ইরানের আরাক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র-সংগৃহীত
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনার সম্ভাবনা নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জল্পনা চলছে, তখন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তিসংস্থা আইএইএর একটি নতুন প্রতিবেদন সে জল্পনায় ঘি ঢেলে দিয়েছে। নতুন এ প্রতিবেদন ঘিরে এখন শুরু হয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া আর রাজনৈতিক তরঙ্গ। এদিকে, ইরান অন্তত নয়টি পরমাণু বোমা বানানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেও ভিন্ন খবরে দাবি করা হয়েছে।
ইরানের অন্যতম জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হামশাহরি অনলাইনের রাজনৈতিক বিভাগ বলছে, আইএইএ যে নতুন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে, সেটি শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নয়, বরং পশ্চিমাদের ইরানবিরোধী পরিকল্পনাকেও অনেকটাই খোলাসা করেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপে আইএইএকে ইরানবিরোধী অবস্থান নিতে বাধ্য করার যে কথা বলা হচ্ছিল, এ প্রতিবেদন যেন তারই একটি জের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হোয়াইট হাউস দুইদিক থেকে চাপ প্রয়োগের কৌশল নিচ্ছে। একদিকে তেল আবিবের সামরিক হুমকি ব্যবহার করে তেহরানকে চাপে ফেলা। অন্যদিকে ইউরোপীয় ত্রয়কা- ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির ‘ট্রিগার মেকানিজম’ চালু করার হুমকি দিয়ে ইরানের সাথে চলমান পরমাণু আলোচনাকে ওয়াশিংটনের পছন্দমতো পথে নিয়ে যেতে বাধ্য করা।
এমন অবস্থায় আইএইএর প্রতিবেদন যেন নতুন করে আলোচনার, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পরোক্ষ আলোচনাকে এগিয়ে নেয়ার এক প্রয়াস। আইএইএর প্রতিবেদনের সবচেয়ে প্রথম ও জোরালো প্রতিক্রিয়া আসে ইহুদিবাদী দেশ ইসরাইল থেকে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ লুকাতে পারেননি।
নেতানিয়াহুর অফিস থেকে এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আইএইএ একটি গুরুতর ও স্পষ্ট প্রতিবেদন দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের একাধিক সতর্কতা সত্ত্বেও ইরান পরমাণু বোমা তৈরির পরিকল্পনা থেকে একচুলও সরে আসেনি এ প্রতিবেদনে তাই ফুটে উঠেছে।
আল মায়াদিন টেলিভিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান কূটনৈতিকভাবে ইউরোপকে জানিয়ে দিয়েছে, দেশটি অতীতেও যেমন শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে থেকেছে, এখনো তেমনি ইউরোপের কোনো চুক্তিভঙ্গ বা অতিরিক্ত চাপের জবাব পারমাণবিকভাবে দেবে। তবে এ জবাব হবে পরিমিত ও সুনির্দিষ্ট।
সূত্রটি আরো জানায়, ইউরোপীয় ত্রয়ী বা ত্রয়কা যদি আইএইএকে ব্যবহার করে উত্তেজনা বাড়াতে চায়, তাহলে সেটা ওয়াশিংটনের সাথে চলমান আলোচনাকে জটিল করে তুলবে।
ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতা নিয়েও এবারে প্রশ্ন উঠেছে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের শনিবারের প্রতিবেদনে আইএইএর বরাত দিয়ে বলা হয়, ইরানের হাতে এখন ৬০ শতাংশ মাত্রায় ৪০৮.৬ কিলোগ্রাম পরিমাণ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে। আইএইএর হিসাব অনুযায়ী, এ পরিমাণের কথা বলা হয়েছে। যদি এ মজুদকে আরো সমৃদ্ধ করে ৯০ শতাংশে নেয়া হয়, তাহলে প্রায় নয়টি পারমাণবিক বোমা বানানোর সক্ষমতা অর্জন করবে তেহরান।
কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, আইএইএর প্রতিবেদনে জেরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানোর প্রস্তাব সম্ভবত আগামী বৈঠকে তুলতে পারে। তবে এ ধরনের উদ্যোগ ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে আরো বাড়িয়ে দিতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা আরো কঠিনতর হয়ে উঠতে পারে।
টাইমস অফ ইসরাইল জানিয়েছে, আইএইএর প্রতিবেদনে ইরানের তিনটি গোপন পরমাণু স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সবই ২০০০ সালের আগেও ইরানের ঘোষণাহীন একটি পরমাণু কর্মসূচির অংশ ছিল বলে দাবি করা হচ্ছে।
আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি বারবার জোর দিয়েছেন, ইরান হলো পরমাণু বোমাহীন একমাত্র উন্নত দেশ যারা এত উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। তিনি আবারো তার ভাষায় ইরানের প্রতি পূর্ণ ও কার্যকর সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
আল জাজিরা এ প্রতিবেদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে বলেছে, আইএইএ জানিয়েছে, ইরান তাদের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে। জাতিসঙ্ঘের পরমাণু নজরদারি সংস্থা সতর্ক করেছে, তেহরান হয়তো বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম উৎপাদনের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।
যদিও ইরান এ দাবি বারবার অস্বীকার করে বলেছে, তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি শান্তিপূর্ণ। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেছেন, পরমাণু অস্ত্র ইরানের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ইরানের এ অবস্থান পুরনো ও অপরিবর্তিত। এর আগে রাহবার হিসেবে পরিচিত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহহিল উজমা খামেনি পরমাণু বোমা তৈরি ও মজুদকে হারাম ঘোষণা করে পরিষ্কার ভাষায় ফতোয়া দিয়েছেন।
তেহরানের এক রাজনীতি-বিশ্লেষক আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমি মনে করি, দুইপক্ষই নিজেদের চাপ বাড়াতে চায়। এটি একধরনের কৌশল। আইএইএর প্রতিবেদন ইরানের হাতে আলোচনার একটা হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।’
তিনি আরো বলেন, এ প্রতিবেদনের ফলে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এমনকি ইউরোপ জাতিসঙ্ঘে বিষয়টি তুলতে পারে। তবে এখনো ইরান কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়নি যে তারা বোমা বানাবে। ইরানের দৃষ্টিতে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধি হচ্ছে একধরনের চাপ তৈরির কৌশল, যাতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
আইএইএর নতুন প্রতিবেদন শুধু বিজ্ঞান বা নিরাপত্তার দলিল নয়- এটি এক কথায় ভূরাজনৈতিক কূটনীতির একটি হাতিয়ার। যেভাবে এতে ইরানকে চাপে ফেলার কৌশল দেখা যাচ্ছে, আবার তেহরান যেভাবে এটিকে পাল্টা চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাতে পুরোটাই একধরনের কূটনৈতিক দাবা খেলার মতো হয়ে উঠেছে।
নয়টি সম্ভাব্য পরমাণু বোমার কথা শুনে বিশ্ব আঁতকে উঠলেও প্রকৃত সত্য এই যে, উভয়পক্ষই এ বিষয়কে অস্ত্র নয়, ‘দাবি আদায়ের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে। আর এই খেলায় ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও ইসরাইল সবাই নিজ নিজ পক্ষ থেকে নিজস্ব চাল চালছে।
আপনার মতামত লিখুন :