অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
সদ্য প্রয়াত কবি হেলাল হাফিজ তার ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় বলেছেন, -‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখবো না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা। কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস, ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন,-‘পেয়েছি, পেয়েছি’। এই কবিতায় খুবই সহজ করে হেলাল হাফিজ স্বাধীনতার মূল যে চেতনা তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার মতে স্বাধীনতা সাধারণের মধ্যে এক অসামান্য প্রাপ্তি। চব্বিশের ৫ আগস্টের পর এই বোধটুকুই যেন নতুন করে অনভূত হলো। একটি সাধারণ প্রত্যাশাকে প্রাপ্তিতে রূপ দিতে গিয়ে যে অসামান্য ত্যাগ ও আত্মবলীদানের ইতিহাস রচিত হলো তার সুখানুভূতির প্রকাশ ঘটানো মোটেই সহজ কাজ নয়।
২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে উপমহাদেশের জনগণ পেয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তান।
৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবীতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ৫৮-এর মার্শাল’ল বিরোধী আন্দোলন, ৬২-এর শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানের পর আসে সেই ঐতিহাসিক দিন। একাত্তরের ২৬ মার্চ আসে স্বাধীনতার ডাক। আগের দিন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে। অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রতিপক্ষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তারা ভেবেছিলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে পূর্ব পাকিস্তানীদের। কিন্তু তাদের সেই কল্পনার ধংসস্তুপ থেকে যে মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সৃষ্টি হবে তা তারা বুঝতে পারেনি।
বলা হয়, প্রকৃতি তার শুন্যস্থান পূরণ করে নেয়। সেটি সময় কিংবা মানুষ দিয়ে। মার্চ ২৫ কালরাতেই মুজিবের শুন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসেন সেনা বাহিনীর একজন মেজর। তার নাম মেজর জিয়াউর রহমান। এদিন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। এর আগে দিনে চট্টগ্রাম শহরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় প্রবল প্রতিরোধ।
অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে পৌঁছতে না পারে সে জন্য রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগানো হয় বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১টায় চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া আকস্মিকভাবে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে নির্দেশ পাঠান এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য।
এরপর মেজর জিয়া অষ্টম ব্যাটেলিয়নের অফিসার, জেসিও জোয়ানদের জড়ো করেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, তখন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিট। তিনি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ডাক দিলেন। উচ্চারণ করলেন, ‘ডব জবাড়ষঃ’। উপস্থিত সহযোদ্ধাদের সামনে যুদ্ধের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন তিনি।
২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যান মেজর জিয়া। বেতার কর্মীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে পেয়ে উৎফুল্লু হয়ে ওঠেন। কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন যে, আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ভাষণ দেবেন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন তার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। ইথারে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘোষণাটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতারে ধরা পড়ে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। বিশ্ব ও দেশবাসী জেনে যায় বাংলাদেশ নামক এক নতুন দেশের কথা। এই ঘোষণাটি কয়েক দিন ধরে কিছুক্ষণ পর পর প্রচারিত হতে থাকে।
মূলত এটি ছিলো মেজর জিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্ত। সেদিন তিনি এভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তো না। তিনি যদি সেদিন ‘উই রিভোল্ট’ বলে দ্রæততম সময়ের মধ্যে বিদ্রোহের ডাক না দিতেন তা হলে প্রেক্ষাপট ভিন্নও হতে পারতো। অথচ রাজনৈতিক কারণে এখন অনেকেই তার সেই সাহসী সিদ্ধান্ত আর স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেন।
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। লাল-সবুজের পতাকায় শোভিত হয় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের নতুন একটি ভ‚খÐ। তারপর দেশপ্রেমিক জিয়াউর রহমান আবার ফিরে যান সামরিক ব্যারাকে। সেখানে গিয়ে তিনি নিয়মিত চাকরিতে যোগ দেন স্বাধীনতার মহান ঘোষক।
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য তা হলো- যুদ্ধে যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হতো তাহলে নিশ্চিত ফাঁসিতে ঝুলতে হতো জিয়াউর রহমানকে। যার ডাকে সাত কোটি জনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলো এটিই হতো তার ফাঁসির জন্য একমাত্র কারণ। জিয়াউর রহমান বুঝে-শুনেই সেদিন এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধার জীবনে এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর কিছুই হতে পারে না। রাজনীতি ও ইতিহাস গবেষকরা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারের পরমুহুর্তে মেজর জিয়ার দুঃসাহসিক এই আত্মপ্রকাশই একটি স্বাধীন দেশের জন্য প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে।
