।। সালাম গফফার ছন্দ ।।
মা,মাগো!তুমি আমার জন্য আর কেদনা মা!আমার জীবন আয়ূ শেষ হয়ে এসেছে!সেই ডাক শুনতে পাচ্ছি,কথাটি বলতে বলতে পাশ ফিরে শোয় সেলিম!সেই সাথে ওর দুচোখ বেয়ে কয়েক ফোটা তপ্তাশ্রু গড়িয়ে পড়ে!‘খোকা!যাদু আমার,মনিআমার,অমন কথা মুখে আনতে নেই!আমার মন বলছে,তুই সেরে উঠবি বাপ!তাছাড়াডাক্তার ডাকতে পাঠিয়েছি!এখনি হয়ত এসে পড়বে!এখন একটু ঘুমো খোকা’-মা করিমুন্নেসা চুপ করে ছেলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন!মায়ের এই সান্ত্বনারবাণী যেন পীড়িত সেলিমের আশার আলোর সন্ধান এনে দেয়!তাই সে ধীরে ধীরে ঘুমের দেশে পাড়ী জমায়!সন্ধ্যা তখনো আসেনি চঞ্চল মুখর ধরণীর বুকে!খোকাকেঘুমুতে দেখে বিধবা জননী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে আসেন খোকার শিয়র থেকে!এদিকে সন্ধ্যার পিদিম জ্বালতে হবে!বোতলে কেরোসিন তেল আছে কিনা তাও দেখা হয়নি!এমন সময়ে ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে মিলি,মাকে ডাকতে ডাকতে ঘরেপ্রবেশ করে!ডাক্তার সাহেবের আগমনের সাড়া পেয়ে করিমুন্নেসা বেগম লম্বা ঘোমটা টেনে পীড়িত খোকার পাশে যেয়ে দাঁড়ান!ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন,‘সেলিমের অসুখ কত দিন হয়েছে কাকী আম্মা?‘তা সপ্তাহ খানেক হবে বাবা!‘ঔষধ পথ্য কি কিছু খাইয়েছেন?হাতের নাড়ী পরীক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করেন ডাক্তার মাহমুদ!
‘না বাবা,এখনো ডাক্তার দেখানো হয়নি!তাছাড়া মাঝে মাঝে প্রায়ই ও রকম হয়ে থাকে!আবার আপনা আপনি সেরে যায়!এবারও তাই ভাবলাম,আপনা আপনি সেরে যাবে,অথচ-!ব্যাগ খুলতে
থাকেন ডাক্তার!ঔষধ দিয়ে পুনরায় বলেন,‘রাতে একবার,আগামী কাল দুপুরে আর পরশু সকালে এ গুলি খাওয়াবেন!আমি পরশু একবার এসে দেখে যাওয়ার চেষ্টা করব’-বলা শেষে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ান ডাক্তার যাওয়ার জন্য!মা করিমুন্নেসা শাড়ির আঁচল থেকে পাঁচটি টাকা বের করে তা ডাক্তারকে দিয়ে বলেন,বাবা,আপাতত এই পাঁচটি টাকা নাও,বাকিটা জোগাড় করে পাঠিয়ে দেব’!ডাক্তার মাহমুদ টাকা পাঁচটি পকেটে রেখে প্রস্থান করেন!
সকাল হয়েছে!সূর্য তার আগমনী বার্তা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে! সেলিম গত কালের চেয়ে বেশ সুস্থ!ঘুম থেকে উঠে সে হাত মুখ ধুয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে! এমন সময় মা করিমুন্নেসা এসে বলে,‘খোকা বাপ!তোদের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে! তুইনাকি পাশ করেছিস! আদর সহকারে কথা গুলো বলে থামেন করিমুন্নেসা বেগম!‘কে বললে মা?উৎসুক নেত্রে জিজ্ঞাসা করে সেলিম! ‘খলিলের আব্বা এই মাত্র শহর থেকে শুনে এসেছেন! মায়ের কথা মনোযোগ সহকারে শোনে সে! কিছুক্ষণ নীরবে থেকে ডাকে,মা-! ‘কি খোকা’?‘ মা,আমি একবার কলেজের অধ্যক্ষ স্যারের বাসায় যাব’-বলে সেলিম মায়ের মুখ পানে তাকিয়ে থাকে! ‘তোর শরীর যে এখনো দুর্বল বাবা! বিস্ময়ে কথাটি বলেন মা! ‘কই মা!আমিত এখন সম্পূর্ণ সুস্থ! আমি যেতে পারব! আমার একটুও কষ্ট হবেনা! তুমি কিচ্ছু ভেবনা আমার জন্য’! কথা গুলো বলতে বলতে সে উঠে দাঁড়ায়! খোকাকে উঠতে দেখে মা করিমুন্নেসা বেগম বাধা দিলেন না! কারণ,খোকা যে তার একগুঁয়ে ছেলে তা তিনি ভালো করেই জানেন! মনে মনে আশীর্বাদ দেন খোকাকে! খোকা তার মানুষ হউক,সমাজের বড় শিক্ষিত হউক! সেলিম জামা কাপড় পরে রওনা হয়ে যায়! মনিপুর থেকে শহর বেশ কিছু দূরে! মিনিট পাঁচেকের পথ!যেতে কিছু সময় লাগবে তাঁর! ছেলের গমন পথের পানে একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন করিমুন্নেসা,যতক্ষণ দেখা গেল ততক্ষণ দাঁড়ায়ে দেখলেন! তারপর দিন যেয়ে রাত এলো কিন্তু সেলিম এখনো ফিরে এলোনা! তার মা ও একমাত্র ছোট বোন মিলি ভীষণ চিন্তা যুক্ত! খোকা দুর্বল শরীর নিয়ে শহরে গেছে! মায়ের মন তাই দারুন উদ্বিগ্ন! মাকে মলিন বদনে থাকতে দেখে মিলি নানান কথা বার্তা শুনিয়ে খুশি করার চেষ্টা করে! কিন্তু মা সে সকল কথায় শান্তি পায়না! চিন্তা শূন্যের চেয়ে আরো চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েন! এমনিভাবে কয়েক দিন কেটে যায় দুঃখকষ্টের মধ্যে দিয়ে! সেলিম আজো ফিরে আসেনি!
সেলিমের জ্ঞাণ ফিরে এসেছে!চোখ মেলতে দেখতে পায় সে অধ্যক্ষ স্যারের বাসায় পরিষ্কার ধবধবে বিছানায় শায়িত! আলনায় টাঙ্গানো ধূলা মাটি মাখা শার্ট! পরনের প্যান্টের অবস্থাও অনুরুপ! শাহানা তার পাশে বসে মলিন বদনে! তাকে দেখে সেলিম আশ্চর্য হয়! অদ্ভূত ঠেকে তার কাছে! মনে হয় যেন সে আর কখনো আসেনি এ বাড়ীতে! সব তার যেন নতুন বলে মনে হয়! কলেজ অফিসে জ্ঞাণ হারিয়ে ফেলায় তাঁকে অধ্যক্ষ স্যারের বাসায় নিয়ে আসেন! এখানেও সেলিম কয়েক বার জ্ঞাণ হারায়! জ্ঞাণ ফিরলে অনেকক্ষণ ও শাহানার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে! অধ্যক্ষ দূহিতা মৃদু হেসে বলে, অমন করে কি দেখছ সেলিম’? কই না’ত! আচমকা উত্তর দেয়সে! ‘তবে-! ‘মা যেন আমাকে ডাকছেন! মনে হচ্ছে আমার ঘরে সন্ধ্যা পিদিম জ্বালতে প্রদীপ হাতে দরজার করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে! আমি বাড়ী যাব’! তুমি অসুস্থ; সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যেতে পারবে না! সুস্থ হলে তোমাকে পাঠিয়ে দেব’-সমবেদনার সাথে কথা গুলো বলে শাহানা! সেলিম গভীর চিন্তায় মগ্ন থেকে হঠাত ভাঙ্গা কন্ঠে ডাকে,শানু’! ‘কি সেলিম? ‘তোমার বিয়ে কবে? ‘বিয়ে! বিয়েত আগেই হয়ে গেছে আমার! আবার কেন হবে? ‘ছি!ও-কথা বলতে নেই! তোমার আব্বু-আম্মু জানতে পারলে অসন্তুষ্ট হবেন!
