প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাজে গতিবৃদ্ধি এবং নতুন বাংলাদেশ গড়তে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেয়া ২৫টি নির্দেশনা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবরা কতটুকু বাস্তবায়ন করেছেন তার অগ্রগতি এবং মূল্যায়ন থাকছে উপদেষ্টা পরিষদ সভায়। জন-আকাক্সক্ষা পূরণে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর জনগণের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে তা সঠিকভাবে পালনে নির্দেশনা থাকছে।
এছাড়া সরকারের ১০০ দিনের বাস্তবায়ন ও অগ্রগতি নিয়ে নতুন নির্দেশনা দিবেন প্রধান উপদেষ্টা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অধ্যাদেশরে খসড়াসহ বেশি কয়েকটি আইনের অনুমোদন দেয়া হবে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ বুধবার সচিবালয়ে প্রথম অফিস শুরু করেছেন।এখন থেকে প্রধান উপদেষ্টার সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ও মন্ত্রণালয়ে সচিব এবং প্রশাসনের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করবেন। ইতোমধ্যে সচিবালয়ের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ-জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বাইরে-ভেতরে নামফলক পরিবর্তন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান উপদেষ্টার সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাদের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বসার কক্ষও ঠিকঠাক করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা আজ বুধবার সকাল ১১টায় সচিবালয়ের ৬ নম্বর ভবনের ১৩ তলায় সংরক্ষিত এলাকায় উপদেষ্টা পরিষদ কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব মো. তোফায়েল হোসেন স্বারিত চিঠি সকল সচিব ও বিভাগকে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সচিবালয়ে আগমন উপলক্ষ্যে সচিবালয়ের সকল মন্ত্রণালয়/ বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে আবশ্যিকভাবে পরিচপত্রসহ সচিবালয়ে প্রবেশ নিশ্চিতকরণ, প্রধান উপদেষ্টা সচিবালয়ে অবস্থানকালীন কোনো প্রবেশ পাস ইস্যু না করার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী বহন সীমিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো বলা হয়।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তখন থেকে প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অফিস করছিলেন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের দিন গণভবনসহ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ভাঙচুর হয়।
এতে স্থাপনাগুলো কাজের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।টানা ১৫ দিনব্যাপী সংস্কার কাজ করে প্রস্তুত করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়। ইতোমধ্যে কার্যালয়ের বাইরে-ভেতরে নামফলক পরিবর্তন করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রধান উপদেষ্টার সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাদের বসার কক্ষও ঠিকঠাক করা হয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার (সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) বর্তমান অফিস করছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে গত ৪ সেপ্টেম্বর সচিব সভা অনুষ্ঠিত হয়। নতুন বাংলাদেশ গড়তে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের ২৫টি নির্দেশনা দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এসব নির্দেশনা সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সচিব ও সিনিয়র সচিবদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ওই সভায় তিনি সিনিয়র সচিব/সচিবদের উদ্দেশে এ বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।
নির্দেশনাগুলো হচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া ‘মার্চিং অর্ডার’ অনুসরণ করতে হবে। সৃষ্টিশীল, নাগরিকবান্ধব মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগকে জরুরি-ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার পরিকল্পনা এবং একই সঙ্গে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়নে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ও তাদের মতামত নিতে হবে। বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে সবাইকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে, সেবা সহজীকরণের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে।
বাজেটের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ক্রয়ে যথার্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ, ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, দেশের স্বার্থে তা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। নিজ কর্তব্যকর্মে দায়িত্ববোধ ও সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে হবে। সেবা-প্রার্থীদের কেউ যেন কোনোরূপ ভোগান্তি, হয়রানি কিংবা কোনো কারণে দীর্ঘসূত্রিতার শিকার না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কার্যক্রম নিতে হবে। জরুরি সরবরাহ নিশ্চিত করে তা অব্যাহত রাখতে হবে। কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে জনবান্ধব সরকারে পরিণত করতে সমবেতভাবে কাজ করতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম যাচাই করে প্রয়োজনে সংস্কার করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সরবরাহ ও সঞ্চালন যাতে ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে তৎপর থাকতে হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। গ্যাসের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। খাদ্য সংগ্রহ, মজুদ ও সরবরাহ সন্তোষজনক রাখতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানির বিকল্প উৎস বের করতে হবে। ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। শিল্প উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে।
চিঠিতে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া এসব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্তগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নে সচিবদের একান্ত সহযোগিতা ও উদ্যোগ কামনা করা হয়। একই সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে সেই বিষয়ে অগ্রগতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানানোর অনুরোধ জানানো হয়।
গত তিন মাসে সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনে এই নাজুক পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। এর বীজও অনেক গভীরে প্রোথিত। তৃণমূল পর্যায়ের আমলারা সেই ক্ষমতার ভারসাম্য রাখতে পারছেন না।
উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে কর্মরত আমলাদের মধ্যে এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির প্রভাব বহমান। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাসে মোট ৫০১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। যদিও গত ১৫ বছরে বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি বঞ্চিত সেজে কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তাও পদোন্নতি পেয়েছেন। এছাড়া প্রশাসনে বঞ্চিতদের পদোন্নতি দিতে গতকাল রোববার এসএসবির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গত ৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল করে। যাতে প্রশাসনের কাজে স্থবিরতা দেখা না দেয়। কাজে গতি আসে। কিন্তু এবার অন্তর্বর্তীকলীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই প্রশাসনে বড় ধরনের রদবদল করতে পারেনি। ্ কি কি কারণে মন্ত্রণালয় গুলো নিদেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সে গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।
গত তিন মাসের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।অন্তর্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত তিন মাসে সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়।
গত ৩ মাসে (আগস্ট-অক্টোবর) সিনিয়র সচিব/সচিব পদে ১২ জন, গ্রেড-১ পদে ৩ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫ জন, যুগ্মসচিব পদে ২২৬ জন, উপসচিব পদে ১২৫ জন, অন্যান্য ক্যাডারে ২২১ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) পদে ৯ জন এবং সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) পদে ৩৭ জনসহ সর্বমোট ৭৬৮ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ সময়ে চারজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন মাসে সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব/সচিব পর্যায় পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। এ সময়ে ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বমোট এক হাজার ৮৭০ জনকে বদলি করা হয়েছে। ৬৫ জনকে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয় আলোচনা হবে বলে জানা গেছে।