ইসরাইলি সেনা-আরবি পোস্ট
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য ইসরাইল বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের ওপর নির্ভর করছে। এসব অস্ত্রের ব্যবহারে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত ও আহত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ ইসরাইলকে বিমান, নির্দেশিত বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে। এই অস্ত্রগুলো ইসরাইলি সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা শিল্প এখনো এ ধরনের অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।
ইসরাইলি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান ও প্রতিরক্ষা শিল্পের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এক বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বলেন, ইসরাইল ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সামরিক সহায়তা গ্রহণ বন্ধ করতে পারে। নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইসরাইল প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পায়। আমি বিশ্বাস করি, আমরা এমন একপর্যায়ে পৌঁছাব, যেখানে আমরা তাদের থেকে অস্ত্র আমদানি বন্ধ করতে পারব, যেমনটি আমরা অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করেছি।’
কারা ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ওয়াশিংটন অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ইসরাইলকে বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরাইলের প্রচলিত প্রধান অস্ত্র আমদানির ৬৯ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি দশ-বর্ষীয় চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক সামরিক সহায়তার পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই সহায়তার লক্ষ্য ছিল, ইসরাইলকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় ‘গুণগত সামরিক অগ্রাধিকার’ বজায় রাখতে সহায়তা করা। এই তহবিলের একটি অংশ—প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার—ব্যবহার হয় যৌথভাবে উন্নয়নকৃত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন আয়রন ডোম, অ্যারো এবং ডেভিডের স্লিং-এর অর্থায়নে। ১৯৯০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলে অস্ত্রের মজুদ রেখেছে, যার কিছু ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবকে ১০০ বারের বেশি উল্লেখযোগ্য সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার নির্ভুল-নির্দেশিত যুদ্ধাস্ত্র, ছোট ব্যাসের বোমা, বাঙ্কার-বাস্টার বোমা, হালকা অস্ত্র এবং অন্যান্য প্রাণঘাতী সরঞ্জাম। যুদ্ধে মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারের বহু উদাহরণ প্রকাশ পেয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বেসামরিক হত্যাকাণ্ডও। ইসরাইল হলো মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারী—যাকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমান হিসেবে ধরা হয়। ২০২৩ সালে অর্ডার করা ৭৫টি এফ-৩৫-এর মধ্যে ইসরাইল ইতোমধ্যেই ৩৬টি গ্রহণ করেছে।
গাজা যুদ্ধে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী মার্কিন কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে লকহিড মার্টিন, আরটিএক্স, নর্থরপ গ্রুমম্যান, বোয়িং, জেনারেল ডায়নামিক্স, হানিওয়েল ইন্টারন্যাশনাল ও জেনারেল ইলেকট্রিক।
জার্মানি
এসআইপিআরআই-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জার্মানি ছিল ইসরাইলের দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ, যা ইসরাইলের আমদানির ৩০ শতাংশ। জার্মানি মূলত ইসরাইলকে সাবমেরিন, যুদ্ধজাহাজ, স্থল ও নৌযানের ইঞ্জিন এবং বিমান ও সাবমেরিনের জন্য টর্পেডো সরবরাহ করে, যেগুলোর উৎপত্তি জার্মানি অথবা যুক্তরাষ্ট্রে। ২০২২ সালে ইসরাইল জার্মানির সাথে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি করে, তিনটি উন্নত ডাকার-শ্রেণির ডিজেল সাবমেরিন কেনার জন্য, যেগুলো ২০৩১ সালে সরবরাহ হওয়ার কথা। এই সাবমেরিনগুলো বর্তমানে ব্যবহৃত ডলফিন সাবমেরিনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হবে। ২০২৩ সালে জার্মানি ইসরাইলে ৩৬১ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করে—যা ২০২২ সালের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। এর অধিকাংশ রফতানি লাইসেন্স ৭ অক্টোবরের পর দেয়া হয়।
