দেশী বা বিদেশী সহযোগিতায় ৫০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় করলে উপকূলের কৃষিতে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে করেন কৃষি ও অর্থনীবিদরা। নারিকেল চাষে বদলে যেতে পারে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ উপকূলীয় ১১ জেলার মানুষের ভাগ্য। বদলানো যেতে পারে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা। কর্মসংস্থান হতে পারে বিপুল সংখ্যক মানুষের। উপকূলের বসতবাড়ি এবং আবাদযোগ্য পতিত প্রায় ১৮ লাখ হেক্টর জমিতে পরিকল্পিভাবে নারিকেল গাছ লাগানো এবং সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে বছরে আয় হতে পারে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা।
এজন্য দেশী বা বিদেশী সহযোগিতায় ৫০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় করলে উপকূলের কৃষিতে এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব বলে মনে করেন কৃষি ও অর্থনীবিদরা। বিদেশী কোনো জাত নয়, স্থানীয় জাতের নারিকেল চারা লাগালেই এই সফলতা আসবে বলে তারা জানান।
জানা যায়, নারিকেল উৎপাদনে বিশে^ বাংলাদেশের অবস্থান ২৮তম। প্রতি বছর দেশে ১০ কোটি নারিকেল উৎপাদন হয়। প্রায় ৪৬ হাজার ৮৯৯ হেক্টর জমিতে নারিকেল চাষ হয়। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় দুই হাজার ৫৬৪টি নারিকেল। অথচ প্রতিবেশী ভারতে উৎপাদন হচ্ছে এরচেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি, ১০ হাজার ৭৩৬টি। বিবিএস বলছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ জেলাগুলোতে প্রায় ১৮ লাখ হেক্টর আবাদযোগ্য পতিত জমি পড়ে আছে। উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৪২ লাখ কৃষি বসতবাড়ি রয়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই কমবেশি নারিকেল গাছ রয়েছে। তবে, প্রতিটি বাড়িতে আরো কমপক্ষে তিনটি করে নারিকেল গাছ লাগানো যাবে। সবমিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলের বসতবাড়ি ও পতিত জমিতে প্রায় ৩৫ কোটি নারিকেল গাছ লাগানো সম্ভব।
কৃষি ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বর্তমানে যে ১০ কোটি নারিকেল পাওয়া যাচ্ছে, নতুন গাছ লাগাতে পারলে পাঁচ বছর পর বছরে প্রতি গাছে হেক্টর প্রতি ১৭০টি ধরলে দুই হাজার ৫০০ কোটি নারিকেল উৎপন্ন হবে। প্রতিটি ডাব গড়ে ৬০ টাকা হিসাব করলে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সম্ভব। নারিকেল চারা রোপণের পর দীর্ঘ প্রায় ৫০-৬০ বছর নিয়মিত ফল ধরে থাকে। এ ছাড়া, ডাব না খেয়ে নারিকেল থেকে ছোবরা দিয়ে নানা ধরনের পণ্য উৎপাদন হয়। এসব থেকে আরো বেশি লাভবান হতে পারবেন কৃষক।
জানা যায়, বিগত ১৯৬৫ সাল হতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় ছোট বড় মিলে মোট ১৫ বার প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের চরম প্রতিকূল প্রভাবে পর্যাপ্ত জানমাল বিনষ্ট হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় লবণাক্ত ও ঘূর্ণিঝড় প্রবণ জেলাগুলোর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আবাদযোগ্য পতিত জমিতে একমাত্র নারিকেল চাষ সম্প্রসারণই সবচেয়ে উপযোগী সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে নারিকেলের মতো লবণাক্ততা সহনশীল বৃক্ষ আর নেই বলা যায়। এটির ব্যাপক সম্প্রসারণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং নারিকেলের ব্যবহার বহুমুখীকরণের মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন আনা যেতে পারে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) নারিকেল চাষ সম্প্রসারণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প নিতে পারে। সরকারি বা বিদেশী অর্থায়নে ৫০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় করলেই উপকূলীয় অঞ্চলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে কথা হয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রকল্প বাস্তবায়ন) ড. মো: শাখাওয়াত হোসেন শরীফের সাথে। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, নারিকেল গাছ লাগানোর মাধ্যমে উপকূলের পরিবেশ, প্রতিবেশ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জানমালের নিরাপত্তাসহ সামগ্রিকভাবেই এই অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হতে পারে। নারিকেল গাছ পরিবেশ ও প্রতিবেশ, সাইক্লোন বেল্ট হিসেবে কাজ করবে। এটা দক্ষিণবঙ্গের জন্য অর্থনৈতিক আশার আলো হতে পারে।
