উচ্চ আদালতের আদেশ-নির্দেশ ও রায়কে পাত্তা দিচ্ছে না সরকারি প্রশাসন। চরম অবজ্ঞা ভরে ফাইলের স্তূপে চাপা দিয়ে রাখা হচ্ছে রায়ের নথি। তবে স্থানীয় প্রশাসন উঠ-বস করছে ফ্যাসিস্টের দোসর, স্থানীয় রাজনীতিক, প্রভাবশালী আমলা, এমনকি সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধামকিতে। তাদের আকাক্সক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, অধিদফতর, কর্তৃপক্ষ, ডিসি, এসপি, ইউএনও, এসি (ল্যান্ড), জেলা রেজিস্ট্রার, সাব-রেজিস্ট্রার,ভূমি অফিসের মতো সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কখনো উচ্চ আদালতের রায় ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। অপমান করছে।
হুকুম তামিল না করে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থাকে। কখনো না জানার, না বোঝার ভাণ করে পরিকল্পিতভাবে আদালতকে করছে অপমান। আইন,সংবিধান এবং সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ওপর ‘কয়েরিজ’ দেয়া হচ্ছে। ‘আইনি মতামত গ্রহণ’র নামে সৃষ্টি করা হচ্ছে পরিকল্পিত জটিলতা। এটি শুধু দেশের বিচার ব্যবস্থাকে শুধু ধৃষ্টতা দেখানোই নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষকে করে তুলছে ক্ষুব্ধ। যাকে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্টদের পুনর্ক্ষমতায়নের দুরভিসন্ধি বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেয়া যাক।
কেস স্টাডি-এক: রাজধানীর হৃৎপি- ‘গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক’। এটির উন্নয়নে ২০১৬ সালের ১৪ জুলাই প্রকল্প গ্রহণ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-রাজউক। এ লক্ষ্যে লেক সংলগ্ন ২৫ দশমিক ৪৩০৮ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এর ভিত্তিতে ওই বছর ২১ আগস্ট ঢাকা জেলা প্রশাসন ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের ৩ ধারায় নোটিশ দেয়। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ৬ জুন ডিসি অফিস ৬ ধারায়ও নোটিশ করে। দীর্ঘদিনেও ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় ভূমি মালিকরা ২০২২ সালে রিট (নং-৪৯৫৯/২০২২) করেন।
শুনানি শেষে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ গতবছর ১৭ জানুয়ারি রায় দেন। রায়ে ৩ মাসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেন। কিন্তু জেলা প্রশাসন এবং রাজউক হাইকোর্টের রায় ফেলে রাখে অবজ্ঞাভরে। দীর্ঘদিন ক্ষতিপূরণের টাকা না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা বাধ্য হয়ে আদালত অবমাননার মামলা করেন গতবছর ১৪ নভেম্বর। উচ্চ আদালতের এ রায়কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি এক চাতুর্যের আশ্রয় নেয় ঢাকা জেলা প্রশাসন। রুলটি এখন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
কেস স্টাডি-দুই : হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো: আব্দুল মালেক আকন্দ। কুমিল্লার মেঘনা উপজেলাধীন চন্দনপুর এম.এ.উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছিলেন। হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের স্নেহধন্য অতিরিক্ত সচিব ফরিদ আজিজের ব্যক্তিগত আক্রোশে চাকরি হারান। অতিরিক্ত সচিবের চেয়ারে বসে তিনি একাধারে ছিলেন স্কুলটির গভর্নিং বডিরও সভাপতি। একচ্ছত্র নিয়ন্তা হয়ে ওঠেন স্থানীয় ভিলেজ পলিটিক্সের। পরস্পর বিরোধী দু’টি পক্ষের সংঘাতের অন্যায্য শিকার হন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক। ‘দুর্নীতি’র ধুয়া তুলে তাকে বরখাস্ত করা হয়। চাকরিচ্যুতির আদেশ চ্যালেঞ্জ করে রিট (নং-৬১৭৬/২০২১) করেন ওই প্রধান শিক্ষক।
রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে মালেক আকন্দের চাকরিচ্যুতিকে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। তাকে জরুরিভিত্তিতে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ফরিদ আজিজ নিযুক্ত ‘ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক’কে দিয়ে ‘লিভ টু আপিল’ করান। যদিও আপিল বিভাগ হাইকোর্টের দেয়া রায় স্থগিত করেননি। ফলে হাইকোর্টের রায়ের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে তাকে স্বপদে যোগদান করতে বলে।
কিন্তু মেঘনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হ্যাপী দাস মালেক আকন্দের যোগদানপত্র তাৎক্ষণিকভাবে গ্রহণ করেননি। বরং হাইকোর্টের রায় এবং লিভ টু আপিল বিষয়ে মতামত চেয়ে গত ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলা প্রশাসনকে চিঠি (স্মারক নং-০৫.২০.১৯৭৫.০০০.০৮.০১৪.২৫-২৭৩) দেন। আর এভাবেই মাঠপর্যায়ের উদীয়মান আমলা হ্যাপী দাস দীর্ঘদিন আটকে রাখেন পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করা স্কুল শিক্ষকের যোগদান।
জানাগেছে, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ফরিদ আজিজের অলিখিত হুকুম অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করছেন এই ইউএনও। তবে নানা টালবাহানার পর সম্প্রতি তার যোগদানপত্র গ্রহণ করেছেন বলে জানা গেছে।