জার্মান সংবাদ সংস্থাগুলোর মতে, এই চালানে ৩ হাজার বহনযোগ্য ট্যাঙ্ক-বিরোধী অস্ত্র এবং ৫ লাখ রাউন্ড গুলি ছিল, যা স্বয়ংক্রিয় বা আধা-স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য ব্যবহৃত হয়। এছাড়া অধিকাংশ রফতানি লাইসেন্স ছিল স্থলযান ও অস্ত্র উন্নয়ন, সংযোজন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য প্রযুক্তির ওপর। গাজা যুদ্ধের সময় ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী জার্মান কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিল রাইনমেটাল এবং থাইসেনক্রুপ। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত নিকারাগুয়ার করা একটি আবেদন প্রত্যাখ্যান করে, যাতে জার্মানিকে ইসরাইলে সামরিক সহায়তা বন্ধ করতে বলা হয়েছিল।
ইতালি
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরাইলের অস্ত্র আমদানির মাত্র ০.৯ শতাংশ ছিল ইতালি থেকে। এই আমদানির মধ্যে হেলিকপ্টার ও নৌ কামান অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতালি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কর্মসূচির অংশীদার এবং এর যন্ত্রাংশ তৈরিতে সহায়তা করে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট আর্মস ট্রেড (সিএএটি) জানিয়েছে, ২০২২ সালে ইতালি থেকে ইসরাইলে সামরিক পণ্য রফতানি ও লাইসেন্সের মূল্য ছিল ১৮.৮ মিলিয়ন ডলার।
জাতীয় পরিসংখ্যান অফিস (আইএসটিএটি)–এর তথ্যে অ্যালট্রিকোনোমিয়া ম্যাগাজিন জানায়, ২০২৩ সালে ‘অস্ত্র ও গোলাবারুদ’ বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৫.৭ মিলিয়ন ডলার। ওই বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২.৩৫ মিলিয়ন ডলারের রফতানি অনুমোদন দেয়া হয়, যদিও সরকারের ভাষ্যমতে যুদ্ধরত দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ। ২০২৪ সালের মার্চে প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইডো ক্রোসেটো পার্লামেন্টে জানান, ইতালি কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে বিদ্যমান চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করে এবং নিশ্চিত করে যে এসব পণ্য বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে না।
গাজার যুদ্ধে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহকারী শীর্ষ ইতালীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল লিওনার্দো। ইতালির বৃহত্তম অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানিটি ইসরাইলি নৌবাহিনীর সা’আর কর্ভেটে ব্যবহৃত ওটো মেলারা ৭৬/৬২ সুপার র্যাপিড ৭৬ মিমি নৌ কামান তৈরি করে। এই কামান ১৬ অক্টোবর ২০২৩-এ গাজার লক্ষ্যবস্তুতে প্রথমবার ব্যবহৃত হয়। ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩-এ লিওনার্দোর আমেরিকান সহযোগী ডিআরএস সাসটেইনমেন্ট সিস্টেমস ১৫.৪ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি পায়, যার আওতায় ইসরাইলের জন্য ভারী ট্যাঙ্ক ট্রেলার তৈরি করা হয়।
যুক্তরাজ্য
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সরকার জানায়, ইসরাইলে তাদের সামরিক সরঞ্জাম রফতানির পরিমাণ ছিল ‘তুলনামূলকভাবে কম’। ২০২২ সালে যার মূল্য ছিল ৫৫ মিলিয়ন ডলার। ব্যবসা ও বাণিজ্য বিভাগের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে এই সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২৪.২ মিলিয়ন ডলারে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ৪২টি সামরিক সরঞ্জাম রফতানি লাইসেন্স জারি করা হয়, আর কার্যকর লাইসেন্সের সংখ্যা ছিল ৩৪৫টি। এসব লাইসেন্সের আওতায় সামরিক বিমান, যানবাহন ও যুদ্ধজাহাজের উপাদান অন্তর্ভুক্ত ছিল। অস্ত্র বাণিজ্যবিরোধী গ্রুপ জানায়, ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্য ইসরাইলকে ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রফতানি লাইসেন্স দিয়েছে, যার বেশিরভাগই ছিল মার্কিন তৈরি যুদ্ধবিমানে ব্যবহৃত উপাদানের জন্য, যা শেষ পর্যন্ত ইসরাইলের হাতে পৌঁছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি গাজায় ইসরাইলি অভিযানে ব্যবহৃত প্রায় ৩০টি সামরিক পণ্যের রফতানি লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করেন।