আর আমিত ওপারের দীপ জ্বালিয়ে বিদায় নিতে চলেছি! তুমি আর অমত করনা শানু’-বলতে বলতে সেলিম উঠে বসে! বেলা তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিম গগনের রক্তিম ভালে! মায়ের কান্না যেন তাঁর কানে এসে আঘাত করে বলছে, ‘ওঠ তোর জন্য মা জননী পিদীম হাতে এখনো অপেক্ষা করছে! তুই ফিরে যা,ফিরে যা ঘরে! কোন কথা না বলে সে আলনা থেকে জামাটা নেয়। গায়ে দিতে দিতে কাওকে কিছু না বলে হন হন করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে রাস্তায়! দূর থেকে সেলিম শুনতে পাচ্ছে তাঁর মায়ের সেই সাঝের বেলার করুণ ডাক! ঝড়ের বেগে ছুটতে থাকে সে! তাঁকে অমন ভাবে ছুটতে দেখে শানুও ঘর থেকে বের হয়ে পিছু নেয় ওঁর!
জননী করিমুন্নেসার শারীরিক অবস্থা শোচনীয়! সেলিম সপ্তাহের বেশী হলো শহরে গেছে ফিরে আসেনি! সে যাওয়ার পর থেকেই তিনি বিছানা নিয়েছেন! এখনো অসুখ ছাড়েনি! এতদিন অনর্গল ঔষধপথ্য দিচ্ছেন ডাক্তার কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা! ঘন্টায় ঘন্টায় ছেলের নাম ধরে ডাকছেন আর প্রলাপ বকছেন ‘সেলিম, সেলিম ফিরে আয় বাবা! তোর ঘরে ঘরে সাঁঝের পিদীম জ্বালতে হবে! -বলতে বলতে জননী করিমুন্নেসা বেগম অসুস্থ শরীরে উঠে দাঁড়িয়ে থাকেন খোকার অপেক্ষায়। জ্বলন্ত সূর্য দিনের কর্ম শেষে বিদায় নিয়েছে সময়ের সিঁড়ি থেকে! সেই সাথে আঁধারের কালো পাহাড় মাথা উঁচু করে গ্রাস করেছে ধরণীর শূন্য বুক! অসুস্থ জননী করিমুন্নেসা বেগম সাঁঝের পিদীম জ্বেলে খোকার ঘরে যান! মিলি তখন রান্না ঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত! মা ছেলের ঘরের জানালা খুলে আবার বলতে থাকেন, ‘খোকা বাপ আমার,যাদু আমার তুই ফিরে আয় বাবা! তোর ঘরে আলো জ্বেলে দিয়েছি’-বলতে বলতে বসে পড়ে ডাকতে থাকে পাগলীনির মতো! সেলিম সে ডাক যেন শুনতে পায় বহু দূর থেকে! সে ছুটতে থাকে জোরে উল্কার গতিতে! অবশেষে বাড়ীর উঠানে এসে ডাকে-মা, মাগো! তোমার কান্নার ডাক আমি শুনতে পেয়েছি মা’! বলতে বলতে দৌড়ে বাড়ীতে প্রবেশ করে! ভাইয়া’কে দেখে মিলি ছুটে আসে এবং কেঁদে উঠে, ভাইয়া’! ‘কি মিলি! মা, কই? ‘তোর ঘরে, ভাইয়া’! মা নির্বাক হতবাক মুক হয়ে বসে আছে! কোন কথা নেই; ভাষা নেই! কথা বলছে না! হাতে পিদীম জ্বলছে! মিলি মায়ের শরীরে হাত দিয়ে কেঁদে উঠে বলে, ‘ভাইয়া! মা নেই’! সজোরে কাঁদতে থাকে মিলি! মা নেই এ কথাটি ছোট বোন মিলির কাছে শুনতেই, এ্যা! মা নেই! অস্ফুট স্বরে’-কাঁদতে পারেনা সেলিম! কাঁদার শক্তি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে! সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করে দেখতে পায় মিলি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে! সেলিমের দু’চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে মুক্তাশ্রু ধারা! নিস্প্রাণ মা জননী প্রদীপ হাতে তেমনি সোজাভাবে বসে আছে খোকার অপেক্ষায় সেলিমের এক পাশে! মা’র ডাক সন্ধ্যাধারের বুক চিরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে ব্যাথা হয়ে! ‘বাপ আমার! যাদু আমার! ফিরে আয়! তোর ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ জেলে দিয়েছি’! শানুও নিষ্প্রাণ পাথরের মতো মুক হয়ে চেয়ে থাকে! দু’চোখে নামে ওর তপ্তাশ্রু ধারা! সেই সাথে সাঝের প্রদীপও যেন কাঁদে অঝোরে.........!
#### রচনাকাল-২৮/৭/১৯৭৭ খ্রিঃ,১২/৪/১৩৮৪ বঙ্গাব্দ! দৈনিক স্ফুলিঙ্গএ প্রকাশ,৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৫, রবিবার!