সেদিন তিনি যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তার স্বীকৃতি রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র গোপণ দলিলেও। তিনি যেভাবে যে ভাষায় বক্তব্যটি দিয়েছিলেন সিআইএ সেভাবেই সেটি সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ভারতের রাষ্ট্রপতি মোরারজী দেশাইও জিয়াউর রহমানকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তার এই কীর্তির কথা নথিবদ্ধ রয়েছে ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খণ্ডও। জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মত লন্ডনের গার্ডিয়ানসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রাখে।
এমনকী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলম্বিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এক সেমিনারে বক্তৃতার এক স্থানে বলেন, ‘শেখ মুজিব এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান, যার সুযোগ এখনো আছে’। ‘ইন্ডিয়া সিকস’ (ওহফরধ ঝববশং) নামক বইতে ইন্দিরা গান্ধীর এ বক্তব্যটি সংকলিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে ভারত সফরকালে দিল্লিতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় ভারতের ততকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি জিয়াকে বলেন, ‘সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা আপনার’।
যুদ্ধ দিনের সফল সমাপ্তির পর দেশের ক্ষমতার মসনদে বসেন শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ৯ মাস দেশের বাইরে থেকে তিনি যুদ্ধদিনের বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারেননি। তাইতো ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তিনি অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়েন। খুব দ্রুতই তার চারপাশে সুবিধাবাদী আর অসৎ লোকে ছেয়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির একটি ছোট্ট দেশকে দুর্নীতিবাজরা অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে। শুরু হয় লুটপাটের মহোৎসব। অর্থ ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে।
চারিদিকে শুরু হয় শোসন আর নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করেন। মানুষের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পাশাপাশি কেড়ে নেওয়া মানুষের রাজনৈতিক অধিকারও। যে শোসন-নির্যাতন আর নিপীড়ণের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রাম সেটি যেন মুহূর্তেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের স্বেচ্ছাচারিতার কারনে। লাখো শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ রাতারাতি পরিচিতি পায় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশে।
শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এখানেও ত্রাতার ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হন। ঘটনার পথপরিক্রমায় তিনি এদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। এর পরের ইতিহাস একটি বৈপ্লবিক বাংলাদেশের। গণতন্ত্র আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার পর তিনি দেশের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তার সবুজ বিপ্লব দেশের কোটি কোটি অভুক্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটায়। ফিরে সেই মাঠ ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরুর সোনালী সময়। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে জিয়ার পরিচিতি গড়ে ওঠে একজন ‘ভিশনারি লিডার’ হিসেবে। একটি উন্নত অগ্রগামী বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি।
নিবন্ধটি শেষ করতে আবারো আসতে হলো কবি হেলাল হাফিজের পতাকার কাছে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আমরা একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা অর্জণ করলাম। সেই থেকে আজ ২০২৫ সাল। মাঝখানে কেটে গেছে ৫৫ বছর। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় মাঝে-মধ্যেই বাংলাদেশ তার গন্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে। সর্বশেষ কুখ্যাত ওয়ানইলেভেনের পরম্পরায় হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে সন্নাসিনী সবিতা মিস্ট্রেসের সেই পাওয়ার আনন্দটুকুও যেন হারিয়ে যায়। গুম-খুন আর মানবাধিকার লঙ্ঘণের দীর্ঘ আখ্যান রচনা করেন একাত্তরের প্রবঞ্চক শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা।
অবশেষে নাগরিকের মর্যাদা হারিয়ে প্রজা বনে যাওয়া এদেশের কোটি কোটি মানুষের ঘুম ভাঙ্গে চব্বিশের মধ্য জুলাইয়ে। নিপীড়ক রাষ্ট্রে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের অপ্রতিরোধ্য দেওয়াল। জিতে যায় জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। হেরে যায় শোষক শ্রেণি। দেশ ছেড়ে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা পালিয়ে যায়। এই পালিয়ে যাওয়া মানে পরাজয়। একাত্তর ও চব্বিশের পালিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীর প্রতি এদেশের সাধারণ মানুষের সিমাহীন ঘৃণা থাকবেই।
লেখক: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ ও আহবায়ক সাদা দল- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আপনার মতামত লিখুন :