আলজাজিরার অনুসন্ধান রিপোর্টঃ ভারতে ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওয়াকফ সম্পদ যেভাবে লুট হচ্ছে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মার্চ ২৭, ২০২৫, ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ /
আলজাজিরার অনুসন্ধান রিপোর্টঃ ভারতে ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওয়াকফ সম্পদ যেভাবে লুট হচ্ছে

ওয়াকফের জমিতে নির্মিত শতাব্দী প্রাচীন তাকিয়া মসজিদ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয় ভারত সরকার। সংগৃহীত

খোদ ভারত সরকার পর্যন্ত মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পদ আইনের মারপ্যাঁচে লুণ্ঠন করছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা অনুসন্ধানী এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজ্জয়নি শহরে একটি হিন্দু মন্দির সম্প্রসারণের জন্য বিজেপি সরকারের ‘ওয়াকফ’ জমি অধিগ্রহণ ভারতজুড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওয়াকফ সম্পদ লুণ্ঠনের একটি বৃহত্তর প্রক্রিয়ার প্রতিফলন।

মধ্য প্রদেশের উজ্জয়নি শহরে বাড়ি, দোকান এবং শতাব্দীর প্রাচীন তাকিয়া মসজিদসহ প্রায় ২৫০টি সম্পত্তি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলে, ২.১ হেক্টর (৫.২৭ একর) বিস্তৃত জমি খালি করা হয়। জমিটি মধ্য প্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের ছিল। ‘ওয়াকফ’ বলতে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বোঝায়- মসজিদ, স্কুল, কবরস্থান, এতিমখানা, হাসপাতাল এমনকি খালি জমি- যা মুসলমানরা ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে দান করে, যার ফলে এই ধরনের সম্পত্তি হস্তান্তর অপরিবর্তনীয় এবং বিক্রয় ও অন্যান্য ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু উজ্জয়নির ওয়াকফ জমি তথাকথিত মহাকাল করিডোরের জন্য অনুমোদন করা হয়, যা শহরের বিখ্যাত মহাকালেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে এক বিলিয়ন ডলারের একটি সরকারি প্রকল্প।

২০ কোটিরও বেশি মুসলিমের আবাসস্থল ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পদ রয়েছে- ৮,৭২,০০০ এরও বেশি সম্পত্তি, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১৪.২২ বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি রাজ্য এবং ফেডারেল-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ওয়াকফ বোর্ড এগুলো পরিচালনা করে। একত্রে, ওয়াকফ বোর্ডগুলো ভারতের বৃহত্তম নগর জমির মালিক এবং যথাক্রমে সেনাবাহিনী এবং রেলওয়ের পরে তৃতীয় বৃহত্তম।

ভারতীয় সংসদে সম্ভবত এই সপ্তাহে কয়েক দশক ধরে প্রচলিত ওয়াকফ আইনের সংশোধনী নিয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে। এই আইন ওয়াকফ বোর্ডগুলোকে পরিচালনা করছে এবং যা বছরের পর বছর ধরে তাদের হাতে আরো বেশি ক্ষমতা অর্পণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) প্রস্তাবিত এই সংশোধনী বিলটি ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর সরকারকে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এনে দিতে পারে।

মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, মোদি প্রশাসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আরো কোণঠাসা করার জন্য তার সংসদীয় শক্তি ব্যবহার করছে। কিন্তু টেলিভিশন স্টুডিওতে আলোচনার ক্ষেত্রে বিতর্কটি প্রাধান্য পেলেও, কিছু কর্মী এবং আইনজীবী উজ্জয়নি মামলাকে দীর্ঘকাল ধরে ওয়াকফ সম্পত্তিগুলোকে জর্জরিত করে এমন আরো গভীর সমস্যার উদাহরণ টেনে বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনার ফলে দখলদারিত্বের সৃষ্টি হয়েছে, যা আগামীতে সংশোধিত আইন আরো খারাপ করতে পারে।

আলজাজিরা অনুসন্ধানে দেখা যায় সরকারি কর্মকর্তা পরামর্শ দেন যে, ওয়াকফ জমি অধিগ্রহণের জন্য রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড থেকে ‘অনাপত্তিপত্র’ নেয়া উচিত। কিন্তু জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদেশ জারি করে বলা হয় ‘সামাজিক উদ্দেশ্যে (জমি) অধিগ্রহণ করার সময় কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই।’ এর আগে উজ্জয়নি অধিগ্রহণকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী সোহেল খান বলেন যে, ‘এই অধিগ্রহণ ওয়াকফ আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।’ যখন আলজাজিরা মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং উজ্জয়নির একজন বিজেপি নেতা সানাওয়ার প্যাটেলকে জিজ্ঞাসা করে যে, কেন তিনি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেননি বা ক্ষতিপূরণ দাবি করেননি, তখন তিনি জানান, ‘দল যা আদেশ দেবে আমি তাই করব কারণ আমি এখানে দলের জন্যই আছি।’ প্যাটেল আরো স্বীকার করেন যে রাজ্যের ৯০ শতাংশেরও বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি হয় দখল করা হয়েছে অথবা আদালতে মামলা চলছে।

এদিকে, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখপাত্র আশিস আগরওয়াল দাবি করেছেন যে, রাজ্য সরকার ‘তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং নির্ধারিত আইন অনুসরণ করে’ উজ্জয়নির জমি অধিগ্রহণ করেছে।

‘ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না’ : ১৯৫৪ সালের ওয়াকফ আইনের অধীনে ভারতের ওয়াকফ বোর্ডগুলো প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তখন থেকে, মুসলিমরা সরকারের সহায়তায় সংস্থাগুলো পরিচালনা করে আসছে। পরবর্তী বছরগুলোতে আরো আইন পাস হয়- ১৯৯৫ এবং ২০১৩- ওয়াকফ বোর্ডগুলোকে আরো ক্ষমতা প্রদান করে এবং এমনকি ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালও গঠন করে, যা ওয়াকফ সম্পত্তি সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিকল্প আদালত।

কিন্তু গত মাসের শেষের দিকে, মোদির মন্ত্রিসভা ওয়াকফ (সংশোধন) বিল, ২০২৪ খসড়া অনুমোদন করেছে, যেখানে পুরাতন আইনের ১৪টি সংশোধনীর প্রস্তাব রয়েছে। বিতর্কিত প্রস্তাবিত সংশোধনীর মধ্যে রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হিসেবে অমুসলিমদের নিয়োগ এবং জেলা প্রশাসনের কাছে ‘ওয়াকফ’ বলে বিবেচিত সম্পত্তির বাধ্যতামূলক নিবন্ধন।

বিরোধী দল আম আদমি পার্টির (এএপি) সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং বলেন, এটি মসজিদ এবং দরগাহ (মাজার) জমি দখলের শুরু। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনাস তানভীর আলজাজিরাকে বলেন যে, উজ্জয়নি মামলা ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ওয়াকফ জমির অবক্ষয়ের একটি বৃহত্তর জাতীয় উদ্বেগকে প্রতিফলিত করে। তার মতে ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা এবং দখল দ্বারা জর্জরিত, প্র্রস্তাবিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪ সম্ভাব্যভাবে সমস্যাগুলোকে আরো বাড়িয়ে তুলবে।’

ইচ্ছাকৃতভাবে দখল : পরিকল্পিত সংশোধনীগুলো কিভাবে সরকারকে ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ দিতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, অনেক মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতা এবং আইনজীবী বলেছেন যে বর্তমান আইনের অধীনেও এই জমিগুলো ব্যাপক ভাবে দখল করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনায় সরকারের ইচ্ছাকৃতভাবে দখল, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির দশকের পুরনো ধরন উল্লেখ করেছেন। তারা জেলা রাজস্ব কর্মকর্তা এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ওয়াকফ সম্পত্তির পদ্ধতিগত স্থানান্তর এবং ব্যাপক অবৈধ দখল ও ওয়াকফ জমি ব্যক্তিগত মালিকানায় রূপান্তরের অভিযোগ করেছেন।

তাদের মতে, বেশির ভাগ ওয়াকফ জমি বা সম্পত্তি সরকারের রাজস্ব বিভাগ কর্তৃক ওয়াকফবিহীন ঘোষণা করা হয়েছে, যা রাজ্য সংস্থা ভূমি রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করে এবং কর আদায় করে। মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ড এখন পর্যন্ত তার সম্পত্তির দু’টি জরিপ পরিচালনা করেছে, ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৮০ এর দশকে এবং দেখেছে যে ২৩ হাজারটিরও বেশি সম্পত্তির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল।

২০০০ সালের শেষের দিকে শুরু হওয়া জমির রেকর্ডের ডিজিটালাইজেশন সমস্যাটি আরো জটিল করে তোলে। যেহেতু সফটওয়্যারটিতে কেবল দু’টি কলাম ছিল- সরকারি এবং বেসরকারি- রাজস্ব রেকর্ডে ওয়াকফ-মালিকানাধীন জমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল, তা প্রায়শই সরকারি কলামে স্থানান্তরিত হতো। ওয়াকফ জমি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচারণা চালানো একটি সম্প্রদায়ের সদস্য মাসুদ খান বলেন, এই কারণে, ১৮৫৭ সালে নির্মিত ভোপালের ঐতিহাসিক মতি মসজিদটি একটি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে নিবন্ধিত, যা অযৌক্তিক।

অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি : মুসলিমরা বলছেন যে উজ্জয়নি দখল কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং মধ্যপ্রদেশ এবং ভারতের অন্যান্য অংশে দেখা যাওয়া একটি প্রক্রিয়ার অংশ। ওয়ারসির আবেদনে বলা হয়েছে যে ‘সরকার এবং এর কর্মকর্তাদের নজরদারির অধীনে ওয়াকফ সম্পত্তির পরিকল্পিত এবং ইচ্ছাকৃত লুটপাট চলছে।’ ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ড এবং ফেডারেল সংখ্যালঘু কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক চিঠি সত্ত্বেও, মধ্যপ্রদেশ সরকারকে রাজস্ব রেকর্ডে সংশোধন করার পরামর্শ দেয়া সত্ত্বেও, তারা ‘এই বিষয়ে কান দেয়নি’, যার ফলে ‘ওয়াকফ সম্পত্তি লুণ্ঠন অব্যাহতভাবে জারি রয়েছে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ওয়াকফ আইন বিশেষজ্ঞ মেহমুদ প্রাচা আলজাজিরাকে বলেন, ‘ওয়াকফ জমির রেকর্ডের সাথে রাজস্ব রেকর্ডের অমিল দেশব্যাপী একটি সাধারণ ঘটনা যা দখলদারদের খাদ্য জোগাচ্ছে। ওয়াকফ আইন জেলা প্রশাসন বা সরকারকে অননুমোদিত নির্মাণ অপসারণ করতে বাধ্য করে, কিন্তু যখন সরকার নিজেই দখলে লিপ্ত হয়, তখন আইন কাকে সমর্থন করবে?’

ওয়াকফ বোর্ডের সদস্যরা বলছেন যে, ভোপাল, ইন্দোর এবং মধ্যপ্রদেশের অন্যান্য শহরে শত শত ওয়াকফ সম্পত্তি হয় রাজ্য সরকার দখল করেছে অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে রয়েছে। মধ্যপ্রদেশ পুলিশ সদর দফতর, ভোপাল পুলিশ কন্ট্রোল রুম, ট্রাফিক পুলিশ স্টেশন এবং অন্যান্য অনেক সরকারি অফিস ওয়াকফদের মালিকানাধীন মূল্যবান জমিতে নির্মিত, রাজ্যের রাজধানী থেকে ১০০টিরও বেশি কবরস্থান উধাও হয়ে গেছে, যেখানে একসময় প্রায় ১৪০টি ছিল।