যশোরে ২৪ হাজার হেক্টর জমির পাট পচানো নিয়ে দুশ্চিন্তা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ২৭, ২০২২, ৮:১৪ অপরাহ্ণ /
যশোরে ২৪ হাজার হেক্টর জমির পাট পচানো নিয়ে দুশ্চিন্তা

রিবন রেটিংয়ে আগ্রহ নেই চাষিদেরযশোরে পানির অভাবে পাট পচাতে না পারলেও রিবন রেটিংয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না চাষিরা। তাদের বক্তব্য, এই পদ্ধতিতে পাট পচাতে খরচ বেশি হয়। পাশাপাশি পাটের রঙ ঠিক না থাকায় আশানুরূপ দাম পাওয়া যায় না বলে পাটচাষিদের দাবি। এই অবস্থায় জেলার ২৪ হাজার ৮শ’৮০ হেক্টর জমিতে লাগানো পাট পচানো নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন প্রায় ৯০ হাজার কৃষক। চাহিদা মতো বৃষ্টি না হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

রিবন রেটিং কী
পানির অভাবে যেসব এলাকায় উৎপাদিত পাট পচানো সমস্যা হয় সেখানকার জন্য রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। ইনস্টিটিউটের দাবি অনুযায়ী, পাটের ছাল পচানোর জন্য পানি, জায়গা ও সময় কম লাগে, আঁশে কাটিংস হয় না, আঁশের মান ভালো হয়, এ গ্রেডের আঁশ পাওয়া যায়, মূল্যও বেশি পাওয়া যায়, পরিবহন খরচ কম লাগে, স্বাস্থ্যকর ও পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থা, পদ্ধতিটি অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক, পাট খড়ি শক্ত থাকে বলে জ্বালানি ও বিভিন্ন কাজে ব্যবহারে টেকসই এবং সুবিধাজনক।

রিবন রেটিং যেভাবে করা হয়
বাঁশের হুকের দীর্ঘস্থায়ী লোহার সিঙ্গেল রিবনার এবং ডবল রোলার রিবনারের মাধ্যমে ছালকরণ যন্ত্র বা রিবনারের সাহায্যে সহজেই কাঁচা পাট গাছ থেকে ছাল ছাড়ানো যায়। সেক্ষেত্রে প্রথমে ছয় ফুট লম্বা এক খণ্ড বরাক বাঁশ নিয়ে এর যে কোনো এক প্রান্ত আড়াআড়িভাবে কাটতে হবে, যেন বাঁশের প্রান্তটির দু’দিক ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মতো দেখায়। বাঁশ খন্ডটির গোড়ার কিছু অংশ প্রায় এক ফুট মাটির মধ্যে শক্ত করে পুঁতে দিতে হবে। পাশাপশি ৩ থেকে ৪ ফুট দূরে প্রয়োজনমতো বেশ কয়েকটি বাঁশের হুক স্থাপন করা যায়। সেই বাঁশের হুকগুলোর সাথে আরেকটি বাঁশ দিয়ে আড়াআড়িভাবে আড়া হিসেবে বাঁধতে হবে, যার উপরে পাট গাছ জমি থেকে কেটে এনে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়। ১০০-১১০ দিন বয়সের পাট কাটতে হবে।

পাট গাছগুলো বাঁশের আড়ার উপরে দাঁড় করানোর আগে পাতা ঝরিয়ে গাছের গোড়ার ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি অংশ একটি শক্ত কাঠের হাতুড়ির সাহায্যে থেতলে নিতে হবে। প্রতিটি গাছের গোড়ার থেতলানো ছালগুলো হাত দিয়ে দু’ভাগ করে পাট গাছের গোড়া হুকের মধ্যে রাখতে হবে। গোড়ার ছালের দু’ভাগ পৃথকভাবে দু’হাত ধরে একসাথে জোরে টান দিলে দেখা যাবে পাটের ছালগুলো সহজেই খড়ি থেকে আলাদা হয়ে গেছে এবং পাটখড়ি সামনের দিকে চলে গেছে। এভাবে ৪ থেকে ৫টি পাট গাছের ছাল একসাথে বের করা সম্ভব। একইভাবে সিঙ্গেল রোলার ও ডাবল রোলার রিবনারের সাহায্যেও পাটের রিবনিং করা যায়। বড় মাটির চাড়িতে ছালগুলোকে গোলাকার মোড়া বেঁধে সাজিয়ে রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে চাড়িটি ভরে দিতে হবে।

