সব গজব কেন একসাথে আসে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ২১, ২০২২, ১০:৩৬ অপরাহ্ণ /
সব গজব কেন একসাথে আসে
সব গজব কেন একসাথে আসে। – ছবি : সংগৃহীত

খোদায়ি গজব নিয়ে মানুষের ভয় আতঙ্কের যেমন শেষ নেই, তেমনি কৌত‚হলেরও কমতি নেই। সাধারণ ভাষায় বেশির ভাগ লোক গজব বলতে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে বুঝে থাকে। কিন্তু ধর্মীয় পরিভাষায় গজব হলো এমনতর শাস্তি যার মধ্যে অলৌকিকত্ব থাকে। অর্থাৎ দুনিয়ার কোনো যুক্তি-তর্ক-কার্যকারণ দিয়ে ওসব শাস্তিকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বিনা মেঘে বজ্রপাত; ধর্মের কল বাতাসে নড়ে, তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে প্রভৃতি জনপ্রিয় কথামালার সাথে যে অলৌকিক কাহিনীগুলো রয়েছে তা-ই ধর্মীয় দৃষ্টিতে গজব হিসেবে পরিচিত।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা খোদায়ি গজব সম্পর্কে সর্বসাধারণের মতামত হলো- মানুষের কুকর্ম, ক্ষমতাধরদের জুলুম অত্যাচার ইত্যাদি যখন সীমা অতিক্রম করে এবং অত্যাচারিত লোকজনের বিচার চাওয়ার বা বিচার পাওয়ার কোনো জায়গা যখন জমিনে থাকে না, তখন আসমানের মালিক নিজ হাতে বিচারের ভার নিয়ে নেন। এ ক্ষেত্রে যদি জনগণ মন্দ চরিত্রের অধিকারী হয়ে পড়ে তখন নানা রকম রোগবালাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধবিগ্রহ, হানাহানি, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মহামারী ইত্যাদি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অন্য দিকে যদি লোকজন অত্যাচারিত হয় এবং তাদের স্বভাব চরিত্র ভালো থাকে তবে তাদের ওপর জুলুমকারীদের ওপর যেসব অলৌকিক শাস্তি নাজিল হয় সেগুলোকেই সবাই খোদায়ি গজব আখ্যা দিয়ে থাকে।

২০২২ সালের জুলাই মাসে এসে হঠাৎ করে আজকের শিরোনাম প্রসঙ্গে লেখার কথা মনে এলো মূলত চলমান বিশ্বের সার্বিক হালহকিকত দেখার পর। গত তিনটি বছর ধরে করোনা প্রবল তাণ্ডবে, ইউক্রেন যুদ্ধ, সারা দুনিয়ায় নজিরবিহীন জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি ও দুর্ভিক্ষের বেড়াজালে যেভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে তাতে পুরো পরিস্থিতিকেই আমার কাছে খোদায়ি গজব বলে মনে হচ্ছে। উল্লিখিত ঘটনার সাথে সাম্প্রতিক সময়ের ইউরোপের নজিরবিহীন দাবদাহ ও দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতার পটপরিবর্তন গজবের রাজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো- সব গজব এক সাথে আসে কেন! এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আগে দুনিয়া কাঁপানো কয়েকটি গজবের কাহিনী প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণ বলা অবশ্যক। কাহিনীগুলোর মধ্যে প্রথমেই বর্ণনা করব ডেড সি বা মৃত সাগরসংক্রান্ত গজবের প্রেক্ষাপট।

ডেড সি বা মৃত সাগর খোদায়ি গজবের এক কিংবদন্তির ইতিহাসের বাস্তব রূপ, যা থেকে মানুষ কিয়ামত পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এটিকে সাগর বলা হলেও মূলত এটি একটি হ্রদ। অনেকে এটিকে লবণাক্ত হ্রদ বা সল্ট লেক বলে থাকেন। পৃথিবীর নিম্নতম এলাকা বলে পরিচিত ডেড সি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২০ মিটার নিচে অবস্থিত এবং এর আয়তন ৬০৫ বর্গকিলোমিটার। হ্রদের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ হলো ৩০ শতাংশ, যা সমুদ্রের পানির চেয়ে ৮.৬ গুণ বেশি লবণাক্ত। অধিক লবণের কারণে এই হ্রদের পানিতে কোনো উদ্ভিদ অথবা প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। আর পানির ঘনত্বের কারণে এখানে মানব শরীর ডুবে যায় না- বেলুনের মতো ভাসতে থাকে।

