বাদাম বিক্রেতা এখন শত কোটি টাকার মালিক?


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ২৭, ২০২২, ৬:২১ অপরাহ্ণ /
বাদাম বিক্রেতা এখন শত কোটি টাকার মালিক?

শ্রীনগরের বাসিন্দা আজিজুল ইসলামের জন্ম দরিদ্র কৃষক পরিবারে। অভাবের সংসারে না খেয়েই দিন কাটতো। ক্ষুধার জ্বালায় শুরু করেন বাদাম বিক্রি। কিছুদিন আইসক্রিমও বিক্রি করেছেন। অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের খরচ চালাতেন। কিন্তু সিনেমার কাহিনীর মতো হঠাৎ তার জীবনের দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। সবকিছু যেন রাতারাতি বদলাতে থাকে। কয়েক বছরের ভেতরে আমদানি ব্যবসা থেকে শুরু করে, বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট-প্লট, আওয়ামী লীগের পদ-পদবি সবই হয়েছে। বাদাম বিক্রেতা থেকে হয়ে যান শ্রীনগরের অধিপতি।

শ’ শ’ কোটি টাকার মালিক এই ব্যক্তি বাগিয়ে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের পদবি। জমি দখল, অস্ত্র প্রদর্শন, অবৈধভাবে আমদানি ব্যবসা, মাদক ব্যবসাসহ সবই করতেন। তবে গত শনিবার যেন তার ত্রাসের রাজত্বে আঘাত হানে র‌্যাব। বের হয়ে আসে থলের বেড়াল। প্রকাশ হয় তার অন্ধকার জগতের নানা কাহিনী।

সেই অন্ধকার জগতের নায়কের নাম আজিজুল ইসলাম। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক ও শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। আওয়ামী লীগের টিকিটে ষোলঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন দ্বিতীয় মেয়াদে।

শনিবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-১১ নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে দুই কন্টেইনার ভর্তি শুল্ক ফাঁকি দেয়া ৩৭ হাজার বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করে। এ সময় র‌্যাব ঘটনাস্থল থেকে নাজমুল ও সাইফুল নামের দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে তারা জানতে পারেন এই চালানটি আজিুজল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির কাছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর ইউনিয়নের যাওয়ার কথা ছিল।

আজিজুলের পক্ষ থেকে তার ছেলে আব্দুল আহাদ ও আশিক শ্রীনগরের একটি ওয়ারহাউজে চালানটি রিসিভ করবে। তাদের এই তথ্যমতে র‌্যাব সদস্যরা ওয়ারহাউজে যান। কিন্তু সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। সেখান থেকে জানা যায় ঢাকার ওয়ারীতে তাদের একটি ১২ তলা বাড়ি আছে। ওই বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি।

তবে সেখানে তল্লাশি চালিয়ে কোটি টাকার ওপরে দেশি-বিদেশি মুদ্রা পায় র‌্যাব। রাতভর পিতা-পুত্র ৩ জনকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালায় র‌্যাব। পরে গতকাল ঢাকা বিমানবন্দর থেকে আজিজুলের ছেলে আহাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। আহাদের তথ্যমতে ঘটনা জানাজানির পর তার বাবা আজিজুল ও ভাই দুবাই পালিয়ে গেছেন।

এদিকে ঘটনার দিন গত শনিবার দুপুরে ষোলঘর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় ছিলেন আজিজুল ইসলাম। সেখানে থাকা অবস্থায় তার কাছে সেই খবর চলে আসে। তাই তিনি ওই সভা থেকে তড়িঘড়ি করে চলে যান। এরপরেই খবর আসে দুই কন্টেইনার মদ উদ্ধারের বিষয়টি। তারপর থেকে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে অনেকেই তার দিকে ইঙ্গিত করে নানা রকম স্ট্যাটাস দিতে থাকেন।

