।।সালাম গফফার ছন্দ।।
অনেক কষ্টে লালু নিজেকে টেনে নিয়ে এসেছে বুড়ো বটতলায়!আর যেন বয়ে নিতে পারছেনা নিজেকে! সারা দিন অনাহারে কেটেছে! এক ফোটা দানাপানিও পড়েনি তার পেটে! শরীরের শক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে আসতে চাইছে! এত বড় পৃথিবী,কোথাও মানুষের এতোটুকু বিরাম নেই! যেদিকে দু’চোখ যায় সে দিকেই মানবের অবাধ বিচরণ! কেহ ভুক্ত কেহ অভুক্ত আর কেহবা অর্ধ ভুক্ত! লালুর মনে তাই অশান্তির জ্বালা! হয়ত এ জ্বালা আর শেষ হবেনা !অনাহারে দৃষ্টির সম্মুখে সে যেন অন্ধকার দেখতে থাকে! বাবা মারা গেছে ষোল বছর বয়সে! এস এস সি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করার পর যখন সে কলেজে ভর্তি হয়েছে মাস চার পাঁচেক হব। সময়টা উনিশশ’ একাত্তর! স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে! সে কারণে পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করা হয়নি! দেশ স্বাধীন হয়েছে! এস এস সি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে! পাশের পর কলেজে এ্যাডমিশন নিয়েছে লালু! বাবা তখনো বেঁচে! কলেজ জীবন চলছে বেশ! কেননা ছাত্র জীবনত’ অনাবিল সুখের জীবন;শান্তির জীবন! তাই সে জীবনের মাঝে সে নিজেকে ডুবিয়ে দিল! সেবারের একটি ঘটনা! তখন লালু সারসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র! পড়া শুনাতে বরাবর মোটামুটি ভাল! তবে যে খুব ভাল বলা যায় না! তবে চলার মতই বলতে হবে!
তাছাড়া,বেশ কয়েকটি গুনেরও অধিকারী সে!সুন্দর হাতের লেখা,গান, কবিতা,ছড়া রচনা করা;গল্প ও উপন্যাস লেখা,স্কুলের বিচিত্রানুষ্ঠানে গান গাওয়া প্রভৃতিতে স্কুলের মধ্যে সে প্রথম স্থান অর্জন করা সহ বিভিন্ন সহ-শিক্ষা কর্মকান্ডে শিক্ষকমন্ডলীর ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছিল বলতে গেলে! বিদ্যালয়ের বিচিত্রানুষ্ঠানের বেলায় সেই ছিল প্রথম এবং অদ্বিতীয়! তাইত সেবারের অনুষ্ঠানে সকল আইটেমেই প্রথম হলো! সামনে অনুষ্ঠান হবে!তারই তোড়জোড় চলছে বিদ্যালয় চত্বরে! ঘটনাটি উনিশ’শ সত্তরের শেষাবধি! অনুষ্ঠানের সকলব্যবস্থা শেষ হলে যথা সময়ে শুরু হ’ল! নাচ,গান,আবৃতি,বক্তৃতা,কমিক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে এক সময় অনুষ্ঠান শেষও হয়! পুরষ্কার বিতরণীর বেলায় দেখা গেল লালু প্রথম না হয় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে! সেদিন তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্যুৎ বেগে! বিশেষ করে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি এবং গানে!
বিকালে বেড়াতে বের হয়েছে হাটতে হাটতে রেল লাইন ধরে! চলে এলো পশ্চিম দিকের ব্রিজটার উপর! এ সময়টা নিরিবিলি! বিশেষ করে ওর জন্যে গান কবিতা লেখার মনোরম পরিবেশ! ও আপন মনে বসে পড়ে ব্রিজের উপর! সূর্য তখন পশ্চিম দিক চক্রবালে অবস্থান করছে! সূর্য যেন পৃথিবীর কর্মকাণ্ডের ইতি টেনে বিদায় নিতে ব্যতিব্যস্ত! দখিনা মলয় মাঝে মধ্যে বেল ফুলের মিষ্টি সুবাস নিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে! ঠিক যেন মনে হয় তার কত আপনজন! বসে বসে ভাবতে থাকে লালু! এলো পাতাড়ি ভাবনা! যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই! ভাবতে ভাবতে এক সময় সে যেন হারিয়ে যায় কোন অজানায়! সার্কেল অফিসার দুহিতা ওর বান্ধবী! আলো তার নাম! কখন যেন সে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে দিকে লালুর একটুও খেয়াল নেই! আপনার ভাবনার মাঝে যেন আত্মহারা! ‘কি ভাবছ?-লালুকে প্রশ্ন করে সামনে আসে আলো! কিন্তু কথাটা তার কানেই যায়নি যেন! নির্বাক নয়নে কি যেন তন্ময় হয়ে দেখছে সে! ‘আলো’ওর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে পুনরায় ডাকে-‘লালু’! চমকে উঠে ও!সম্বিত ফিরে পায়! সেই সাথে চোখ তুলে তাকায় ওর পানে!
