ইরান শুক্রবার মধ্যরাতে তার প্রতিশোধমূলক আক্রমণের প্রথম দফা এবং শনিবার ভোরে দ্বিতীয় দফা আক্রমণ শুরু করেছে। ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) জানিয়েছে যে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ ৩’ নামে পরিচিত এ আক্রমণ ‘যতদিন প্রয়োজন’ অব্যাহত থাকবে। ইরানের সেনাবাহিনী (আর্তেশ) তিনটি ইসরাইলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার খবর দিয়েছে। পাশাপাশি দুই পাইলটকে আটক করেছে, যাদের মধ্যে একজন নারী। ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরানের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
মেহের নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, ইরানের সেনাবাহিনীর বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী তিনটি ইসরাইলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান এবং তাদের বিপুল সংখ্যক মাইক্রো এয়ার যান সফলভাবে ভূপাতিত করে ধ্বংস করেছে। ইরানের তাসনিম নিউজ এজেন্সি এবং মেহের নিউজ এজেন্সিসহ একাধিক ইরানি সংবাদমাধ্যম এই খবর প্রকাশ করেছে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলভাবে ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলোকে ভূপাতিত করেছে এবং পাইলটদের আটক করেছে। আটকদের মধ্যে একজন নারী পাইলট রয়েছেন বলেও দাবি করা হয়েছে।
তেহরানে আবাসিক ভবনে হামলায় ইহুদিবাদী সরকার প্রায় ১০০ জন বেসামরিক, সামরিক কর্মকর্তা এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে হত্যা করার পর ইরান ও ইসরাইল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সরকার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং দেশের অন্যান্য অংশে একাধিক সামরিক ঘাঁটিও লক্ষ্যবস্তু করেছে। ইরান, বিনিময়ে, ইসরাইলে পাঁচটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, দখলকৃত অঞ্চল জুড়ে ১৫০ টিরও বেশি সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনা ধ্বংস বা ক্ষতি করেছে। বর্তমানে তারা কামিকাজে ড্রোন দিয়ে আরো ইসরাইলি সম্পদ লক্ষ্যবস্তু করছে, আগামী কয়েক ঘন্টার মধ্যে আরো ভারী ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কা রয়েছে।
পাঁচ দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ইসরাইলে : ইরানের সেনাবাহিনী নিশ্চিত করেছে যে, বেশ কয়েকটি আরাশ কামিকাজে ড্রোন সফলভাবে ইসরাইলের অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে প্রবেশ করেছে এবং তাদের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। অধিকৃত ফিলিস্তিন জুড়ে ইসরাইলি স্থাপনাগুলোতে কমপক্ষে পাঁচ রাউন্ড ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন তৈরি হয়েছে। মধ্যরাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ইসরাইলে সতর্কতা সাইরেন ক্রমাগত বাজছে। ফুটেজে দখলকৃত অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসস্তূপ দেখা যাচ্ছে, ইসরাইলি মিডিয়া এই ধ্বংসযজ্ঞকে শাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে অভিহিত করেছে।
ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম আঘাতের পর, ইসলামিক রেভোলিউশন গার্ড কর্পস (আইআরজিসি,) জানিয়েছে যে, কমপক্ষে ১৫০টি সামরিক ও গোয়েন্দা স্থাপনা, সেইসাথে অস্ত্র তৈরির স্থাপনাগুলোতে আঘাত করা হয়েছে। পরবর্তী ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরে আর কোনও বিবৃতি না থাকলেও, প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে সময়ের সাথে সাথে আক্রমণগুলো তীব্রতর হয়েছে। কিছু ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ইহুদিবাদী সত্তায় আঘাত করা যুদ্ধাস্ত্রগুলোকে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে বর্ণনা করেছে।
ইরানের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি কর্মকর্তারা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে অবস্থান করছেন, কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু হামলার আগেই অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে চলে গেছেন। কয়েক ডজন ইসরাইলি আহত হয়েছেন, কমপক্ষে তিনজন ইহুদিবাদী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
তেহরানে আনন্দ মিছিল : ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামল চালানোর পর তেহরানজুড়ে ইরানের জনতা উল্লাস করেছে। হামলার পর দেখা গেছে যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিপুল মানুষ দেশটির জাতীয় পতাকা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। এ মিছিলে অনেক নারীকেও দেখা গেছে পতাকা হাতে সড়কে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে হুঁশিয়ারি : তেহরানের প্রতিশোধমূলক হামলা বন্ধে ইসরাইলকে সাহায্য না করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সকে সতর্ক করেছে ইরান। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এই তথ্য জানিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদি এই তিনটি দেশ ইসরাইলকে সহায়তা করে, তবে এই অঞ্চলে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটি এবং জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করবে তেহরান।
