‘রাষ্ট্রের নাম বদলেছে চরিত্র বদলায়নি’-নাগরিক প্রতিবাদ মঞ্চ


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ২৫, ২০২২, ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ /
‘রাষ্ট্রের নাম বদলেছে চরিত্র বদলায়নি’-নাগরিক প্রতিবাদ মঞ্চ

সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় নাগরিক প্রতিবাদ মঞ্চ থেকে বক্তারা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। রাষ্ট্রের নাম বদলালেও চরিত্র বদলায়নি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দেশে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রাষ্ট্রের এ পরিস্থিতি বদলাতে আমাদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক, সংস্কৃতিবান নাগরিককে ঘুরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে, সর্বদলীয় সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয় এ মঞ্চ থেকে।

গতকাল রবিবার ব্র্যাক সেন্টারে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরমের আয়োজনে ‘সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক সহিংসতা :নাগরিক প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক একটি সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় এতে সভাপতিত্ব করেন পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের ওপর যে সহিংসতামূলক হামলা করা হয়েছে তার প্রতিবাদ জানিয়ে আক্রান্ত সংখ্যালঘুদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং এর থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করা এই নাগরিক প্রতিবাদ সভার অন্যতম উদ্দেশ্য।

ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দেশের সাম্প্রদায়িকতার চরিত্রটা রাজনৈতিক। এর সঙ্গে রাষ্ট্র যুক্ত। রাষ্ট্রের প্রশ্রয় রয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকে রাষ্ট্রের নাম বদলেছে, সীমানা ছোট হয়েছে কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। মুক্তিযুদ্ধে আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলাম। যেখানে সব নাগরিকের অধিকার ও সুশাসনের সাম্য থাকবে। আমাদের রাষ্ট্রে তা প্রতিষ্ঠা পায়নি। আমাদের যে উন্নয়ন সেখানে মানুষের কান্না মিশে আছে। যত উন্নতি হয়েছে তত বৈষম্য বেড়েছে। রাষ্ট্র মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আমাদের এই রাষ্ট্রকে বদলাতে হবে। এরজন্য সর্বদলীয় সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে হবে।

অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরেও আমরা ‘অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল কল্যাণ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি—এটা উদ্বেগের বিষয়। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি নিয়ে নাগরিক কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, মানুষের মনে ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা স্থান করে নিয়েছে। রাজনৈতিক দল ও সরকার এই উগ্রবাদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলে, সামলে চলে। এটা বদলাতে আমাদের সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা ফিরে আসলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সৃষ্টি হবে। সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, রাষ্ট্র ক্ষমতা সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সমাজ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নাই। সমাজ ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত। এই দ্বিধা-বিভক্ত সমাজ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করছে। আজকের সমাজ মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে অস্বীকার করছে। এখানে রাষ্ট্র ব্যর্থ।

মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ধর্মকে ব্যবহার করে বারবার যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে—সেই ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, জনগণের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ছাড়া ‘সাম্প্রদায়িকতা’ নামের গভীর অসুখকে পরাজিত করা যাবে না।

অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর বলেন, আমাদের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, রাষ্ট্র, সামাজিক সংগঠন—সবাই নিজের স্বার্থের জন্য আপস করে। এই সমাজকে এক রাতে অসাম্প্রদায়িক মানবিক করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদেরও বদলাতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ এখন আর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র নয়। সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোকে নানা যুক্তি দিয়ে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে।

নড়াইলে সাম্প্রতিক সহিংসতার শিকার হ্যামলেট সাহা ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সমাজে শুভবুদ্ধি মানুষরা যখন নিষ্ক্রিয় থাকে তখন দেশে এ ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়। খুব পরিচিত মানুষরাই হামলা করেছে, আগুন দিয়েছে, লুট করেছে। যারা টাকা দিয়েছে তাদের বাড়িতে হামলা হয়নি।

সভায় বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ‘জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠনের দাবি জানান। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান পরিষদের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ বলেন, সরকারের প্রশ্রয়ে এসব সংঘটিত হচ্ছে।

সভায় আরো বক্তব্য রাখেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য উশাতন তালুকদার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, খৃষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সুব্রত হাজরা, নাগরিক উদ্যোগের সিইও জাকির হোসেন, চাকমা রানী ইয়েন ইয়েন প্রমুখ।