তেহরানে অনুষ্ঠিত তাদের নামাজে জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ গ্রহণঃ আলজাজিরা
ইসরাইলের সাথে চলতি মাসে সংঘটিত যুদ্ধের সময় নিহত ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শনিবার ইরানের রাজধানী তেহরানে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় শোকাহত মানুষ কালো পোশাক পরে রাস্তায় সারি বেঁধে নামাজে জানাজায় অংশ নেন। খবর : রয়টার্স, সিএনএন, মেহর নিউজ ও ইরান ইন্টারন্যাশনাল।
রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে ছিলেন অন্তত ১৬ জন পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং ১০ জন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার। তাদের জন্য এই জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি, বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল হোসেইন সালামী এবং গার্ডস এয়ারোস্পেস ফোর্সের প্রধান জেনারেল আমির আলী হাজিজাদে।
তাদের কফিন তেহরানের আজাদি স্কয়ারে নিয়ে আসা হয়। কফিনগুলো ফুলের পাপড়ি ও ছবিতে সাজানো ছিল। জনতা ইরানি পতাকা নেড়ে তাদের শ্রদ্ধা জানায়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন প্রেস টিভি বলেছে, সেখানে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রও প্রদর্শিত হয়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘শহীদদের নামাজে জানাজার শোক মিছিল’ নামে পরিচিত এ অনুষ্ঠানে মোট ৬০ জন নিহতের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের মধ্যে চারজন নারী এবং চারজন শিশু রয়েছে।
নামাজে জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী শামখানি। সংঘাতে গুরুতর আহত হয়েছিলেন শামখানি। এ ছাড়া বাকেরি সালামী এবং হাজিজাদে ১৩ জুন অর্থাৎ যুদ্ধের প্রথম দিনেই নিহত হন। ইসরাইলকে সাধারণভাবে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশটি জানায়, তাদের এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রাখা।
তেহরান অবশ্য বহুবার পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। জাতিসঙ্ঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা (আইএইএ) বলেছে, ইরানে সক্রিয়, সমন্বিত কোনো অস্ত্র কর্মসূচির ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই’। শুক্রবার এক শীর্ষ ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা জানান, যুদ্ধ চলাকালে ইসরাইল ৩০ জনেরও বেশি শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং ১১ জন শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে তারা।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানি পক্ষের ৬১০ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৩ জন শিশু ও ৪৯ জন নারী রয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪ হাজার সাত শতাধিক মানুষ। তবে ইরানের একটি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা ৯৭৪ জন, যাদের মধ্যে ৩৮৭ জন বেসামরিক নাগরিক। ইসরাইলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ইরানি হামলায় ইসরাইলের পক্ষের ২৮ জন নিহত ও তিন হাজার ২৩৮ জন আহত হয়েছেন।
পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শন : জাতিসঙ্ঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের অনুরোধ করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তেহরান যেকোনো অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে এমন ইঙ্গিত দেন তিনি।
পোস্টে তিনি বলেন, (আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রোসির) তথাকথিত সুরক্ষা চুক্তির অজুহাতে বোমাবর্ষণের শিকার স্থাপনাগুলো পরিদর্শনের ওপর যে জোর তিনি দিচ্ছেন, তা অর্থহীন এবং সম্ভবত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আরাগচি আরো বলেন, ইরান তার স্বার্থ, জনগণ এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার অধিকার সংরক্ষণ করে।
আইএইএ এক বিবৃতিতে আগেই জানায়, (গ্রোসি) ইরানে আইএইএ পরিদর্শকদের যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন, যেটা সংস্থার সাথে ইরানের স্বাক্ষরিত বিস্তৃত সুরক্ষা চুক্তির আওতায় বাধ্যতামূলক।
