বিশ্ব অর্থনীত গভীর সংকটে!


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ২, ২০২২, ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ /
বিশ্ব অর্থনীত গভীর সংকটে!

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিয়েছে ঊর্ধ্বগতির মূল্যস্ফীতি। করোনা অতিমারির ধকল কাটতে না কাটতে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এ মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে উদ্বেগের খবর আসছে। খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসিপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় দিশেহারা হচ্ছেন ভোক্তারা।

এশিয়াসহ প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে উৎপাদন কমে আসছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারের ওপর ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারীরা। দেশে দেশে শেয়ারবাজারগুলোতে পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারগুলোতে দরপতনের হার গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির যে ঢেউ সেটি থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। ইতিমধ্যে মুল্যস্ফতির লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যও কমানো হয়েছে।

ইতিহাস হতে চলেছে কম সুদের হার

বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিনটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, নিম্ন মূল্যস্ফীতি এবং সুদের হার কমিয়ে রাখার বিষয়টি ইতিহাস হতে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের শীর্ষ নির্বাহীরা পর্তুগালে বৈঠক করে বলেছেন, পণ্যের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সে লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং করোনা অতিমারির কারণে অর্থনীতির মন্দা কতদূর যেতে পারে—এমন প্রশ্নের জবাবে তারা একমত হয়েছেন যে, এখন ঝুঁকিটা বড় মনে হচ্ছে।

কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এ ঝুঁকি সামলিয়ে ওঠাও কঠিন নয়। কিন্তু বড় যে ভুল বিশ্বনেতারা করেছেন তা হলো—পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে না রাখা। উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডও সুদের হার এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সোয়া শতাংশ করেছে। অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, বিভিন্ন দেশ যেভাবে সুদের হার বাড়িয়েছে তা আরো কয়েক বছর অব্যাহত থাকবে। খুব শিগগিরই সুদের হার কমার কোনো লক্ষণ নেই।

বিশ্ব পুঁজিবাজারে পতন

উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে এ আশঙ্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে পতন হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ৫০ বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের এসএন্ডপি (স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর) সূচকের সবচেয়ে বড় পড়ন হয়েছে। উল্লেখ্য, লেনদেন হওয়া শীর্ষ ৫০টি কোম্পানির সমন্বয়ে এসএন্ডপি গঠন করা হয়েছে। গত ছয় মাসে এসঅ্যান্ডপি সূচক ২০ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এছাড়া দেশটির পুঁজিবাজারের অন্যান্য সূচকেরও পতন হয়েছে। নাসডাক, দাও জোনসের শেয়ারের দামও ক্রমাগতভাবে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়ার দেশগুলোর শেয়ারবাজারেরও পতন হচ্ছে।

যুক্তরাজ্যে এফটিএসই-২৫০ সূচকে এ বছর ২০ শতাংশ পতন হয়েছে। ইউরোপের স্টকস-৬০০ সূচকেরও ১৭ শতাংশ পতন হয়েছে। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ারর দামও পড়েছে ১৮ শতাংশ। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জনগণের জীবনধারণের খরচ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে মরিয়াভাবে কাজ করছে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানির ব্যয় যাতে নাগালের মধ্যে থাকে সে চিন্তা তাদের কাছে এখন বড় আকারে দেখা দিয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু সুদের হার ক্রমাগত বাড়ানোর কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। শীর্ষ চীনা অর্থনীতিবিদ ড্রান ওয়াং বিবিসিকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে মন্দার হারও বাড়বে।

চীনা সরবরাহ ব্যবস্হা: বড় নিয়ামক

চীনে করোনার কারণে লকডাউনে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। এছাড়া লকডাউনে সরবরাহ বিঘ্নিত ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীর হওয়ায় ইউরোপসহ সারা বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। আলজাজিরা জানিয়েছে, চলতি বছরের জুনে এশিয়ার উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। মূলত চীনের করোনা সম্পর্কিত লকডাউনে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়। এদিকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীর হওয়ায় সারা বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে। সরবরাহ ঘাটতি ও মূল্য বৃদ্ধির কারণে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার ও তাইওয়ানের উত্পাদন কার্যক্রমে প্রভাব পড়েছে।

জাপানের দাই ইচি লাইফ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়োশিকি শিনকে বলেন, কিছু দুর্বলতার পর চীনের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে বলে আশা করা যায়। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা অনিশ্চয়তার কারণে মন্দা মোকাবিলা করা ততটা সহজ হবে না। পৃথিবীব্যাপী কারখানাগুলোতে চীনা কাঁচামাল ব্যবহার করা হয় ব্যাপক হারে। চলতি বছরের অধিকাংশ সময় দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে কঠোর লকডাউন থাকার কারণে সেখানকার কারখানাগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকে। এতে বিভিন্ন দেশের কারখানার উৎপাদনে টান পড়ে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও পুরাপুরি উৎপাদনে ফেরেনি কারখানাগুলো। এতে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্হায় বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে।

জাতিসংঘ যা বলেছে

জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা আংটাড বলেছে, যে মন্দা চলছে তাতে বিশ্ব অর্থনীতিতে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগে তা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। সংস্থাটির মতে, এ মন্দা রাশিয়াতে দীর্ঘমেয়াদি রূপ নেবে। পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো এবং দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এ মন্দার হাওয়া থেকে বাদ যাবে না। মন্দার এ অবস্থার মধ্যে দেশগুলো তাদের উন্নয়ন ব্যয় কমাতে বাধ্য হবে। ভৌগোলিক এ সমস্যা বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে উসকে দিতে পারে।

খাদ্য এবং জ্বালানির মূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইতিমধ্যে নানা সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। খাবার এবং জ্বালানির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ায় এসব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশগুলোর বাণিজ্য ঘাটতি যেমন বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ এবং সুদ পরিশোধেও বেগ পতে হবে তাদের।

বাংলাদেশ যা করছে

বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও কিছু ব্যবস্হা নিয়েছে। সম্প্রতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা করা হয়েছে । বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবা?হের লক্ষ্যও ক?মি?য়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।

তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু উপকরণ ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো করণীয় নেই। যে কয়েকটি উপকরণ রয়েছে, তার অন্যতম প্রধান হলো টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে কম হারে ঋণ দেওয়া। এ জন্য আগামী অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা থেকে কমিয়ে আনা হয়েছে।