মতবিনিময় শেষে সাংবাদিকদের সাথে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান - ছবিঃ সংগৃহীত
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘আমাদের কারো কাছে দায়বদ্ধতা নেই। আমাদের দায়বদ্ধতা শুধু জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, এছাড়া সাধারণ মানুষ যারা আন্দোলন করেছেন, তাদের প্রতি। আর কারো প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা নেই। আমরা বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি, ক্ষমতা গ্রহণ করিনি। সুতরাং যে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না।’
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে ভারতের আদানি গ্রুপের সাথে শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তি প্রসঙ্গে শনিবার (২১ ডিসেম্বর) দুপুরে কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনায় এক মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যাপারে কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে আদানি গ্রুপের সাথে। শেখ হাসিনার সরকার কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই এই চুক্তি করে। এতে আর্থিকভাবে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করায় এই চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট আদানির একটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টকে কর অব্যাহতিসহ অন্যান্য সুবিধা দেয় ভারত। তবে বিষয়টি বাংলাদেশের কাছে গোপন করে আদানি গ্রুপ। এটা চুক্তির লঙ্ঘন।’
তিনি আরো জানান, ‘বিষয়টা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড আদানিকে ইতোমধ্যে জানিয়েছে। এছাড়া এগুলো পরীক্ষা করার জন্য আমরা একটা জাতীয় কমিটি গঠন করেছি। সাবেক বিচারপতি জাস্টিস মইনুল ইসলামের নেতৃত্বে। তারা বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। এবং এগুলোর একটা আইনগত দিক আছে। এর জন্য আমাদেরকে হাইকোর্ট থেকে একটা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কারণ কিছু একটা ব্যবস্থা নিলেই ওরা তো মামলায় চলে যাবে। এজন্য আইনগত দিকগুলো পরীক্ষা করার জন্য বিদেশী আইন ফার্ম স্থানীয় আইন ফার্ম রিক্রুটমেন্ট প্রসেস প্রকিউরমেন্ট করার চেষ্টা করছি। ওরা যেভাবে আমাদেরকে সিদ্ধান্ত দেবে এভাবে আমরা এগিয়ে যাব।’
‘কিন্তু এই সমস্যাটা শুধু আদানির না। শেখ হাসিনার সময় এরকম আরো অনেক অসম চুক্তি করা হয়েছে। যেটা জাতীয় স্বার্থের বিরোধী। শুধু আদানির বিষয়টাই নয় এরকম আরো সাতটি প্রকল্প দেখবে এই কমিটি। এই সাতটি প্রকল্পের ভিত্তিতে ওরা আমাদেরকে একটা গাইডেন্স দেবে, সেই গাইডেন্সের ভিত্তিতে আমরা চুক্তিগুলো কি রাখবো নাকি সংশোধন করব, নাকি বাতিল করব সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবো, বলেন তিনি।
উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভার আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান হাওরের আলোচিত অলওয়েদার সড়ক ঘুরে দেখেন।
এ সড়কের ভবিষ্যত নিয়ে সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে সড়কটা হয়ে গেছে। এখন এটার ভালো মন্দ নিয়ে আমরা বির্তক করব না। কিন্তু এই সড়ক নির্মাণের ফলে যেসব সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের চেষ্টা করা হবে।’
এ সময় তিনি হাওরের চিরকালীন নৌযোগাযোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের ট্রাডিশনাল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করতে হবে। এজন্য নদীগুলোর ড্রেজিং প্রয়োজন। সেই কাজটিও আমরা করতে চাই। কিশোরগঞ্জ ও সিলেটের সাথে সংযোগের বিষয়টি আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখব। জেলা শহরের সাথে যোগাযোগের বিষয়টিও ভাবা হবে। এখন থেকে আমরা ঢাকায় বসে কোনো পরিকল্পনা করব না। মানুষের সাথে কথা বলে, মানুষ যেটা চায়, মানুষ যেটা প্রয়োজনবোধ করে আমরা সেটাই করব।’
তিনি বলেন, ‘বন্যা এখানে (হাওরে) দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এটার কারণ ড্রেজিং হচ্ছে না। নদীগুলোতে পলি জমছে। ড্রেজিংয়ের জন্য আমরা পানিসম্পদ সচিবের সাথে কথা বলেছি, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা শুনেছেন। এটার ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে, হাওরের সড়কের ফলে জমিতে বালি আসছে এবং আগাছা জন্মাচ্ছে। এটার জন্য কৃষি সচিবের সাথে কথা হয়েছে। আমি কৃষি উপদেষ্টার সাথে গিয়েও কথা বলবো, যে এটা কিভাবে সমাধান করা যায়।’
হাওরের উপর দিয়ে মিঠামইন ও করিমগঞ্জকে যুক্ত করার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত উড়াল সড়ক নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, ‘উড়াল সড়ক বিষয়ে আমি বিস্তারিত অবগত না। সেতু বিভাগও আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। আমি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে, উড়াল সড়কের ভালোমন্দ পরীক্ষা করে, পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার আগে আগে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির।
এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব ও উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব মাহিদ-আল-হাসান, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো: আমিন উল আহসান, জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাকিল মোহাম্মদ ফয়সাল, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সাজ্জাদ হোসেন, মিঠামইন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা খান মো: আব্দুল্লা আল মামুন, করিমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার, ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক, অষ্টগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা: দিলশাদ জাহান ও ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রধান, জনপ্রতিনিধি, কৃষক ও জেলে প্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান সাধারণ যাত্রীদের সাথে ট্রেনে চড়ে শুক্রবার রাত পৌনে ১২টায় কিশোরগঞ্জ আসেন। শনিবার বিকেল ৪টায় ট্রেনে চড়ে আবার ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হন।