প্রিয় নবীজী (সা.)-এর প্রিয় দুলালী হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। নবীজীর চার মেয়ের মধ্যে বয়সে তিনি ছিলেন সবার ছোট। আবার মেয়েদের সবাকেই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেন। ব্যতিক্রম কেবলই হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তাই আদরের মেয়েদের প্রতি মনে কী পরিমাণ ভালোবাসা ও মমতা পুষতেন প্রিয় নবীজী (সা.) তার নমুনা আমরা সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করি হযরত ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার সঙ্গে তাঁর আচরণে।
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণনা, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে কথাবার্তায় ফাতেমার চেয়ে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ আর কাউকেই দেখিনি। সে যখন তাঁর কাছে আসত তখন তিনি উঠে দাঁড়াতেন, তাকে স্বাগত জানাতেন, চুমো খেতেন এবং নিজের আসনে তাকে বসাতেন। আবার যখন তিনি ফাতেমার কাছে যেতেন তখন সেও তাঁর জন্যে উঠে দাঁড়াত, তাঁর হাত ধরত, তাঁকে স্বাগত জানাত, চুমো খেত এবং নিজের আসনে তাঁকে বসাত। (আল আদাবুল মুফরাদ-৯৭১)
হযরত উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহা প্রিয় নবীজী (সা.)-এর নাতনী। তিনি যখন শিশু, নবীজী (সা.) একদিন তাকে কাঁধে চড়িয়ে মসজিদে চলে এলেন। এরপর এভাবেই নামাযে দাঁড়ালেন। দাঁড়ানো থেকে যখন রুকুতে যাবেন তখন তাকে নামিয়ে নিলেন। এরপর দাঁড়িয়ে আবার তাকে কাঁধে চড়ালেন। এভাবেই তিনি পুরো নামায শেষ করলেন। (সুনানে নাসাঈ- ৭১১)
শুধুই নিজের মেয়ে আর নাতনীদের নিয়ে নয়, এমন আদর আর স্নেহের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে অন্য সাহাবীদের মেয়েদের ক্ষেত্রেও। একবার নবীজী (সা.)-এর কাছে কিছু কাপড় এলো। এর মধ্যে একটি ছোট কালো কাপড়ও ছিল। নবীজী (সা.) উপস্থিত সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন, এই কাপড়টি আমরা কাকে পরাতে পারি বলো দেখি! সবাই চুপ করে রইল। এরপর নবীজী (সা.) বললেন, তোমরা উম্মে খালেদকে আমার কাছে নিয়ে আস। তাকে তখন কোলে করে নিয়ে আসা হলো। নবীজী (সা.) ওই কাপড়টি হাতে নিয়ে তাকে পরিয়ে দিলেন। এরপর বললেন, তুমি তা পরে পুরনো করে ফেলো! কাপড়টিতে কিছু বিশেষ চিহ্ন ছিল। সেগুলো দেখিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, দেখো, কী চমৎকার! (সহিহ বুখারী-৫৮২৩, ৫৮৪৫)
হাদিসের কিতাবে, সীরাতের গ্রন্থাবলিতে এমন ঘটনা আরো অনেক বর্ণিত হয়েছে। মেয়েশিশুদের তিনি খুবই আদর করতেন। অবশ্য ছেলেরাও তাঁর এ অকৃত্রিম স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতো না। প্রিয় নাতিদ্বয় হযরত হাসান এবং হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে নিয়ে তো কত ঘটনা ছড়িয়ে আছে! কতভাবে তাদের আদর করেছেন! নবীজী (সা.)-এর ছেলে ইবরাহীম (রা.) যখন দুগ্ধপোষ্য শিশু, ধাত্রীমায়ের কাছে থাকে, তখন ছেলেকে তিনি দেখতে যেতেন বলেও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। ছেলের মৃত্যুতে তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রুও ঝরেছে।
আসলে এসবই মানুষের স্বভাবজাত, অকৃত্রিম। নিজের ঔরসজাত ছেলে-মেয়ের প্রতি, তাদের সন্তানাদি তথা নাতি-নাতনীর প্রতি মানুষমাত্রই অনুভব করে এক অকৃত্রিম টান, নিখাঁদ ভালোবাসা। এর কোনো তুলনা হয় না, এটা অমূল্য। মানবজীবনের এ স্বাভাবিক দিকটির ওপর পবিত্র কুরআনে এভাবে আলোকপাত করা হয়েছে ‘মানুষের জন্যে সুশোভিত করা হয়েছে চিত্তাকর্ষক বস্তুর আকর্ষণ, যেমন নারী, সন্তানাদি, পুঞ্জীভূত রাশি রাশি স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদি পশু আর ক্ষেতখামার। এসব পার্থিব জীবনের ভোগসামগ্রী।’ (সূরা আলে ইমরান-১৪)
সন্তানকে দেখে বাবা-মায়ের চোখ জুড়ায়। তার যে কোনো সফলতা কিছু সময়ের জন্যে হলেও বাবা-মায়ের কষ্টকে ভুলিয়ে দেয়। এর ব্যত্যয় যেন না ঘটে, পবিত্র কুরআনে তাই দুআ শিখিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের নয়নপ্রীতিকর; আর আমাদেরকে আপনি মুত্তাকিদের প্রধান করে দিন।’ (সূরা ফুরকান-৭৪)
নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে হলেও মানুষ সন্তানের জীবন রক্ষা করতে চায়। সন্তানের সুখময় ভবিষ্যতের চিন্তায় নিজের বর্তমানের সুখকেও ভুলে থাকতে চায়। সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এমনই। ছেলে-মেয়ে এখানে সমান। দু’জনই সন্তান এবং বাবার হৃদয়ের ভালোবাসা উভয়ে সমানভাবেই দখল করে নেয়। মেয়েশিশুদের মতো স্বাভাবিকভাবেই রাসূলুল্লাহ (সা.) ছেলেশিশুদেরও ভালোবেসেছেন, আদর করেছেন, কোলে তুলে নিয়েছেন। তবে মানুষের স্বভাবজাত এ আকর্ষণের পাশাপাশি মেয়েশিশুদের লালনপালন, তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ, তাদের জীবনকে সুন্দরভাবে বিকশিতকরণ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি যে ফযিলত বর্ণনা করেছেন, সেখানে মেয়েরা অনন্য।
নবীজী (সা.) মেয়েদের ভরণপোষণের জন্যে কোথাও বেহেশতের ওয়াদা করেছেন, কোথাও তাদের সঙ্গে সুন্দর আচরণ কিংবা লালনপালনের জন্যে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কথা বলেছেন। লক্ষ্য করুন যার তিনজন কন্যা সন্তান হবে আর সে তাদের আবাসের ব্যবস্থা করবে, তাদের প্রতি মমতা প্রদর্শন করবে এবং তাদের ভার বহন করবে, তার জান্নাত নিশ্চিত। জিজ্ঞেস করা হলো ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি দুইজন হয়? বললেন, দুইজন হলেও। বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণের কারো কারো ধারণা ‘যদি কেউ বলত একজন হলে? তাহলে নবীজী বলতেন, একজন হলেও।’ (মুসনাদে আহমাদ-১৪২৪৭)
আপনার মতামত লিখুন :