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটি কার লেখা তা এখনো জানতে পারিনি। হিন্দু মরলে যে কাঁদে সে হিন্দু। মুসলমান মরলে যে কাঁদে সে মুসলিম। উভয় মরলে যে কাঁদে সে মানুষ।