হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। গত ৫ মাসে ৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত এক মাসেই ৩ বার উড়োজাহাজে সংঘর্ষ হয়েছে। সর্বশেষ গত ৩ জুলাই রাতে বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে (উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের স্থান) বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দুটি বোয়িং বিমানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
এতে একটি উড়োজাহাজের লেজের হরিজেন্টাল স্ট্যাবিলাইজার ভেঙে গেছে। এভাবে বার বার দুর্ঘটনা ঘটলেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। বারবার এই ‘ধাক্কা’ কি দুর্ঘটনা, না ‘ইচ্ছাকৃত অবহেলা’, না নাশকতা- এনিয়ে সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন।
প্রতিটি দুর্ঘটনায় বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতি হচ্ছে। উড়োজাহাজ মেরামতের জন্য ও গ্রাউন্ডেড হওয়ার কারণে শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। দায়িত্বে অবহেলার পরও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বলেই ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমানের সেবার মান কমছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতিটি ঘটনার পরই তদন্ত কমিটি হয়। দোষীদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন হয় না। রবিবার রাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৮৭ এবং বোয়িং-৭৩৭ এর সংঘর্ষে দুটি বিমানেরই ডানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, বিমানের সুপরিসর বোয়িং ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি সিঙ্গাপুর থেকে এসে সন্ধ্যায় শাহজালালে অবতরণ করে। রাত ৯টা ২০ মিনিটে উড়োজাহাজটি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়ার সময় এই ঘটনা ঘটে। সেখানে আগে থেকে রাখা বোয়িং ৭৩৭ এর বাম পাশের ডানায় ড্রিমলাইনারের ডান পাশের ডানা আঘাত করে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
তবে সংঘর্ষের কারণে ৭৮৭ উড়োজাহাজের ডান পাশের ডানা এবং ৭৩৭ উড়োজাহাজের বাম পাশের ডানা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিমান কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনার সময় উড়োজাহাজ দুটিতে পাইলট ছিলেন না। পুশ কার দিয়ে প্রকৌশল বিভাগের জুনিয়ার কর্মীরা এগুলোকে হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের অদক্ষতায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। অবশ্য নিয়ম অনুযায়ী হ্যাঙ্গারে নেওয়ার সময় উড়োজাহাজে পাইলট থাকেন না।
অবহেলা না দুর্ঘটনা, খতিয়ে দেখতে কমিটি
এদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে এই দুর্ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী। ঘটনাটি ইচ্ছাকৃত অবহেলা নাকি দুর্ঘটনা তা তদন্তের নির্দেশনা দেন তিনি। গতকাল মঙ্গলবার এ ঘটনায় ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। কমিটিকে ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
বিমানের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক তাহেরা খন্দকার বলেন, এই দুর্ঘটনা অবহেলা জনিত না ইচ্ছাকৃত তা তদন্েতর পরেই জানা যাবে। তদন্ত কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিমান ও সিএ) মো. মহিদুল ইসলামকে।
কমিটিতে অন্যান্যের মধ্যে আছেন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব (বিমান ও সিএ) মো. নজরুল ইসলাম সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কতৃর্পক্ষের উপপরিচালক (এয়ারওয়ার্দিনেস স্ট্যান্ডার্ড) আবদুল কাদের এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের উপ-মহাব্যবস্থাপক আনোয়ার হোসেন। এছাড়া ঐ ঘটনায় বিমানের এয়ার সেফটি বিভাগের পরিচালক এনামুল হক তালুকদারকে প্রধান করে আরো একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে।
এর আগে গত ১০ এপ্রিল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে বিমানের একটি বোয়িংয়ের সঙ্গে আরেকটি বোয়িংয়ের ধাক্কা লাগে। এতে দুটো উড়োজাহাজই বড় ধরনে ক্ষতির শিকার হওয়ায় কিছু দিনের জন্য গ্রাউন্ডেড হয়। সে ঘটনায় গত ১১ মে বিমানের মুখ্য (প্রিন্সিপাল) প্রকৌশলীসহ পাঁচজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এই ঘটনার পরও থামেনি দুর্ঘটনা।
এরপর গত ৪ জুন বিমানের দাঁড়িয়ে থাকা বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজে বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলার একটি ব্যাগবাহী ট্রলি এসে ধাক্কা দিলে উড়োজাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে গত ১৬ জুন বিমানের একটি বোয়িং-৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ যাত্রী নামানোর পর অঘটনের শিকার হয়। নিয়মানুযায়ী বোর্ডিং ব্রিজের সঙ্গে উড়োজাহাজের দরজার সংযোগ না খুলেই সেটি পার্কিংয়ে নেওয়ার জন্য ধাক্কা (পুশব্যাক) দিতে শুরু করেন রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত কর্মীরা।
এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে বিমানের বোয়িং-৭৩৭ ফ্লাইট মালয়েশিয়া যাওয়ার পর বাংলাদেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এসময় পাইলট বিমানের উইন্ডশিল্ডে (পাইলটের সামনের কাঁচ) ফাটল বা ক্র্যাক দেখতে পান। এসময় তিনি প্লেনটি না উড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় বিমান। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই হয়েছে হ্যাঙ্গারে নেওয়ার সময়।
কেন বার বার দুর্ঘটনা?
কেন বারবার এমন সংঘর্ষ ঘটছে- তা নিয়ে মুখ খুলতে চান না কেউ। কারণ বিমানবন্দরে একটি সিন্ডিকেট কাজ করছে। তারা শক্তিশালী। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতনদের সুষ্ঠু নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিটের কর্মীদের জবাবদিহিতার অভাবের কারণে এমন ঘটনা ঘটছে।
বিমানের একটি সূত্র বলছে, হ্যাঙ্গারে উড়োজাহাজ বের করা ও রাখার যে নিয়ম রয়েছে তা যথাযথভাবে মানেন না গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিসে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। কিছু কিছু সময় হ্যাঙ্গারে উড়োজাহাজ সরানোর সময় অসতর্ক থাকেন। তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণও নেই।
বিমানের প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের অভিযোগ, জনবল সংকট, নিয়মিত কর্মীদের প্রশিক্ষণ না হওয়ায় এ ধরণের দুর্ঘটনা ঘটছে। নিম্নপদের কর্মীদের দোষারোপ করে দায় এড়াচ্ছেন বিমানের প্রকৌশল বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের একজন প্রকৌশলী বলেন, প্রচণ্ড চাপ নিয়ে বিমানের প্রকৌশল বিভাগের কর্মীদের কাজ করতে হয়, অন্যদিকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট নেই।
কিছু ক্ষেত্রে জনবল সংকট আছে, যার কারণে একই ব্যক্তিকে একাধিক কাজে যুক্ত হতে হচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে।
আপনার মতামত লিখুন :