তবে গতকাল র‌্যাবের আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের পরে আজিজুল ও তার ছেলেদের অন্ধকার জগতের বিষয়টি খোলাসা হয়ে যায়। ভদ্র, ব্যবসায়ী ও দানবীরের আড়ালে এমন স্মাগলিংয়ের ঘটনা শুনে এলাকার অনেকেরই চোখ ছানাবড়া। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে না চাইলেও বিষয়টি এখন পরিষ্কার। এলাকার সর্বমহলে এখন তোলপাড় চলছে।

গতকাল সরজমিন শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর এলাকায় গিয়ে কথা হয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে। তারা জানান, ষোলঘর-বীরতারা রাস্তার পাশে প্রায় ১ একর জমির উপর আজিজুলের একটি ওয়্যারহাউজ আছে। রাত গভীর হলে সেখানে বড় বড় কভার্ডভ্যান আসে। হাজার হাজার কার্টন পণ্য লোড-আনলোড করা হয়। এর আড়ালে কী আনা হতো কেউ জানতো না।

স্থানীয়রা আরও জানিয়েছেন, আজিজুল ইসলাম দান-দক্ষিণায় পুরোদস্তর ভালো মানুষ। কথায় কথায় স্মৃতিচারণ করেন এক সময়ে তার দুরাবস্থার কথা। প্রায়ই বলতেন এক সময় তিনি অভাবেব তাড়নায় বিক্রি করেছেন বাদাম, আইসক্রিম। এতটাকার মালিক হাওয়ার পরও তিনি এসব প্রকাশ্যে বলার কারণে অনেকে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। ভাল মানুষের সার্টিফিকেট দেন নির্দ্বিধায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজিজুল ইসলামের বাবার নাম আকুব আলী। দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান আজিজুল ৪ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়। ঢাকার বংশালের একটি রিকশা পার্টসের দোকানে চাকরিও করেন। সেখান থেকে হঠাৎ উত্থান। কয়েক বছরের ব্যবধানে নিজে দোকান দিয়ে শুরু করেন একই ব্যবসা।

এছাড়া টিভি আমদানির ব্যবসাও আছে তার। এই ব্যবসার আড়ালেই তিনি অন্ধকার রাজ্যে পদচারণা শুরু করেন। মাদক চোরাচালান করে রাতারাতি সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন। শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে রয়েছে কোটি কোটি টাকা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রায় ১ দশক আগে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপি সুকুমার রঞ্জন ঘোষের হাত ধরে শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ পেয়ে যান আজিজুল। পরে ষোলঘর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। নির্বাচনে জয়ী হয়েই ত্যাগী নেতাদের কোনঠাসা করে পেটোয়া বাহিনী নিয়ে গড়ে তোলেন নিজস্ব বলয়। চেয়ারম্যান হয়ে চীন থেকে অটোরিকশার ব্যাটারি আমদানির সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম পণ্য আমদানি শুরু করেন।

অবৈধ ঘোষণায় সিগারেট আমদানি করতে গিয়ে পানগাঁও বন্দরে ধরাও পড়েন। টাকার ঝনঝনানি দেখিয়ে তটস্থ করে রাখেন শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগসহ মুন্সীগঞ্জ জেলার আওয়ামী লীগের অনেক শীর্ষ নেতাদের। ২০২১ সালের নভেম্বরের ১১ তারিখের নির্বাচনেও তিনি একই ইউনিয়ন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সহ-সম্পাদকের পদ পান।

ঘোষণা দেন শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। কোনো উপলক্ষ পেলেই শ্রীনগরের সর্বত্র আজিজুল ইসলামের ব্যানার ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে যেতো। নিজে যাতে সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নিতে পারেন এজন্য অন্যান্য ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে অর্থ ব্যয় করে প্রথম সারির পদ কিনে নিজের পছন্দের লোকজনকে বসাতেন।

