উপমহাদেশ থেকে বহু আগে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়েছে। তাই রাজা-রানির প্রচলনও নেই। তবে রাজশাহীর দুর্গাপুরে এক স্বঘোষিত রাজার সন্ধান মিলেছে। এই রাজার নাম আব্দুল কাদের। সত্তরোর্ধ্ব এই রাজা উপজেলার চৌপুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা। পেশাগত বাস্তব জীবনে নৈশপ্রহরী হলেও সৌখিন মানুষটি প্রায়শই দিনের বেলায় রাজার পোশাক পরে, ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। তিনি নিজেকে ‘রাজা’ ভাবতেও পছন্দ করেন। ৫০ বছর ধরে তিনি রাজা সেজে আসছেন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, নিজ বাড়ির শিশুরা তাকে ‘রাজামশাই’ বলে সম্বোধন করে। তার স্ত্রীকেও ডাকে ‘রানী’। শুধু নিজ বাড়ির শিশুরাই নয়, বাইরের বিশেষ করে এলাকার মানুষও তাকে রাজা সম্বোধন করেন। তারা দেখেন কটিতে তলোয়ার, পিঠে তির-ধনুক নিয়ে লোকটি ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন। যার কথা বলছি, সেই রাজা আব্দুল কাদের মোল্লার বাড়িতে গিয়ে বোঝা গেল, নিম্নবিত্ত এই মানুষটি আসলে সৌখিন, মনের ধনে ধনী।
তিন ছেলে ও এক মেয়েরও বাবার শখের প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এমনকি স্ত্রীও তাকে সমর্থন করেন। অবশ্য বিয়ের পর কিছুদিন বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি তার স্ত্রী। তখন সদ্য রাজা সাজতে শুরু করেন তিনি। এতো দিন রাজার বেশে তলোয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। এবার ছেলেদের কাছে বায়না ধরেছেন, তার একটা বন্দুক চাই। ছেলেরাও রাজি, বাবাকে খুশি করতে তারা বন্দুকই কিনে দেবেন বলে জানান।
জিজ্ঞাসা করতেই এলাকার লোকজন স্বঘোষিত ‘রাজা’ আব্দুল কাদেরের বাড়ির পথ চিনিয়ে দেয়। সাত সকালে তার বাড়ি গিয়ে জানা যায়, রাজা বাজারে গেছেন। মোবাইল ফোনে কল দিতেই আগমণের কারণ জানতে চান। পত্রিকায় রিপোর্ট করার কথা শুনে পারিবারিক ব্যস্ততার মধ্যেও বাড়ি ফিরেই রাজার পোশাক পরতে রাজি হন। রাজার শুধু নিজেরই পোশাক নয়, রাজার ঘোড়ারও আছে রাজকীয় পোশাক। ৫০ বছরে ১৫টি ঘোড়া পরিবর্তন করেছেন। তার বর্তমান ঘোড়াটা ১৬ নম্বর।
কথামতো রাজা প্রথমে ঘোড়াকে সাজাতে শুরু করেন। ঘোড়ার প্রতি পায়ে তিনটি করে ঝালর লাগান, ঘুঙুর বাঁধেন। পিঠে চড়ান গদি। তার ওপরে মখমলের কাপড়। মেজ ছেলে হাশেমের স্ত্রী তানিয়া শ্বশুরকে সহায়তা করেন। ঘোড়াকে সাজানোর সময় আব্দুল কাদের বলেন, ‘আমার কিছু না থাক, যখন ঘোড়ায় চড়ে বাইরে বের হব, তখন সবাই আমাকে রাজা ডাকবে। আমি নিজেও মনে করি আমি রাজা।’
রাজা আব্দুল কাদেরের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সুবেলা জানান, রাজা বলে কথা। তার তো রাজ্য নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা। তাই রাগও একটু বেশিই।
আলাপে জানা যায়, রাজার রয়েছে সাত রঙের জরির পোশাক। কোনটা পড়বেন, তা ছেলের বউ তানিয়াকে জানান। রাজার পোশাকের বোতাম লাগান মেজ ছেলের বউ। মুকুট পড়ান বড় ছেলে আল আমিনের বউ রাজিয়া। তিনিই কটিতে তলোয়ারটা বেঁধে দেন। তির-ধনুকও পিঠে ঝুলিয়ে দেন। এরপর তানিয়া চশমা ও রাবারের জুতা পড়িয়ে দেন।
সবশেষে বড় ছেলের বউ রাজিয়া ঘোড়া নিয়ে বাইরে আসতেই তার বড় মেয়ে আলপনা একটি প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এসে দাদাকে ঘোড়ায় চড়তে সাহাঘ্য করে। এসময় আব্দুল কাদের বলেন, ‘বয়স হয়েছে। আগের মতো লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চড়তে পারি না। তাই চেয়ারে পা দিয়ে ঘোড়ায় চড়তে হয়।’