খামেনিকে অসম্মান বন্ধের আহ্বান : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি সত্যিই ইরানের সাথে একটি পারমাণবিক চুক্তি করতে চান, তাহলে তাকে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির প্রতি ‘অসম্মানজনক ও অগ্রহণযোগ্য ভাষা’ পরিহার করতে হবে। গতকাল শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেয়া এক পোস্টে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এমন মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ট্রাম্পকে খামেনির কোটি কোটি হৃদয়স্পর্শী অনুসারীদের অনুভূতিতে আঘাত করা বন্ধ করতে হবে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। ট্রাম্পের ‘অসম্মানজনক ও অগ্রহণযোগ্য’ মন্তব্যের নিন্দা জানান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে একটি ভয়ানক ও লজ্জাজনক মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
এর আগে ট্রাম্প নিজের ট্রুথ সোসাল প্ল্যাটফর্মে বলেন, তিনি ইরানি নেতাকে হত্যার হাত থেকে রক্ষা করেছেন। কিন্তু খামেনি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে বরং অবজ্ঞা দেখিয়েছেন। ট্রাম্প লেখেন, ‘আমি জানতাম সে কোথায় আশ্রয় নিয়েছিল। তারপরও আমি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনী ইসরাইল বা যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীকে তার জীবন শেষ করতে দিইনি।’ ‘আমি তাকে একটি ভয়ানক ও লজ্জাজনক মৃত্যু থেকে রক্ষা করেছি, যদিও তাকে বলতে হয়নি ‘ধন্যবাদ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প’!
তেহরানে বিস্ফোরণের শব্দ : ইরানের রাজধানী তেহরানের পশ্চিমে এসলামশাহর এলাকায় একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। অঞ্চলটিতে সাথে সাথে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধবিরতির চতুর্থ দিনে ফের বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল তেহরানে। শুক্রবার শেষ রাতে পশ্চিম তেহরানের এসলামশাহর, শাহরিয়ারসহ বিভিন্ন এলাকায় পর পর কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে ইরানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইরান ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, বিস্ফোরণের পর অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিম তেহরানে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। সেই ভিডিওতে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন কিংবা গোলা- ঠিক কোন যুদ্ধাস্ত্র নিক্ষেপের ফলে বিস্ফোরণ ঘটেছে তা এখনো জানা যায়নি। তেমনি কোথা থেকে হামলা করা হয়েছে বা কারা হামলা করেছে এবং হামলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এসব তথ্যও এখনো অজানা।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বিনিয়োগ : বেসামরিক ও শান্তিপূর্ণ খাতে পরমাণু শক্তি ব্যবহারের জন্য ইরানকে সহযোগিতা করতে চায় ওয়াশিংটন; আর সেই সহযোগিতার খাতিরে ইরানের বিধ্বস্ত পরমাণু প্রকল্পে ৩ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলেছে, চলতি জুনের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র ও অংশীদার ও তেহরানের মধ্যে এ ইস্যুতে গোপনে এ ইস্যুতে আলোচনা চলছে।
অর্থাৎ ইরান ও ইসরাইলের সঙ্ঘাত শুরুর আগেই শুরু হয়েছিল এ সংক্রান্ত আলোচনা। ট্রাম্প প্রশাসনের চারজন কর্মকর্তা এ ব্যাপারে সিএনএনের সাথে কথা বলেছেন। তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরান যেন তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে। অন্য দিকে তেহরান এই ব্যাপারটিকে নিজেদের রেডলাইন বলে ঘোষণা করেছে।
৯ ইরানি সাংবাদিক নিহত : ইরানের একটি সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক ১২ দিনের যুদ্ধে দেশটির ৯ জন সাংবাদিক প্রাণ হারিয়েছেন। বাসিজ মিডিয়া অর্গানাইজেশনের প্রধান মোর্তেজা কার আমুজিয়ান গতকাল শনিবার তেহরানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ও টার্গেট হামলায় দেশের ৯ জনেরও বেশি সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ১২ দিনের এই যুদ্ধে ১০ জনেরও বেশি সাংবাদিক আহত হয়েছেন।