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের দ্বিতীয় কোনো অতি আশ্চর্যময় জলভ‚মি পৃথিবীতে নেই এবং এই হ্রদ সৃষ্টির পেছনে যে ধর্মীয় কাহিনী রয়েছে তা পৃথিবীর সব ধর্মমত প্রায় একইভাবে বর্ণনা করেছে। অন্য দিকে, ধর্মীয় বর্ণনার সাথে এই একটি মাত্র ঘটনার ঐতিহাসিক মিল রয়েছে। ইতিহাস বলছে- পুরো এলাকাটি একসময় সমৃদ্ধ একটি নগরী ছিল। একটি ভ‚মিকম্পের মাধ্যমে পুরো এলাকার প্রাণিকুল-বৃক্ষরাজি, প্রাসাদ হর্ম্যরাজি মাটিচাপা পড়ে যায় এবং যে গভীর খাদের সৃষ্টি হয় সেই খাদটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত পানি দিয়ে পরিপূর্ণ করা হয় প্রকৃতির অপার লীলাখেলার মাধ্যমে।

মৃত সাগর সম্পর্কে ধর্মীয় পুস্তকে বলা হয়- এই অঞ্চলের বাসিন্দারা সীমাহীন পাপাচারে লিপ্ত ছিল। সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য, যারা পাপীদের হাতে সীমাহীন নির্যাতনের শিকার হতো। মন্দ লোকেরা পরস্পরের সাথে পাল্লা দিয়ে এমন সব অশ্লীল কর্ম করত যা প্রকৃতির কোনো কীট-পতঙ্গ-জন্তু-জানোয়াররা পর্যন্ত করে না। তাদের অপরাধ দেখে অশরীরী আত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠত। এ অবস্থায় মহান আল্লাহর হুকুমে বার্তাবাহী ফেরেশতা হজরত জিবরাইল আ: তার পাখা দিয়ে পুরো জনপদের ওপর এমন আঘাত করেন, যার ফলে জমিনটি উল্টে গভীর খাদের সৃষ্টি হয়ে যায়।

মৃত সাগরের মতো আরেক ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর নাম পম্পেই। ৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ইতালীয় বিখ্যাত আগ্নেয়গিরি বিসুভিয়াসের সর্বনাশা অগ্ন্যুৎপাতে পুরো শহরটি জ্বলন্ত লাভার নিচে চাপা পড়ে সমূলে ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনাটি সাম্প্রতিককালের হওয়ার কারণে পম্পেই নগরীর বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস ও নগরীর ধ্বংসাবশেষের নমুনা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ পৃথিবীবাসী নির্ভুলভাবে জানতে পারছে। এই নগরীর বাসিন্দারাও ডেড সি এলাকার বাসিন্দাদের মতো সীমাহীন পাপাচার ও বর্ণনার অযোগ্য অশ্লীল কর্মে লিপ্ত ছিল। ফলে তাদের সমূলে বিনাশ করার জন্য খোদায়ি গজব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।

উল্লিখিত দুটো ঘটনার মতো আরো বহু অলৌকিক গজবে এই জমিনের বহু বসতি মরুভূমি হয়েছে- কোথাও সৃষ্টি হয়েছে নদ-নদী-সাগর কিংবা মহাসাগর। আবার কোনো কোনো সমৃদ্ধ নগরী পরিণত হয়েছে গহিন অরণ্যে। জমিনের এই উত্থান-পতনের মূল কারণ ছিল সর্বজনীন পাপাচার ও ভালো মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা। জমিনে কখন খোদায়ি গজব অনিবার্য হয়ে পড়ে এই সূত্র বর্ণনা করতে গিয়ে জনৈক প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি বলেন, যখন হত্যাকারী জানে না সে কেন হত্যা করছে এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি যখন বুঝতে পারে না, কেন তাকে হত্যা করা হচ্ছে।

দেশ-কাল জনপদ সমূলে বিনাশের পর খোদায়ি গজবের দ্বিতীয় পর্যায়ে হচ্ছে গোত্র বর্ণ পরিবারকে সমূলে বিনাশ করা। এ ক্ষেত্রে আদ জাতি, সামুদ জাতি, লুতের সম্প্রদায়, সালেহর সম্প্রদায়সহ হাজার বছরের ইতিহাসে বহু অত্যাচারী শাসক পরিবারের নির্বংশ হওয়ার ইতিহাস আমরা কমবেশি সবাই জানি। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার মাধ্যমে উমাইয়ারা যে নব্বই বছরের রাজত্ব জমিনে কায়েম করেছিল তার পরিণতি আব্বাসীয়দের মাধ্যমে এমনভাবে ঘটেছিল যা স্মরণ করলে আজো পিলে চমকে ওঠে। উমাইয়া বংশের সব মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। কেবল একজন মানুষ কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে স্পেনে যেতে পেরেছিল। বিগত শতাব্দীর নিকোলাই চসেস্কু, মার্কোস-ইমেলদা মার্কোস, পিনোসের সাথে অতি সাম্প্রতিক জমানার শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসে পরিবারের পরিণতি বিশ্লেষণ করলেই খোদায়ি গজব কিভাবে পরিবার বা গোষ্ঠীর ওপর আপতিত হয় তা সহজে অনুধাবন করা যাবে।