২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো লাইসেন্স স্থগিতের পরও ইসরাইলে হাজার হাজার সামরিক সরঞ্জাম, যার মধ্যে গোলাবারুদও রয়েছে, সরবরাহ করেছে। তথ্য থেকে প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাজ্য কি সরাসরি ইসরাইলকে এফ-৩৫ যন্ত্রাংশ বিক্রি করছে, যা কেবল লকহিড মার্টিনের মাধ্যমে বিক্রি করার প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী। সরকার দাবি করেছে, এই যন্ত্রাংশ জাতীয় নিরাপত্তা এবং ন্যাটোর জন্য অপরিহার্য। গাজার যুদ্ধে ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী শীর্ষ ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল বিএই সিস্টেমস ও রোলস-রয়েস। এদের জার্মান সহযোগী এমটিইউ ইসরাইলি মেরকাভা ৪ ও ৫ (বারাক) যুদ্ধ ট্যাঙ্কের ইঞ্জিন তৈরি করে। এই ট্যাঙ্কগুলো গাজা উপত্যকায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, যার মধ্যে আল-শিফা হাসপাতাল ও ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালে নভেম্বরের আক্রমণও অন্তর্ভুক্ত।
ফ্রান্স
ইসরাইলে ফরাসি অস্ত্র রফতানির ধরণ অত্যন্ত গোপনীয়। ফরাসি সরকার স্বচ্ছতার অভাবকে কাজে লাগিয়ে অস্ত্র ব্যবসা গোপন রাখে। তবে গাজার যুদ্ধ চলাকালে কিছু তথ্য সামনে এসেছে। ২০২৩ সালে ফ্রান্স থেকে ইসরাইলে ৩৩ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। ফরাসি অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি থ্যালেস, যার আংশিক মালিক সরকার, লাভালে তাদের কারখানায় হার্মিস ৯০০ ড্রোনের জন্য ট্রান্সপন্ডার তৈরি করে। ২০২৪ সালে এই ধরনের অন্তত দু’টি ট্রান্সপন্ডার ইসরাইলে সরবরাহ করা হয়। থ্যালেস ইসরাইলি কোম্পানি এলবিট সিস্টেমসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ওয়াচকিপার ড্রোন প্রোগ্রামের অংশীদার ছিল। ২০২৪ সালের মার্চে ফরাসি তদন্তমূলক ওয়েবসাইট ডিসক্লোজ ও মার্সাক্টুর এক যৌথ অনুসন্ধানে ইসরাইলে অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি প্রকাশিত হলে ফ্রান্সে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। তদন্তে দেখা যায়, মার্সেই-ভিত্তিক কোম্পানি ইউরোলিনক্স ইসরাইলকে এস-২৭ সংযোগকারী বিক্রি করেছে, যা মেশিনগানের গোলাবারুদ বেল্টে রাইফেল কার্তুজ সংযুক্ত করতে ব্যবহৃত হয়।ওয়েবসাইট দু’টিই নিশ্চিত করে যে এই গোলাবারুদ গাজার বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হতে পারে।
বেলজিয়াম
বিশ্বের ২২তম বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক বেলজিয়াম ২০২৪ সালের মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতিত্বকালে ইসরাইলে অস্ত্র রফতানির ওপর ইইউ-ব্যাপী নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানায়। তা সত্ত্বেও গাজায় গণহত্যার সময় ইসরাইলে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রফতানি করা হয়েছে এবং ইসরাইলি সামরিক কোম্পানিগুলোর বেলজিয়ামে কার্যক্রম চালু রয়েছে। ২০২১ সালে বেলজিয়াম ইসরাইলে ২২ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রফতানির লাইসেন্স প্রদান করে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে বেলজিয়ামের কোম্পানি বিপি ক্লারমন্ট ১৬ টন বারুদ ইসরাইলে রফতানি করে, যা অ্যান্টওয়ার্প বন্দর হয়ে পরিবাহিত হয়। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলজিয়াম সরকার এসব লাইসেন্স সাময়িকভাবে স্থগিত করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত ইসরাইলের নেভাটিম বিমান ঘাঁটিতে সামরিক সরঞ্জাম বহনকারী দশটি ফ্লাইট বেলজিয়ামের লিজ বিমানবন্দর ব্যবহার করে। এসব ফ্লাইট ইসরাইলি কার্গো সংস্থা চ্যালেঞ্জ এয়ারলাইন্স পরিচালনা করে। ২০২৪ সালের মে মাসে বেলজিয়াম সরকার তার ভূখণ্ড দিয়ে ইসরাইলে সব ধরনের অস্ত্র পরিবহন নিষিদ্ধ করে, যার মধ্যে ট্রান্সশিপমেন্টও অন্তর্ভুক্ত।
ভারত
ভারত ইসরাইলের অন্যতম ঘনিষ্ঠ অস্ত্র বাণিজ্যিক অংশীদার। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারত ছিল ইসরাইলি সামরিক শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্রেতা, যা তাদের মোট রফতানির ৩৭ শতাংশ।ভারতের সামরিক শিল্প এলবিট সিস্টেমস, রাফায়েল ও ইসরাইল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য বিস্ফোরকসহ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উৎপাদন করে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, গাজায় ব্যবহৃত একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্র ব্যবস্থা -আরবেল- ভারতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থার সাথে যৌথভাবে তৈরি। ২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ভারত ইসরাইলের সামরিক সরঞ্জামের একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী হিসেবে ২৫৮.১১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। এসবের মধ্যে এয়ার রাইফেল বুলেট, রাইফেল কার্তুজের যন্ত্রাংশ, গোলাবারুদ ও শেল অন্তর্ভুক্ত।