ইরানে একাধিক শহরে আবারও ইসরাইলি হামলা : বিবিসি পার্সিয়ান বাংলাদেশ সময় বিকাল পৌনে চারটার দিকে ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা ফার্সের বরাতে জানিয়েছে, মাত্র কিছুক্ষণ আগে ইসরাইল ইরানের পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের চারটি স্থানে হামলা চালিয়েছে। ফার্স আরো জানিয়েছে যে শনিবার সকালে ইরানের খোররামাবাদ শহরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। পাশাপাশি, দেশটির কেরামানশাহ শহরেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। তবে ইস্ট আজারবাইজান প্রদেশের তাবরিজ শহরে অবস্থিত তাবরিজ রিফাইনারি’র জনসংযোগ বিভাগ একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে তাদের কোনো স্থাপনার ওপর আক্রমণ করা হয়নি বা কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তাতে এও জানানো হয়েছে যে পরিশোধনাগারের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই চলছে। ইসরাইলে ইরানি হামলায় নিহতের সংখ্যা আরো একজন বেড়ে তিন হয়েছে বলে জানাচ্ছে দেশটির গণমাধ্যম। দেশটির বিরোধী দলের নেতা ইয়ার ল্যাপিড এই তিন ইসরাইলি নাগরিকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন। এদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, শুক্রবার ইসরাইল ইরানে যে হামলা চালিয়েছে, তাতে ৬০ জন নিহত হয়েছেন। নিহতের মাঝে ২০ জন হলো শিশু।
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার তেমন ক্ষতি হয়নি : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার বলেছেন যে ইসরাইলি হামলার পর ইরানের এখনও পারমাণবিক কর্মসূচি আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনার ক্ষতি এখন পর্যন্ত সীমিত বলে মনে হচ্ছে। ইসরাইলের হামলায় ইরানের সামরিক নেতা এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা করা হয়েছে এবং সামরিক কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপনা এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত করা হয়েছে, তবে উপগ্রহ চিত্রে এখনও পারমাণবিক অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য ক্ষতি দেখা যায়নি, বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন। ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটির পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ ডেভিড অ্যালব্রাইট বলেছেন, ‘আমরা ফোরডো বা ইসফাহানে কোনও দৃশ্যমান ক্ষতি দেখতে পাচ্ছি না। নাতানজে ক্ষতি হয়েছে,’ ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কথা উল্লেখ করে অ্যালব্রাইট বলেন, কিন্তু ‘ভূগর্ভস্থ স্থাপণা ধ্বংস হয়ে গেছে এমন কোনও প্রমাণ নেই।’
ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন গ্রহণযোগ্য নয় : ইরানের বিভিন্ন স্থাপণায় হামলার ঘটনায় ইসরাইলের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে চীন। জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি ফু কং শুক্রবার এক জরুরি নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘ইরানের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখ-তা লঙ্ঘনের’ অভিযোগ এনে বলেছেন, ‘এই অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়ানো কারও স্বার্থে নয়।’ ফু কং তার বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘চীন ইসরাইলের এই কর্মকা-ের তীব্র নিন্দা জানায় এবং সংঘাত বাড়ানোর যে কোনো প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে। আমরা ইসরাইলকে সকল ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে উত্তেজনা আর না বাড়ে।’ তিনি সকল পক্ষকে কূটনৈতিক সমাধানের পথ বেছে নেওয়ারও পরামর্শ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা বাতিল : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি আল জাজিরাকে নিশ্চিত করেছেন যে, রোববার ওমানে নির্ধারিত ইরান-মার্কিন পরমাণু আলোচনার পরবর্তী দফা বাতিল করা হয়েছে। শনিবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আমরা কি স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করতে পারি যে রোববারের আলোচনা বাতিল করা হয়েছে?’, আরাঘচি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘হ্যাঁ।’ এর কিছুক্ষণ পরেই, ওমানও নিশ্চিত করেছে যে আলোচনা ‘এখন হবে না’।
ইসরাইলকে গোপনে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র : মিডল ইস্ট আই-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ইরানের উপর বিনা উস্কানিতে সামরিক আক্রমণের কয়েকদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইসরাইলি সরকারকে প্রায় ৩০০টি হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল। মঙ্গলবার পূর্ব-অনুমোদিত ৭.৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র প্যাকেজের আওতায় এই স্থানান্তরটি শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া তেল আবিবের আক্রমণাত্মক হামলায় ওয়াশিংটনের সরাসরি জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরে, যা তেহরানের আবাসিক এলাকাগুলোর পাশাপাশি পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে শুরু হয়েছিল। সূত্র : তেহরান টাইমস, আরটি, আল-জাজিরা. সিএনএন।
আপনার মতামত লিখুন :