একটি বড় চাড়িতে প্রায় ৩০ কেজি ছাল পচানো যায়। আশেপাশে যদি ছোট ডোবা, পুকুর, খাল বা কম গভীরতা সম্পন্ন জলাশয় থাকে তাহলে ছালগুলোকে গোলাকার মোড়া বেঁধে একটা লম্বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে পানির মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে পচানো যাবে। একবিঘা জমির পাটের ছাল পচানোর জন্য ১৮ ফুট লম্বা, ৬ ফুট প্রস্থ এবং ৩ ফুট গভীর গর্তের প্রয়োজন হয়। ওই গর্তে আট থেকে সাড়ে আট হাজার লিটার পানির প্রয়োজন হয়। মোটা পলিথিন দিয়ে গর্তের তলা ও কিনারা ঢেকে দিতে হবে। তারপর গর্তে প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে বাঁধা ছাল ফেলতে হবে। সম্ভব হলে কচুরিপানা দিয়ে ছালের মোড়াগুলো ঢেকে দিতে হবে।

এক কেজি কাচা ছাল পচানোর জন্য আড়াই থেকে তিন লিটার পানির প্রয়োজন হয়। প্রতি এক মেট্রিকটন কাঁচা ছালের জন্য ১শ’ গ্রাম ইউরিয়া সার বা ২০ থেকে ৪০ লিটার পাট পচন পানি গর্তের পানির সাথে মিশিয়ে দিলে পচন ত্বরান্বিত হয়। ছাল পানিতে ডুবানোর ১০ থেকে ১২ দিন পর দু’একটা ছাল পানি থেকে তুলে ভালো করে ধুয়ে দেখতে হবে যদি আঁশগুলো ভালোভাবে পৃথক হয়েছে বলে মনে হয় তাহলে দেরি না করে পরিষ্কার পানিতে ছাল ধুয়ে আঁশ সংগ্রহ করতে হবে। পরিষ্কার ছাল রোদে শুকাতে হবে। আর্দ্রতা যেন ৮ থেকে ১০ ভাগের বেশি না থাকে।

যশোরে রিবন রেটিংয়ের অবস্থা
যশোরে এক কোটি ৫৬ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়ার পরও পাটের আঁশ ছাড়ানোর রিবন রেটিং পদ্ধতি তেমন কোনো কাজে আসছে না। এ কারণে এক হাজার ৫শ’৩০টি আঁশ ছাড়ানোর যন্ত্র কৃষি বিভাগের বিভিন্ন কার্যালয়ে পড়ে নষ্ট হয়েছে। খরচ বেশি হওয়ার কারণে চাষি এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে আগ্রহী না বলে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

কৃষি বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে জানাগেছে, ২০১০ সালে যশোরের পাটচাষিদের জন্য ৮শ’ এবং ২০১১ সালে ৭শ’৩০টি পাটের আঁশ ছাড়ানোর যন্ত্র (রিবনার মেশিন) সরবরাহ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। ওইসময় জেলার ৭৮ হাজার কৃষককে ২শ’ টাকা করে দু’ বছরে মোট এক কোটি ৫৬ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। তখন প্রশিক্ষণও দেয়া হয় কৃষকদের। তারপরও রিবন রেটিং পদ্ধতি আলোর মুখ দেখেনি। কারণ হিসেবে চাষিরা জানিয়েছেন, এ পদ্ধতিতে পাটের আঁশ পচাতে অতিরিক্ত ১২-১৫ জন শ্রমিক লাগে। বাড়তি খরচ হয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ভর্তুকির টাকা দেয়ার পর দু’ বছর অনেকে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচান। কিন্তু বর্তমানে কৃষকের সামনে এ পদ্ধতির কথা বলাই যাচ্ছে না।

চাষিরা বলছেন, রিবন রেটিং পদ্ধতিতে আঁশ ছাড়ানোর পর পাটকাঠি কাজে লাগানো যায় না। সাইফুল ইসলাম নামে একজন চাষি বলেন, রিবন রেটিং মেশিন দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে পাট পচানো ঝামেলার কাজ। পাটের বীজ বপন থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়িয়ে ঘরে তোলা পর্যন্ত সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে ১৮ থেকে ২০ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে ৩০ থেকে ৩২ জন প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতিতে এক বিঘায় ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়, আর সনাতন পদ্ধতিতে খরচ হয় মাত্র ১১-১২ হাজার টাকা।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, চাষি রিবন রেটিংয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তারা সনাতনী পদ্ধতিতে পাট পচাতে আগ্রহী। গত বছর পাটের দাম বেশি হওয়ায় এ বছর পাট চাষ বেশি হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এখনো সময় রয়েছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এভাবে যদি আগামী ১০-১৫ দিন হয় তাহলে পাট পচাতে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। আর বৃষ্টি না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন চাষি। এ বছর যশোর জেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার ৩শ’ হেক্টর। আর চাষ হয়েছে ২৪ হাজার ৮শ’৮০ হেক্টর জমিতে।