স্পেন
ডেলাস সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে স্পেন ইসরাইলে ১ মিলিয়ন ডলারের গোলাবারুদ পাঠায়। ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট আর্মস ট্রেডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে স্পেন ইসরাইলে ১১১ মিলিয়ন ডলারের রফতানি লাইসেন্স ইস্যু করে, যার মধ্যে গোলাবারুদ, যানবাহন/ট্যাঙ্ক ও বিস্ফোরক ডিভাইস অন্তর্ভুক্ত। ২০২৫ সালের এপ্রিলে সুমার জোটের চাপে স্পেন সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য ইসরাইলি কোম্পানি থেকে গোলাবারুদ কেনার একটি চুক্তি বাতিল করে। ২০ মে ২০২৫ তারিখে স্প্যানিশ পার্লামেন্ট ইসরাইলের সাথে অস্ত্র বাণিজ্য নিষিদ্ধের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে। স্পেন ইসরাইলের ফিলিস্তিনি নীতির ধারাবাহিক সমালোচক। ২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর তারা ইসরাইলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিশ্রুতি আরো সম্প্রসারিত করে।
কানাডা
কানাডা সরকার আগে ঘোষণা করেছিল যে তারা ইসরাইলে অস্ত্র চালান বন্ধ করবে। কারণ ইসরাইল কানাডার রফতানি ব্যবস্থার সকল শর্ত পূরণ করছে, এমন নিশ্চয়তা তারা দিতে পারছে না। তবে পরে জানা যায়, এই সিদ্ধান্ত কেবল তখনই প্রযোজ্য হবে যখন রফতানি অনুমোদন এখনো দেয়া হয়নি। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলে ২৮.৫ মিলিয়ন ডলারের নতুন সামরিক রফতানি অনুমোদন করেছে। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে প্রথম দুই মাসে ১৮.৪ মিলিয়ন ডলারের সামগ্রী ‘ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম’ হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। আর অতিরিক্ত ৯.২ মিলিয়ন ডলারের পারমিটে ‘বিমান’, ‘মানববিহীন আকাশযান’ ও অন্যান্য বিমান-সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সার্বিয়া
সার্বিয়ার সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রায়ত্ত অস্ত্র প্রস্তুতকারক জুগোইমপোর্ট-এসডিপিআর ২০২৪ সালের মার্চে ইসরাইলে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রফতানি করে। বলকান ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং নেটওয়ার্ক (বিআইআরএন) জানায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলে দু’টি বড় অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান গেছে। তবে এসব চুক্তি গোপন রাখা হয়েছে। এর আগে ২০২৩ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে সার্বিয়া পশ্চিমাঞ্চলের উজিচিতে অবস্থিত প্রভে পার্টিজান কারখানা থেকে ৮ লাখ ৮৩ হাজার ডলারের পণ্য ইসরাইলে পাঠায়। ২০২৪ সালের মার্চে তথ্য জানার অনুরোধে সার্বিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা প্রত্যাখ্যান করে জানায়, তথ্যগুলো ‘কঠোরভাবে গোপনীয়’।
সুইডেন
২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে সুইডেন থেকে ইসরাইলে অস্ত্র রফতানির লাইসেন্সের মোট মূল্য ছিল প্রায় ১.৫৩ মিলিয়ন ডলার। বেশিরভাগই ছিল নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাসংক্রান্ত। সুইডিশ অস্ত্র পর্যবেক্ষণ সংস্থা সভেনস্কা ফ্রিডস জানায়, ঐতিহাসিকভাবে সুইডেনের রফতানি অল্প হলেও ২০২২ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষে সুইডেনের প্রতিরক্ষা ম্যাটেরিয়াল প্রশাসন ইসরাইলি কোম্পানি এলবিট সিস্টেমসের সাথে ১০ বছরের জন্য ১৭০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
ডেনমার্ক
অস্ত্র বাণিজ্যবিরোধী একটি অভিযানের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ডেনমার্ক থেকে ইসরাইলে রফতানি লাইসেন্সের মোট মূল্য ১ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গবেষণা সংস্থা ড্যানওয়াচ জানিয়েছে, ইসরাইলের এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণে ডেনিশ উপাদান ব্যবহৃত হয়, যা সম্ভবত গাজায় বোমা হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে, অক্সফাম, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং আল-হকের ডেনিশ শাখাসহ কয়েকটি এনজিও ইসরাইলে অস্ত্র রফতানির বিরুদ্ধে ডেনিশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে।
সূত্র : আরবি পোস্ট
আপনার মতামত লিখুন :