কেস স্টাডি-তিন : রাজশাহী মহানগরীর পুকুর ভরাট বন্ধ এবং ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। রিটের শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৮ আগস্ট হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন। ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’-এইচআরপিবি এ রিট করে। শুনানি করেন সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। কিন্তু উচ্চ আদালতের এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজশাহীতে এখন পুকুর ভরাট চলছে সমানে।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র, পরিবেশ অধিদফতর, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানকে নির্দেশ তামিল করতে বলা হয়। হাইকোর্টের আদেশ রাজশাহীর কোনো কর্তৃপক্ষই এখন আর মানছে না। প্রভাবশালীরা স্থানীয় ভূমি অফিস এবং জেলা প্রশাসনকে হাত করে পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করছে। ‘পুকুর’গুলোকে ‘ভিটা’ করে ফেলছে। দুই থেকে চার লাখ টাকা ঘুস দিয়ে দেদারছে ভরাট করা হয়েছে বহু পুকুর।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, আহম্মদপুর স্কুলের সামনে আরাজি শিরইল মৌজার পুকুরটি (খতিয়ান নম্বর ৪৪, জেএল ১১ শ্রেণী পুকুর) ভিটায় পরিণত করা হয়েছে। পুকুরটির ভরাট বন্ধে এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছিলেন। জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর, রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন নিবেদন করেছেন। সেই নিবেদনকে তোয়াক্কা করা হয়নি।
নগরীর ২৩/২৪ নম্বর ওয়ার্ড সংলগ্ন মেহেরের পুকুরটি জালজালিয়াতির মাধ্যমে ‘ভিটা’ করা হয়েছে। নিউ ডিগ্রি কলেজ এর পাশের পুকুর শুকান দিঘীও ভরাট করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ‘সোনাদিঘী’র অবস্থাও এখন করুণ। শুমারি করলে হয়তো এখন ৯৫২টি পুকুরের মধ্যে ১শ’ পুকুরের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না। একের পর এক পুকুর ভরাট করা হলেও যাদের প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিলো তারা এখন নির্বিকার।
মেহেরের পুকুরসহ পোস্টাল একাডেমির পাশের পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তনের খতিয়ানে স্বাক্ষর করেন বোয়ালিয়ার তৎকালীন এসিল্যান্ড শাহীন মিয়া। অন্ততঃ ১৮টি খতিয়ানে অনুমোদন দিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন এটা অসাবধানতা বশতঃ কারণিক ভুল। অথচ কি করে এমন শত শত ‘ভুল’ হতে পারে- সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। দু’-চার লাখ টাকা নজরানার বিনিময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে পুকুর ভরাট করা হয়েছে শত শত। ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, রাজশাহীর পুকুর ভরাট বন্ধে আমরা ২০১৪ সালে রিট করি। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট পুকুর ভরাট নিষিদ্ধ, ভরাটকৃত পুকুর পূর্বতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, পুকুর গণনা এবং বিদ্যমান ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করেন হাইকোর্ট। কিন্তু সম্প্রতি পত্র-পত্রিকায় দেখছি, হাইকোর্টের ওই রায় প্রতিপালন হচ্ছে না। তাই আমরা বিষয়টি শিঘ্রই আদালতের দৃষ্টিতে আনবো। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করবো।
এদিকে মামলার ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি স্থানীয় প্রশাসন এবং সেবাখাত কর্তৃপক্ষের চরম অবজ্ঞা থাকলেও ‘যথাযথ সম্মান’ দেখাচ্ছে রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পদস্থ কর্মকর্তাদের। যেটি আদালতের রায়ে বছরের পর বছর সিদ্ধান্তহীন অবস্থায় পড়ে থাকছে, সেটি নিমিষে নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের এক ফোনে। এতে বাধ্য হয়ে মানুষ ন্যায় বিচার পেতে বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তে ছুটছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পেছনে। বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, তাদের নিকটাত্মীয়, সমন্বয়ক-পরিবারের সদস্যদের দ্বারস্থ হচ্ছে মানুষ। যা বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতারই পরিচায়ক।
আইনজ্ঞরা বলছেন, আদালতের প্রতি মানুষের আস্থার সঙ্কট দিনকে দিন প্রকট হয়ে উঠছে। উচ্চ আদালতের রায় প্রতিপালনে বিবাদীপক্ষ কিংবা স্থানীয় প্রশাসন যদি উদাসীনতা দেখায় সেটি বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। এতে নাগরিকের মাঝে নিজের হাতে আইন তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়বে। মানুষ যখন দেখবে, আদালতে ন্যায় বিচার পাচ্ছে না, তখন নিজেই নিজের বিচার আদায় করে নেয়ার কথা ভাববে।
ঢাকা বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, স্থানীয় প্রশাসনের আদালতের রায়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রকারান্তে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলবে। কারণ, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিচারাহীনতার বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে মানুষ। এ সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে মানুষ খুব বেশি সময় নেবে না। প্রান্তিক পর্যায়ে সেবাপ্রার্থীরা কতটা সুশাসন পেলো- সেটি দিয়েই পরিমাপ করবে বর্তমান সরকারকে। সেটির ন্যূনতম টুকুন দিতে পারলে মানুষকে সহসাই ক্ষুব্ধ করে তুলবে। সরকারকে ‘ব্যর্থ’ প্রমাণ করবে। যা বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের রাত-দিনের প্রত্যাশা।