বাংলা সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম কবি ফররুখ আহমদ। সাহিত্যের যে জমিনে শুধু অশ্লীলতার খই ফুটতো সেই ধারা থেকে তিনি বেরিয়ে এলেন সৌন্দর্যের বেলোয়াড়ী ঝাড় নিয়ে। সাহিত্যের আঁধারময় আকাশে তিনি ইসলামের আলোকবর্তিকা জ্বেলে দিয়ে পুরো সাহিত্য আকাশকে আলোকিত করেছেন। তাঁর করস্পর্শে সাতসাগরের মাঝির হৃদ দুনিয়াতে প্রচন্ড আল্লাহ প্রেমের ঝড় ওঠে নিন্দাকে তিনি জিন্দাবাদের পুষ্পিত সৌরভে সুবাসিত করলেন।
জীবনের যৌবনে তিনি বামপন্থী রাজনীতি করলেও পরবর্তীজীবনে তিনি একজন পরিশুদ্ধ মুমিন মুসলমান হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর অনুধাবনের পাখায় ভর করে আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত রাসূল (সা;)কে খুব ভালোকরে জেনেছেন ও চিনেছেন। তিনি তাঁর জীবনের যৌবনে কুরআন হাদীস পড়ে নিজে সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং আরবী ফার্সী উর্দূ ভাষাও রপ্ত করেছেন। তাই তাঁর লেখনীতে বেশিরভাগই আরবী ফার্সী শব্দের সমাহার খুঁজে পাওয়া যায়। এই দেশের মুসলমানরা তাই অতিসহজেই তাঁর কাব্য ভাষা গ্রহণ করেছেন অতি সাবলিল ভাবে। বাংলা ভাষার মধ্যে তিনি আরবী ফার্সী শব্দগুলো এমনভাবে প্রবিষ্ঠ করিয়েছেন যা মুসলমানরা সহজেই বুঝতে পেরেছে এবং তিনি তাঁর লেখনী জীবনে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। ইসলামের ক্লান্তিকালে ইসলামকে মুসলমানদের হৃদয়ে ঠাঁই দেয়ার প্রেক্ষাপটে তিনি ইসলামকে পূর্ণজাগরণে মনোনিবেশ কলেছেন তাঁর শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে। তাঁর সাত সাগরের মাঝি কাব্য গ্রন্থ তারই প্রমাণ বহণ করছে। সেখানের একটি কবিতার কয়টি চরণ –
“রাত পাহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী
এখনও তোমার আসমান ভরা মেঘে
সেতারা হেলাল এখনও ওঠেনি জেগে
তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে
একাকী রাতের ম্লান জুলমাত হেরী
রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী”
ইসলামের ঘনদূর্দিনে সাহসী বীর উমর ফারুক, হাঞ্জেলা, সালাউদ্দীন তারেক আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহারদের মতো বিক্ষুব্ধ পারাবারে ইসলামের সুসাজানো নৌকো আভিষ্ঠলক্ষে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য তাঁদের মতো বীরদেকে তিনি আহ্বান করেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ক্ষয়িষ্ণুতার আগল ভেঙে ইসলামের প্রজ্জ্বলতা দিকে দিকে আল্লাহ রাসূলের গুণগান ছড়িয়ে পড়তে। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী সমগ্র ঊপমহাদেশের মুসলমাদের জন্য জিয়ন কাঠি হিসেবে কাজ করেছে। তাই তিনি লিখেছেন ইসলামী সঙ্গীত, লিখেছেন কবিতা ছড়া প্রবন্ধ নিবন্ধ কাব্য নাট্য। তাঁর কবিতার উপজীব্য বিষয়ই হচ্ছে ইসলামী জীবন ও ইসলামী সুসংস্কৃতি মুসলমানদের হৃদয়ে ধারণ করা আর সেই সুমিষ্ট ধারায় যেন প্রতিটি মুসলমান অবগাহন করে পাপময় শরীরকে ঝেড়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা;) এর প্রেমে মশগুল হয়। স্বাপ্নিক কবি ফররুখ আহমদের সেই ইচ্ছাটাই জোরালো ছিলো যা তিনি করতে পেরেছেন। তিনি লেখনী জীবনের যৌবনে একজন ঈমানদার কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন। তিনি কবিতা নাটক প্রবন্ধ ছড়া ছাড়াও অসংখ্য ইসলামী গান হামদ ও নাত রচনা করেছেন যার এলবামও রয়েছে। তিনি রাসুল (সা;) এর প্রশস্তি গেয়ে অনেক নাতে রাসূল লিখিছেন। গীতিকার ফররুখ আহমদ যেমনটি তাঁর নাতে রসূলে রাসূস (সা:) কে নিয়ে লিখেছেন-
“ওগো নূর নবী হযরত/আমরা তোমারি ঊম্মত/ তুমি দয়াল নবী/তুমি মরুর রবী/তুমি বাসলে ভালো জগত জনে/দেখিয়ে দিতে পথ/ওগো নূর নবী হযরত।”