রাস্তায় উঠেই ঘোড়াকে কষে চাবুক মারেন রাজা আব্দুল কাদের। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃষ্টির আড়ালে চলে যান ‘রাজা’। গ্রামের চা- দোকানি বাবুল বলেন, ‘আপনারা কি কাদের রাজার বাড়িত আইচেন?’ কথায় কথায় বললেন, আমার বয়স ৪০ হতে যাচ্চে। বুদ্ধি হওয়ার পর থাইকি দেখতিচি। কাদের চাচা রাজার পোশাক পইরি ঘোড়ায় চইড়ি বেড়ায়। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও যায় রাজা সাইজি। এলাকার সব মানুষ তাকে রাজা বুলিই ডাকে।’
এই মানুষটির রাজার বেশে চলাফেরাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন গ্রামের সব মানুষ। বর্তমান যুগে অনেকে সত্যিকারের রাজা দেখতে না পারলেও রাজার বেশে আব্দুল কাদেরকে দেখে খুশি সব বয়সের মানুষ। চৌপুকুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা শাহজাহান আলী জানান, আব্দুল কাদের দীর্ঘদিন যাবত্ দিনে রাজার পোশাকে গÌামে চলাফেরা করেন। তিনি এই গ্রামের সব থেকে সৌখিন ব্যক্তি।
একটু পরই ঘোড়া নিয়ে রাজা ফিরে এলেন। ঘুঙুরের শব্দ পেয়েই বাড়ির লোকজন আবার ছুটে বাইরে বের হলেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, আব্দুল কাদের সত্যিকারের রাজা না হলেও পরিবারের সদস্যরা তার সখপূরণে বিভিন্নভাবে সাহাঘ্য করেন এবং এতে তারাও গর্বিত বলে জানান।
আলাপে আব্দুল কাদের জানান, দারিদ্রে্যর কারণে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি আব্দুল কাদের; ছেলে-মেয়েদেরও লেখাপড়া করাতে পারেননি। বাড়িঘরের অবস্হা শোচনীয়। নিজের বাড়ি বলতে ইটের দেওয়ালের ওপরে টিনের ছাউনি। তার মধ্যেই নিজের ঘরটা যেন জাদুঘর। দেওয়ালে সারি সারি ঘোড়ার চাবুক, তলোয়ার, বেল্ট, ঘোড়ায় চড়া অবস্হায় ছবিসহ নানা জিনিস সাজিয়ে রেখেছেন।
স্হানীয়রা জানান, পেশাগত জীবনে রাজা আব্দুল কাদের কাঁঠালবাড়িয়া বাজারের একজন নৈশপ্রহরী। তখন অবশ্য খুলে রাখেন রাজপোশাক। সঙ্গী কুকুরকে নিয়ে গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। রাতের অন্ধকারে তখন রাজার অন্য বেশ। এক একদিন টহল দিয়ে ২০০ টাকা করে পান। এর মধ্যে নিজের খরচের জন্য রেখে দেন ৬০-৭০ টাকা। বাকি সবটাই লেগে যায় ঘোড়ার খাবারের জন্য। সংসারের যাবতীয় খরচ মেটান তার তিন ছেলে। রাজকোষহীন এই রাজার একমাত্র সম্পদ মানুষের ভালোবাসা। তার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয়, তার মতো সুখী মানুষ আর হয় না।
কেন তার এই রাজা হওয়ার নেশা, জবাবে আব্দুল কাদের বলেন, ‘রূপবান যাত্রায় দেখেছিলাম, জরির পোশাক আর তাজি ঘোড়া ছাড়া তাজেলকে স্কুলে যেতে দিচ্ছিল না। তখন বনরাজ উসমান বাদশার কাছ থেকে জরুরি পোশাক আর ঘোড়া এনে দিল। তাজেলের রাজকীয় পোশাক আর ঘোড়া সেই যে আমার মন কেড়ে নিল, তার পর থেকেই মনে হয় আমিও রাজা।’
সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশের কুড়ি উত্তীর্ণ যুবকের হঠাৎ মনে হয়, তিনিই রাজা। এরপর একদিন সেই রাজাদের আদলেই সাজিয়ে তুললেন নিজেকে। তখন তিনি মাঠে খেতমজুরি করতেন। কিন্তু রাজা হয়ে তো আর খেতমজুরি করা চলে না। তাই শেষ পর্যন্ত সেই কাজ ছেড়ে দিলেন তিনি। সঞ্চয়ের ৪০০ টাকা দিয়ে একটি ঘোড়া কিনে ফেললেন। ঘোড়াকেও সাজালেন রাজার ঘোড়ার বেশে।