‘বাব্বা!কত ডাকা ডাকি করছি,অথচ-! ‘আমি শুনতেই পাইনি,তাই না’? জিজ্ঞেস করে লালু! আলো ওর সামনা সামনি বসে রেল পাটির উপর! তারপর প্রশ্ন করে-এবার বলত,কি ভাবছিলে এমন বিভোর হয়ে? ‘ও এই কথা! শোনো,এই পৃথিবীটা কি বিচিত্র জগত! এখানে কেহ সুখে; কেহ দুঃখে আবার কেহবা সুখদুঃখ কেহটারই নয়; এমনি ভাবেই চলছে যেন! আমাদের চার পাশের জগত সম্পর্কে কেহই খবর রাখিনা’! ‘ও তাই বুঝি তুমি অমন করে খোঁজ নিচ্ছিলে?তা বেশ! এবার বলো দেখি! থেমে আমার বলে,শুনছি আগামি মার্চে ইয়াহিয়া সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পূর্ব পাকিস্থানের রাষ্টীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন? ‘তাইত শুনছি! ‘তাহলেত’ ভালোই হয়’-বলে থামে আলো!
‘আমার মনে হয়না ক্ষমতা হস্তান্তর করবে’! উত্তরে লালু জানায়! ‘কেন?প্রশ্ন করে তাকায় ওর মুখ পানে! ‘ক্ষমতার লোভ! অত সহজে কি ছাড়তে চায়! ‘তা না ছাড়ে না ছাড়ুক’! থেমে আলো আবার বলে,‘আমাদের বাসায় গেলে না কেন তুমি’? গ্রামের বাসায় গিয়েছিলাম,আসতে দেরি হয়ে গেল! তারপর-অনুষ্ঠানের ঝামেলায় কেটে গেল এ ক’দিন! সময় পেলাম কই বলো? ‘আব্বা বলছিলেন,যশোরে একটা বাড়ী কিনবেন, দেখা শুনাও নাকি প্রায় কমপ্লিট! ‘তাই নাকি! তা বেশত! এস এস সি পাশের পর তাহলে সুবিধা হবে! আর আমারও ইচ্ছে বাংলা সম্মান নিয়ে পড়া শুনা করার! তাও সরকারী এম,এম কলেজে! থেমে, ‘আচ্ছা আলো, এইমুহূর্তে যদি তোমাদের বদলির ছাড়পত্র এসে যায়, তাহলে কি করবে? ‘কি আর করব! অবশ্যই তা পালন করতে হবে’! থেমে,তবে সে ভয় নেই! আর এতো তাড়াতাড়ি আমরা ছাড়পত্রের আদেশ পাবনা! আর আসলেই বা কি? আমিত আর পরীক্ষা না দিয়ে অন্য কোথাও যেতে পারছিনা-বলে থামে আলো! ‘আর যেতে চাইলেও আমিতো আর যেতে দিচ্ছিনা কি বলো? হেসে লালু থামে! সূর্য ততক্ষণে বিদায় নিতে চলেছে! সূর্যকে বিদায় নিতে দেখে পুনরায় লালু বলে, 'চলো উঠা যাক!সন্ধ্যা আসছে! ‘বেশ চলো’-বলে আলোও উঠে দাঁড়ায়! পাশাপাশি দুজনে ওঁরা এগিয়ে চলে!