ঈমানী শক্তিকে বলীয়ান কবি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে কিভাবে নিবেদন করে তা দেখিয় ও করিয়ে তিনি পুরো বাংলা সাহিত্য সাম্রাজ্যে যুগ যুগ ধরে বরিষ্ঠতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন । রাসূলের যুগে ইসলামী খেলাফতের সময় বিশ্ব কবি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আশ্লীলতার বিরুদ্ধে লেখনী ধরেছিলেন। তিনি মহানবীর প্রিয় কবিও ছিলেন এবং মাঝে মধ্যে রাসৃলের আনুপস্থিতে ইসলামী খেলাফতের দায়িত্বও পালন করেছেন। কবি বা সাহিত্যিকরা শহীদের সমতুল্য হন আবার তার উল্টোটাও হন। রাওয়াহা শহীদের সমতুল্য হবার আগেই মুতার যুদ্ধে তিনি তৃতীয় সেনাপতি হিসেবে শহীদ হয়েছেন। সুতরাং তিনি মহাশহীদের মর্যাদা আল্লাহর কাছ থেকে পেয়েছেন। কবি ফররুখ আহমদ তাঁর চাকুির জীবনেও ব্যাংকে একটি টাকা রেখে যেতে পারেননি। অত্যন্ত সৎ জীবন যাপনে তিনি ছিলেন বাংলাদেশী কবি সাহিত্যিক ও চাকুরিজীবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠদের শ্রেষ্ঠ। তাঁর লেখনীর আভায় বাংলাদেশী মুসলামনদের আঁধার হৃদ আকাশে জোছনালোকে প্রজ্জ্বলিত করার প্রয়াসী হয়েছেন। আঁধার আবর্তে আর্তনাদ পেরিয়ে দিগন্তে দিগন্তে সত্যের বাতি জ্বালিয়ে মানুষের জীবনকে আলোকে উদ্ভাসিত করেছেন তাঁর লেখনীতে।
তারঁ শ্রেষ্ঠতম লেখনী সম্ভার সিরাজুম মনিরা, নৌফেল, মুহূর্তের কবিতা, হাতেম তায়ী,হাবেদা মরুর কাহিনীসহ অসংখ্য কাব্য গ্রন্থ তিনি বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন রেডিও পাকিস্তানের স্টাফ শিল্পী পরে বাংলাদেশের সময়কালে তিনি রেডিও বাংলাদেশের পরিচালকও হয়েছিলেন। কবি তাঁর মাতা মাতৃভাষা ও দেশকে ভালোবাসার বর্ণালী চাদরে ঢেকে রাখার নিমিত্তে ভাষা আন্দোলনেও তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে পাকিস্তানী শাসকের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে। তাঁর লেখায় বাংলেদেশী মুসলমান উজ্জীবীত হয়ে ছিলো। জীবনের ঘর্মাপ্লুত সময় গরমের অতিষ্ঠতায় মানুষ যখন ঘামিয়ে যায়, তখন মানুষ মাটির পৃথিবীতে মেঘেরা যেন বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে সেই প্রার্থনা তখন মানুষ আল্লাহর কাছে করে থাকে। তাঁর বৃষ্টি কবিতায় তারই চিত্র শতধারে উৎসারিত হয়েছে। তিনি বৃষ্টির কামনা করেছেন আল্লাহর কাছে যেন পাপ পঙ্খিলতা ধুয়ে মুছে যায় আর শির্ক ও গোনাহমুক্ত হয়ে মানুষের হৃদ জমিনে আল্লাহ ও তাঁর রাসৃলের ফসল ফলে। মুসলমানরা যে তাদের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে আন্যপথে চলছে তা দেখে স্বাপ্নিক কবি ফররুখ আহমদের মনে ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাইতো তিনি লিখেছেন”
“পথহারা এই দরিয়া সোঁতায় চলেছো কোথায়
কোন সামীন দৃরে/তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে”
ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। এই ধর্মকে কেউ আটকিয়ে রাখতে পারবে না পারেওনি। ম্রিয়মাণদেরকে উদ্দেশ্য করে কবি ফররুখ আহমেদ তাঁর “তাজী”কবিতায় মুসলমানদের শৌর্য বীর্য গাঁথা সেই সোনালী যুগের শ্রেষ্ঠদের দিকে ইঙ্গিত করার সুপ্রয়াসী হয়েছেন।
ইসলাম ধাবমান। দিকে দিকে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে পড়বে এবং পড়তে থাকবেই। সুতরাং আল্লাহর পথে জান ও মাল দিয়ে প্রতিটি মুসলমানকে চলতে হবেই যা কবি ফররুখের লেখনীতে ফুটে ওঠেছে। বাংলা সাহিত্যের এই শক্তিমান কবি তাঁর ন্যায় এমন কেউ ছিলো না বললেই অতুক্তি হবে বলে মনে হয় না। ইসলামী রেনেসার পূর্ণজাগরণের এই বরিষ্ঠ কবির আশৈশব কাটে তাঁর গাঁয়ে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন পুলিশ আফিসার। কবি ফররুখ আহমদ ১৯১৮সালে ১০ জুন বাংলাদেশের মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানাধীন মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুবরণ করেন ১৯ অক্টোবর ১৯৭৪।
আপনার মতামত লিখুন :