তিনি বলেন, দেশে বছরে ভোজ্যতেল আমদানির পেছনে ব্যয় হয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। এই ব্যয় নারিকেল তেলের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব। এতে আমদানি ব্যয় হ্রাস সম্ভব। তার মতে, উপকূলে মোট জনশক্তির ৪০ শতাংশ আছে কৃষির সাথে জড়িত। নারিকেল গাছ লাগানোর মাধ্যমে আরো ২০ শতাংশ কর্মক্ষম জনশক্তি কৃষিতে সম্পৃক্ত করা সম্ভব।
কৃষি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি নারিকেল সম্প্রসারণ নিয়ে ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে তাহলে এর অর্জন হবে বহুগুণ। এই বাজেটের বড় খরচ যাবে আন্তর্জানিক কোকোনাট কমিউনিটির সদস্য পদ লাভ; কৃষক প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শন স্থাপন এবং বিদ্যমান বাগান পরিচর্যা ও নতুন জার্মপ্লাজম সংগ্রহে। এ ছাড়া, মাশরুম সেন্টারের মতো কক্সবাজারের রামুতে একটি নারিকেল উন্নয়ন ইনস্টিটিউট স্থাপন করা যেতে পারে। সেখানে ডিএইর হর্টিকালচার সেন্টার আছে। যেখানে প্রায় দেড় শ’ একর জমি আছে। নারিকেল গাছ আছে প্রায় চার হাজার।
একজন কৃষি বিজ্ঞানী জানান, নারিকেল গাছের চারা লাগানোর চার বছর পর ফলন ধরবে। তার আগে উপকূলীয় এলাকায় যে পরিমাণ নারিকেল গাছ আছে; উৎপাদন ও সার ব্যবস্থাপনা এবং আন্তঃপরিচর্যা পরিবর্তনের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ২৫০০ পিস থেকে দ্বিগুণ পেতে পারি। গাছের বয়স অনুযায়ী সার প্রদান, রোগাক্রান্ত মাইক এবং সাদামাছি প্রতিরোধে স্প্রেসহ সঠিক পরিচর্চা করতে হবে।
উপকারিতা : নারিকেল বিশেষ কিছু ভাইরাস ধ্বংস করে। যেসব ভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, হার্পিস, মামস ইত্যাদি রোগ জন্ম দেয়, নারিকেল সেসব ভাইরাসগুলোকে নষ্ট করে ফেলে। আলসার, গলার ইনফেকশন, ইফরিন ইনফেকশন, মাড়ির রোগ, গনোরিয়া ইত্যাদি রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করতেও নারিকেলের ভূমিকা অপরিসীম; শরীরের শক্তি বাড়িয়ে দেয় এবং কর্মোদ্দীপনা জাগাতে সহায়তা করে; হজমপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করে এবং বিভিন্ন ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যামাইনো এসিড শোষণ করে নিতে সহায়তা করে; রক্তের ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ডায়াবেটিসজনিত কারণে শরীরের ক্ষতি রোধ করে; শরীরে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম গ্রহণে সহায়তা করে এবং দাঁত ও হাড়ের গঠনে ভূমিকা রাখে।
নিয়মিত নারিকেল খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার ও অন্যান্য আরো কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে যায়। নারিকেল দাঁতের ক্ষয় রোধে সহায়তা করে; থাইরয়েড হরমোনের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে; নিয়মিত নারিকেল খেলে ত্বক কোমল ও সুন্দর হয়। এ ছাড়াও নিয়মিত নারিকেল খেলে ত্বকে সহজে বয়সজনিত বলিরেখা পড়ে না। নারিকেল অতিরিক্ত ওজন কমাতে সহায়তা করে। নারিকেল দিয়ে তেল, নারিকেল পুডি, ঘি, নারিকেলের দুধ, ক্রিম, নারিকলের ছোবলা দিয়ে দড়ি, চট থেকে শুরু করে নানা কিছু উপন্ন হয়।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মহাপরিচালক মো: ছাইফুল আলমকে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে অধিফতরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো: আসাদুল্লাহ বলেন, উপকূলীয় এলাকা বলতে পারেন সাতক্ষীরা থেকে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত উপকূলের ১১ জেলা নারিকেল চাষের সবচেয়ে উপযোগী। এসব এলাকায় পরিকল্পিতভাবে নারিকেল চাষ করতে পারলে আমরা বড় ধরনের বেনিফিট পাবো।
আপনার মতামত লিখুন :