ব্যক্তির ওপর খোদায়ি গজবের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস। এ ছাড়া রোমান সম্রাট নিরো, রাশিয়ার সম্রাট বা জার আইভান দ্য টেরিবল, রোমান সম্রাট কমোডাস, পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় ক্যামবিসেস, দিল্লির সম্রাট কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ, বাংলার শাসক রাজা গণেশ ও মামলুক সুলতান মুজাফ্ফর শাহের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। রাজনীতি বা রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে খোদায়ি গজবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে আবু লাহাব ও তার স্ত্রী, ভণ্ড নবী মুসায়লামাতুল কাজ্জাব, মোনাফেক আবদুল্লাহ বিন উবাইসহ জগৎশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদ, ঘসেটি বেগমদের নাম হাজার বছরের ইতিহাসে বারবার ফিরে আসে এবং পৃথিবীর মাশরেক থেকে মাগরেবের প্রতিটি জনপদে প্রতি ৫০ বছর পরপর এদের দেখা মেলে।

খোদায়ি গজবের লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে আলোচনার পরিধি না বাড়িয়ে এবার সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব, সব গজব কেন একসাথে আসে। এখানে একটি কথা আগাম বলে নেয়া ভালো যে, বর্তমান জমানায় পুরো বিশ্ব একই সাথে যেভাবে একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানব সৃষ্ট দুর্যোগ, কৃত্রিম দুর্যোগ ও একটি দুর্যোগের ফলে তৈরি হওয়া আরেকটি দুর্যোগের কবলে পড়েছে তেমনি অতীতকালে যুগপৎভাবে ঘটেনি। আমরা হজরত নুহ আ:-এর জমানার প্রবল বন্যার কথা শুনেছি যা কিনা সারা পৃথিবীকে প্লাবিত করেছিল কিন্তু বর্তমান জমানার মতো এত বিপর্যয় আমি ইতিহাসের কোথাও দেখিনি।

পৃথিবীর উদাহরণ ছেড়ে যদি আপনি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, প্রকৃতির বিরূপ আচরণ, মনুষ্য সৃষ্ট বিপর্যয়, পাপাচার, জুলুম-অত্যাচার, মিথ্যাচার এবং একের পর এক আশ্চর্যজনক ঘটনার তাণ্ডব বিশ্লেষণ করেন তবে আন্দাজ করতে পারবেন যে, সব ঘটনার জন্য সব মানুষ দায়ী নয় কিংবা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আবার যারা ভুক্তভোগী তারা জানে না, কী অপরাধে তারা দণ্ডিত হচ্ছেন। ফলে সমকালীন সময়টি এত অস্থিরভাবে চার দিকে প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাকের সৃষ্টি করছে যা নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য সম্ভবত মানুষের হাতে নেই।

আমরা আজকের আলোচনার একেবারে প্রান্তসীমায় চলে এসেছি। এবার শিরোনাম সম্পর্কে আলোচনা করে আজকের নিবন্ধের ইতি টানব। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোনো দেশ-কাল, জাতি-গোষ্ঠী বা ব্যক্তির ওপর রুষ্ট হলে তিনি প্রাথমিক অবস্থায় এমন কতগুলো সমস্যা সৃষ্টি করেন, যা সমাধানযোগ্য এবং অপরাধীদের ভাগ্যে যদি হিদায়াত নসিব হয় তবে তারা সমস্যাগুলো দেখামাত্র বুঝতে পারে যে, এগুলো তাদের দু’হাতের কামাই ও পাপের ফসল। তখন তারা সতর্ক হয়, তওবা করে ও খোদায়ি গজব থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বেশির ভাগ অপরাধী সতর্ক না হয়ে বরং অপরাধের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ঠিক তখনই সব গজব চার দিক থেকে অক্টোপাসের মতো এমনভাবে পাকড়াও করে যে, অপরাধীরা পালানোর পথ পায় না, লুকানোর জায়গা পায় না। এমনকি পৃথিবীর বাতাস-পানি-মাটি কিংবা আগুনও অপরাধীদের গ্রহণ করতে চায় না।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য