দু’বছর পার হয়ে গেছে! পাকিস্তান ভেঙ্গে এখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে! এর মাঝদিয়ে পরিবর্তনের মধ্যে আলো এবং লালু এস এস সি’র ধাপ পেরিয়ে এসেছে কলেজ ধাপে! দু’জন দু’জনের সম্পর্ক হয়েছে আর অটুট এবং গাঢ়! উভয়ে নাভারণ ডিগ্রী কলেজের ছাত্র-ছাত্রী! দু’জনে মনের আনন্দে উপভোগ করছে কলেজ জীবন! সেদিন কলেজ ছুটি শেষে আলো পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে অপেক্ষমান লালুর কাছে! গতি তার ধির মন্থর! মলিন বদন! না জানি অমন সুন্দর মুখে কিসের অঘটন; তাই শান্তি শূন্য! কাছে এসে দাঁড়ায় সে! ‘তোমার মুখ এত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কেন আলো, অসুখ করেনিত? ওকে জিজ্ঞেস করে লালু!‘না’! সহজ ভাবে বেদনাজড়িত কন্ঠে উত্তর সে! ‘তবে কি হয়েছে! আমাকে খুলে বলো আলো’! উৎকণ্ঠার সাথে কথাটি সুধায় ওকে! ‘আব্বার বদলীর চিঠি এসেছে! উত্তেজিত কন্ঠে কথাটি শোনায় সে! ‘কোথায়’? ‘যশোরে! আগামী মাসের পনের তারিখে আমাদের বিদায়ের দিন! কথাটি বলতে গিয়ে আর বলতে পারে না আলো! ওর মুখে কথা শোনামাত্র লালু কেমন যেন বোবা হয়ে যায়! সেই সাথে তাঁর শরীরের স্পন্দন যেন থেমে যেতে চাইল! শরীরটা যেন টলতে থাকে! পড়ে যাবার উপক্রম হয় সে! অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে অতি কষ্টে আপাদের বাসায় চলে আসে! লালুর চলে যাওয়া মুহূর্তে কোন কথা বলতে পারেনি আলো! নির্বাক পুতুলের মতো শুধু শুধু চেয়ে ছিল তাঁর গমন পথের দিকে! লালুর সেদিন কিছু খাওয়া হয়নি! বড় আপা ওকে খেতে ডাকলে সে শুধু বলেছিল‘আপা শরীরটা আজ ভালো নেই! এখন খাবো না! বলাশেষে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজেছিল অনেক্ষণ! তাঁর জীবনে এত বড় আঘাত আসতে পারে তা সে ভাবতে পারেনি! তবে পূর্বে এ ধরনের আভাস ইঙ্গিত সে কিছুটা পেয়েছিল বলতে হবে! তাইত মাঝে মাঝে মন তার অজানা ব্যথার আশঙ্কায় কোথায় যেন হারিয়ে যেত! ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এলো আলো’দের বিদায় নেবার দিন! সেদিন আর লালুর কলেজে যাওয়া হলো না! ইতিমধ্যে আলো দুতিন বার ঘুরে গেছে এখান থেকে! দুঃখ ব্যথা-বেদনার জ্বালা সইতে না পেরে আলো’দের বিদায় বেলা অভ্যর্থনা জানাতে যেতে পারেনি লালু! আলো অনেক আশা নিয়ে পথ চেয়েছিল তাঁর অপেক্ষায়! লালু আসবে হাসি মুখে তাদের বিদায় দিতে! কিন্তু দেখল সে যখন এলো না তখন আলো’দের পরিবার মলিন বিষন্ন বদনে ব্যথা ভারাক্রান্ত প্রাণেই বিদায় নিল সারসা থেকে! আলো চলে গেছে! বিকেলে বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলেই চলে আসে লালু! বেদনা ভারাক্রান্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে রওনা দেয় সে বাড়ীতে! বেলা তখন গড়িয়ে যাবার উপক্রম! চৈত্রের দিন! সূর্যতাপে সমস্ত পৃথিবী জ্বলে পুড়ে যেন ছাই হয়ে যেতে চাচ্ছে! অসুস্থ শরীর মন যেন আর চলতে চায়না! তাই সে একটু খানি বিশ্রামের আশায় বুড়ো বট গাছ তলার ছায়ায় বসে পড়ে! এখনো মাইল খানেক পথ! যত কষ্টই হোক এটুকু চলতেই হবে তাঁকে! বড় আশা নিয়ে চলতে শুরু করে সে! চলতে চলতে অবশেষে এসে উপস্থিত হয় ওদের বাড়ীর আঙ্গিনায়! কিন্তু এতো শোরগোল কিসের! কিসের জন্যই বা এতো কান্নাকাটি! তাহলে কি-!এমন সময় কাকা জাহিদ এসে লালুকে পাজাকোলা ধরে বলে, ‘বাবা তোর আব্বু 'ছাড়পত্র' নিয়ে পরপারে চলে গেছেন’!
‘আব্বা-ছাড়পত্র’-বলতে পারেনি লালু! অতটুকু বলা মাত্রই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে! অনেক্ষণ জ্ঞান ফেরেনি তাঁর! কতক্ষণ তা সে বলতে পারেনা! তবে জ্ঞাণ ফিরলে সে দেখতে পায় বিছানায় শুয়ে আছে! দু’চোখের কোণ বেয়ে ঝরছে তার অবিরাম অশ্রুধারা! কিছুই যেন স্মরণে আসে না তাঁর! শুধু এইটুকু আবছা আবছা মনে পড়ে ‘ছাড়পত্র’!
######## দৈনিক স্ফুলিঙ্গএ ১৫ মার্চ ও ২৫ মার্চ ১৯৮৬’র সংখ্যায় প্রকাশিত! ###########