স্থানীয়রা আরও জানান, আজিজুল চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন একাধিকবার তার দখল উচ্ছেদ করে দিলেও তিনি কাউকে তোয়াক্কা না করে তা নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছেন। এক্সপ্রেসওয়ের জমিও দখল করেছেন। তার প্রভাবে ভাইসহ পেটোয়া বাহিনীর অনেকেই বেপরোয়া আচরণ করতো। প্রকাশ্যে শর্টগান প্রদর্শনের বিষয় ছিল পান্তা ভাতের মতো।

স্থানীয়রা আরও জানায়, উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ১টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েও ১০ বছর ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগ, প্রশাসনসহ সবকিছু ছিল তার নখের ডগায়। রাতারাতি সম্পদের পাহাড় তৈরির কারণে দুদক তাকে ২৭শে জুন তাদের কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল।

র‌্যাব জানিয়েছে, দুবাই থেকে আজিজুল অবৈধ মদ দেশে এনে ঢাকার বিভিন্ন বার, হোটেল ও ক্লাবে সরবারহ করতেন। দুই ছেলেসহ আজিজুল একাধিকবার দুবাই যাতায়াত করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি নিজেই অন্তত ১২বার দুবাই যাতায়াত করেছেন। দুবাই থেকে নাসির নামে একজন তাদেরকে এই মদের ব্যবসায় সহযোগিতা করেন। এর আগেও তারা চলতি বছরে তিনবার মদের চালান নিয়ে এসেছেন। সিএন্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে তারা কৌশলে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চালান ছাড়িয়ে আনে। এক্ষেত্রে কাস্টমসকে জানানো হয় গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করা হয়েছে।

ওদিকে, মদের ব্যবসার কথা জানাজানির পর আজিজুল ইসলামকে নিয়ে শ্রীনগরে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও লেখালেখি হচ্ছে। একারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সোমবার বেলা ১১টার দিকে আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে এলাকার ষোলঘরে মিছিল হয়েছে। মিছিলকারীরা আজিজুল ইসলামকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানান।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মিনহাজ উদ্দিন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, আজিজুল ইসলাম আওয়ামী লীগের নাম ব্যবহার করে অবৈধ টাকা ছড়িয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে যাচ্ছিল। তার মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, সে এখন বাংলাদেশের বড় গডফাদার। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে জোর দাবি করছি তাকে বহিষ্কার করে আইনের আওতায় আনা হোক।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মামুন বলেন, আমি শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে লজ্জিত। যুগ্ম সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, আমরা খুবই বিব্রত। বিষয়টির সঙ্গে দলীয় ইমেজ জড়িত। সে হুট করে এসে উপজেলা আওয়ামী লীগে উপদেষ্টার পদ নেয়। ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সহ সম্পাদকও হয়েছেন। কীভাবে এই পদ পেয়েছেন তা খতিয়ে দেখা উচিত।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ- সভাপতি ও পাটাভোগ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ডালু বলেন, এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীরজিরো টলারেন্স রয়েছে। তারপরও বিষয়টি নিয়ে নানা রকম কথা হচ্ছে। আমরা বাজারে যেতে পারছি না। উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আলহাজ সেলিম আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, এখানে লুকানোর কিছু নাই। আমরা চরম ভাবে বিব্রত। জেলা আওয়ামী লীগ তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবে।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আজিজুলকে নিয়ে বিব্রত তো হচ্ছিই। উপজেলার উপদেষ্টার বাইরে তার ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির একটি পদ আছে। তাই জেলা ও কেন্দ্র তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি সুকুমার রঞ্জন ঘোষ অসুস্থ থাকায় এলাকায় যান না প্রায় ৪ বছর। এ কারণে আজিজুলের বিষয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

শ্রীনগর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা মিলে সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফোরাম গঠন করেন। আজিজুল ইসলাম সংগঠনটির যুগ্ম আহ্বায়ক। চেয়ারম্যান ফোরামের আহ্বায়ক রাঢ়িখাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক খান বারী বলেন, আজিজুলকে নিয়ে আমরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। আগামী সভায় তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।