রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও কৌশলগত কারণে কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ হয়ে আছে প্রধানতম মিত্র হিসেবে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আমেরিকান জনমতের মধ্যে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই পরিবর্তনটি বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ও কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে স্পষ্ট এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও পরিবর্তিত সামাজিক মূল্যবোধের কারণে এই পরিবর্তন হয়েছে।
সাম্প্রতিক গ্যালাপের একটি জরিপ (৭ থেকে ২১ জুলাই, ২০২৫ সালের মধ্যে পরিচালিত) দেখায় যে- গাজায় ইসরাইলের পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন সর্বকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। মাত্র ৩২ শতাংশ আমেরিকান ইসরাইলকে সমর্থন করেছেন। এছাড়াও মাত্র ৩৮ শতাংশ ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলি সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। অথচ অতীতে কয়েক দশকে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন সমর্থন ছিল ৬০ শতাংশেরও বেশি।
বয়সের দিক থেকে ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন অত্যন্ত কম। মাত্র ৯ শতাংশ গাজায় গণহত্যার প্রতি সমর্থন করছে। এমনকি ৫৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যেও, সমর্থন ৫০ শতাংশ এর নিচে নেমে এসেছে যা নজিরবিহীন হ্রাস। ২০২৫ সালে পিউ-এর আরেকটি জরিপে দেখা গেছে যে- ৫৫ শতাংশ আমেরিকান ইসরাইল সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে যা ২০২০ সালে ছিল ৪১ শতাংশ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের প্রতি সমর্থন হ্রাসের কারণগুলো নিম্নরূপ:
মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্য প্রচার বৃদ্ধির সাথে সাথে গাজা ও পশ্চিম তীরে বেসামরিক হতাহতের ছবি এবং প্রতিবেদন, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের ছবি, ভিডিও ও প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ায় আমেরিকানদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাবকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।
অবৈধ বসতি স্থাপন এবং আবাসিক এলাকায় বোমা হামলাসহ ইসরাইলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো প্রকাশের ফলে জনমতের দৃষ্টিতে ইসরাইলি শাসকগোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের বৈধতা হ্রাস পেয়েছে।
অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জনসংখ্যাগত এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো অনেক আমেরিকানকে ইসরাইলের প্রতি বৈরি করেছে। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে জেনারেশন জেড এবং মিলেনিয়ালরা, পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় ভিন্ন মূল্যবোধের অধিকারী হওয়ায় তারা সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি বেশি উদ্বিগ্ন।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের নীতির সমালোচনা ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে, বিশেষ করে প্রগতিশীল অংশের মধ্যে বেড়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো বিশ্বাস করে যে- ইসরাইলের প্রতি আমেরিকার নিঃশর্ত সমর্থন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এছাড়াও, আঞ্চলিক ঘটনাবলী এবং ইরানের উপর ইসরাইলি আক্রমণ বহু আমেরিকানের মনোভাব পরিবর্তনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৫ সালের জুনে ইরানের উপর ইসরাইলি আগ্রাসন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য ও প্রত্যক্ষ মদদে ইরানের আবাসিক এলাকা, পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ইসরাইলি হামলা এই দেশে অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনেক আমেরিকান, বিশেষ করে ইরানে বেসামরিক হতাহতের ঘটনা প্রকাশের পর, ইসরাইলের প্রতি সমর্থনকে অপ্রয়োজনীয় এবং বিপজ্জনক বলে মনে করেছেন। এ ছাড়াও নির্বাচনী প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ চাপ এবং মিশিগানের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলিতে আরব ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রভাব ইসরাইলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থনকে একটি সংবেদনশীল বিষয় করে তুলেছে।
এই পরিস্থিতির কিছু সুফল আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, জনসমর্থন হ্রাস পেলে আমেরিকান রাজনীতিবিদদের উপর ইসরাইলকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দেয়া পুনর্বিবেচনা করার চাপ বাড়তে পারে। এর ফলে ইসরাইলকে বার্ষিক ৩.৮ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য হ্রাস পেতে পারে অথবা এই সাহায্যের উপর আরো কঠোর শর্ত আরোপ করা হতে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :