কবি সুফিয়া কামালঃ জীবন ও সাহিত্য


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : আগস্ট ২৮, ২০২৫, ১১:০৩ পূর্বাহ্ণ /
কবি সুফিয়া কামালঃ জীবন ও সাহিত্য

প্রফেসর মো: নুরুল আমিন।।

বাংলা সাহিত্যে যে কয়জন মহিলা সাহিত্য সাধনা দ্বারা স্বীয় আসন অলংকৃত করেছেন তন্মধ্যে বেগম সুফিয়া কামালের স্থান নিঃসন্দেহে অগ্রগণ্য। একটি সংস্কৃতিক পরি মন্ডলের সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করলেও তৎকালীন অভিজাত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের ইংরেজি ও বাংলা ভাষা শিক্ষা করা রীতিমতো হারাম ছিল। বেগম সুফিয়া কামাল যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে সকলেই শিক্ষিত ছিল কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি তারতম্যের জন্য তিনি উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হন। বাড়ির সহৃদয় বন্ধু ভাবাপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নিকট বাংলা সাহিত্য ন্যূনতম রস্ আস্বাদনের। সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার প্রচন্ড অনুরাগ জন্ম এবং নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় তিনি বাংলা শিক্ষা করেন এবং প্রভূত পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ গ্রামে তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল কুমিল্লা জেলার শিলাউর গ্রামে। তার পিতা সৈয়দ আব্দুল বারী কুমিল্লার একজন প্রখ্যাত উকিল ছিলেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজ ছিল চরম রক্ষণশীলতা শৃংখলে আবদ্ধ। মেয়েদের বিদ্যা শিক্ষা ছিল সে আমলে কল্পনারও অবাস্তব। সামান্য আরবি ফারসি শিখে মোটামুটি ধর্মীয় শরীয়ত অনুযায়ী ঘর কন্যার জীবন যাপন ই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতো। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত ঠিক এমনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু অদম্য আগ্রহ ও সাহিত্যের প্রতি ঐকান্তিক অনুরক্তির কারণে তারা উভয়ই শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাহিত্য সাধনা থেকে বিচ্যুত হন নি। বেগম রোকেয়া সাহিত্যিক হিসেবে যতটা না খ্যাতির অধিকারী তার চেয়ে বরং বেশি তিনি সমাজ সংস্কারক ও নারী মুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত হিসাবে খ্যাতিমান। তৎকালীন মুসলিম অবরোধবাসিনী নারীদের মুক্তির নারী শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে রোকেয়া কলকাতায় সাখাওয়াত গার্লস হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার লক্ষ্যে তিনি লেখনি ধারণ করেন নিরলস ভাবে নারী জাগরণের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করতে থাকেন বাঙালি নিদ্রিত নারী সমাজকে। মুসলিম সমাজের চিরাচরিত কুসংস্কারবশত এ দুই মহীয়সী নারী বাল্যবিবাহের স্বীকার হন। সুফিয়া কামাল মাত্র ১১ বছর বয়সে তার জ্ঞাতি ভ্রাতা সৈয়দ নেহাল হোসেন এর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। নেহাল হোসেন ছিলেন সংস্কৃতিমনা বিদ্যুৎ সাহী ও সাহিত্যাদুরাগী। ফলে তার অনুপ্রেরণায় সুফিয়া কামাল সাহিত্যসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু দাম্পত্য জীবনের অতি অল্পকালের মধ্যে তিনি বৈধব্যবরন করেন এবং মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু জীবন মানেই তো যুদ্ধ, নিয়তির সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করেই মানুষকে জীবন সংগ্রামের টিকে থাকতে হয়। আর জ্ঞানীরা কখনো বিপদে ধৈর্য হারা হয় না। কবি ও সুফিয়া কামাল একান্ত অনন্য উপায় হয়ে একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে, ভগ্না স্বাস্থ্য ও ভগ্ন হৃদয়ে কলিকাতায় এসে উপনীত হন। তার স্বামী নেহাল হোসেনের কর্মস্থল ছিল কলকাতায় কলকাতায়। তিনি কলিকাতা কর্পোরেশন বিদ্যালযের শিক্ষয়িত্রীর পথ গ্রহণ করেন। তিনি নিজেও এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর ১৯৩৯ সালে চট্টগ্রামের কামালউদ্দিন এমএসসি সাহেবের সাথে তিনি দ্বিতীয়বার পরিণয়ের সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ওই সময় থেকে সাহিত্য জগতে বেগম সুফিয়া কামাল নামে পরিচিতি লাভ করেন। পারিবারিক উত্থান পতনের ঢেউ তার সাহিত্য সাধনাকে স্বীয় গতি থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করতে পারেনি। সুফিয়া কামালের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার ভাষার সারল্য ও সহজ বোধ্যতা। অতি সাধারণ চারপাশের বিরাজিত পরিবেশকে তিনি তার কাব্যে অংকন করেছেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। তার কবিতায় বাগাড়ম্বর বিহীন শব্দ একেবারেই নেই বললেই চলে। অতি জটিল ও দুরূহ বিষয়কে তিনি অঙ্কন করেছেন একান্ত সুললিত মাধুর্যমন্ডিত করে। আর কবিতায় প্রেম প্রকৃতি পরিবেশ নিসর্গ প্রীতি খুবই চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। সৃষ্টিও স্রষ্টার প্রতি তিনি ছিলেন একান্ত নিবেদিত প্রাণ। বিধাতা আমাদের সৃষ্টি করেছেন গাছে ফুল ফল নদী ভরা জল দান করেছেন এবং চারপাশের বিরাজিত চকোর চকো। রীর মুখে সুমিষ্ট গীত উচ্ছ্বাস এ সবই তার সৃষ্টির মহিমা। এ সংসারে আমরা একান্তভাবে মাতা পিতা ভাই বোন আত্মীয়-স্বজন। স্বামী স্ত্রী একে অপরের উপর কি অপূর্ব নির্ভরশীলতা কবি প্রত্যক্ষ করেছেন। পরিবার-পরিজন প্রতিবেশী সবার সাথে আমরা আত্মীয়তার সূত্রে আবদ্ধ হয়ে মিলেমিশে আছি। এ অচ্ছেদ্য হৃদয় বন্ধন কখনো ছিন্ন হবার নয়। কবি এ প্রার্থনায় স্রষ্টার দরবারে নিবেদন করেছেন। যেমন: তুলি দুই হাত করি মোনাজাত হে রহিম রহমান কত সুন্দর করিয়া ধরণী মোদের করেছ দান। গাছে ফুল ফল নদী ভরা জল পাখির কন্ঠে গান,সকলি তোমার দান (প্রার্থনা) । কবি জন্মগ্রহণ করেছেন গ্রামে এবং পল্লী প্রকৃতির মধ্যে তার শৈশব কেটেছে। কিন্তু নাগরিক জীবনে প্রবেশ করেও জন্মস্থান পল্লী গ্রামের কথা বিন্দুমাত্র বিস্মৃত হতে পারেননি। স্বয়নে স্বপনে জাগরণে সেই পল্লী প্রকৃতির আনন্দ ঘণ দিনগুলি বারবার ফিরে এসেছে তার স্মৃতি পটে। নাগরিক জীবনেএ স্মৃতি একান্তই র কৃত্রিম ইট পাথরের কাঠিন্যের মধ্যে পল্লী প্রকৃতির সুমিষ্ট জীবন চিত্র খুজে পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়। তাই বারবার কোবির হৃদয় পল্লী প্রকৃতির জন্য গুমরি গুমরে কেঁদে ফিরেছে এবং তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন তিনি কৈশোরের কথা ভেবে। ঝাও শাকের বনলতার গুলমে কবি যে হৃদয়ে দোল খেয়েছেন ফুলের কাঁটার আঘাত ছুঁয়েআঘাত সয়ে কাঁচা পাকা ফুল খেয়েছেন কুল খেয়েছেন অমৃতের সাদ লাভ করেছেন এ স্মৃতি একান্তই বাঙালির নিজস্ব স্মৃতি। পৌষ পার্বণে কবি শীতের সকালে খেজুর রসের সুমিষ্ট পিঠা খেয়েছেন। সেই সাথে মায়ের বকুনি খেয়ে কিশোরী উচ্ছল মনের উন্মাদনার তার হৃদয় শিহরিত। যেমন: বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল।ঝাউ শাকে যেথা বনলতাবাধি হরষে খেলেছি দল কুলেরকাটার আঘাত শহীয়া কাঁচা পাকা কুল খেয়ে অমৃতের সাধ যেন লভিয়াছি গায়ের দুলালী মেয়ে পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে
আরো উল্লাস বাড়িয়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই বিঘা জমি কবিতায় অনুরূপ উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে। কবি জৈষ্ঠের নির্ঘুম রাত্রে ঝড় আগমনের পর প্রত্যুষে। আম কুড়াবার যে কিশোর মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। এটি আবহমান বাংলার চিরন্তন এবং সার্বজনীন অভিব্যক্তি। এর স্মৃতিগুলো অমৃতময় দিনগুলির তুলনা বিরল। ব্যক্তি জীবনে সবাই বড় হয়ে কর্মব্যস্ত শহরে ব্যস্ত জীবন যাপন করে কিন্তু পল্লী প্রকৃতির সেই স্তব্ধ দুপুরে পাঠশালা পলায়ণের কথা কারোরই ভুলে যাবার কথা নয় এবং ফেলে আসা সেই অপূর্ব দিনগুলি। ফিরে পাবার আকাঙ্খায় মানুষ মাত্রই উদগ্রীব। কি অসাধারণ কবির অভিব্যক্তি। সেই মনে পড়ে জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে নাইকো ঘুম। অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম। সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর পাঠশালা পলায়ন। ভাবিলাম ভাই আর কি কোথাও ফিরে পাব সে জীবন? তাছাড়া কবি যে পরিবেশে সে সময়ে তার শৈশব কাল অতিবাহিত করেছেন। তখন শিশুরা শুধু উচ্ছ্বাস উচ্ছল মনের অধিকারী ছিল । সেখানে প্রতটি ক্ষণ তারা আনন্দে। গ্রামের মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে আঙিনার কোনে চৈত্র মাসের চন্দ্রিমা রাতে তারা প্রাচীনদের মুখে গল্প শুনে অতিবাহিত করেছেন কিন্তু আজ যুগ পাল্টেছে পাল্টেছে মানুষের জীবন পরিক্রমার ছন্দ। তাই আজ আর আগের মত উচ্ছ্বাস প্রবন হলে শিশুদের চলবে না। তাদের প্রতি কোভিদ উপদেশ হল।আমরা যে বয়সে খেলাধুলা করে ঘুড়ি উড়িয়ে অতিবাহিত করেছি পুতুল খেলেছি তোমরা এখন সেই বয়সে প্রচুর লেখাপড়া করে জ্ঞান অর্জন কর। বিচিত্র এ পৃথিবীর মানুষকে জানতে হবে এবং এই জানার জন্য চাই জ্ঞান অর্জন। আর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষালাভ। অতএব আগের দিনের শিশুদের যে বয়সে উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু সম্বন্ধে রাখতো না, আজকে শিশুরা সেখানে ওই সব স্থান বিজয়ের স্বপ্ন দেখবে। কবি এই কামনা করেন। পাতালপুরীর অজানা কাহিনী তাদেরকে উদ্ধার করে আনতে হবে এবং পৃথিবীর এ প্রান্ত হতে অন্য প্রান্তের খবরা খবর তাদের নখ দর্পনে থাকবে হবে কবি এ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যেমন: উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু সব তোমাদের জানা। আমরা শুনেছি সেখানে রয়েছে জিন পরী দেওদানা। পাতালপুরের অজানা কাহিনী তোমরা শোনাও সবে। মেরুতে মেরুতে জানা পরিচয় কেমন করিয়া হবে। সুফিয়া কামালের প্রায় প্রতিটি কবিতায় দেশপ্রেম দেশের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ প্রকাশিত হয়েছে দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের পরিশ্রমে আমরা যে অট্রালিকায় বসবাস করি তাদের প্রতি কবির অকৃত্রিম দরদ প্রকাশিত হয়েছে । বাংলার চাষাভূষা মুটি মজুর মাঝি মাল্লার প্রতি তার শ্রদ্ধা অপরিসীম। সর্বোপরি সবার চাইতে সর্বাগ্রে অগ্রগণ্য আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। বাংলাদেশ এবং বাংলা ভাষা। এই বাংলা ভাষায় মায়ের মধুর ডাকে, মাগো এর সুমিষ্ট ধ্বণিপৃথিবীর অন্য সব কিছুর চাইতে কোবির নিকট মধুর সম্ভাষণ। কবি এ মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং প্রকৃতি তাকে তিলে তিলে ছোট থেকে বড় করে তুলেছে। হে প্রকৃতির কাছে কবি তাই চিরঋণী এবং তিনি মাটিকেই মা বলে জেনেছেন। জীবনে মরণে চির শান্তির নীড় রচনা করেছেন তিনি বাংলার মাটিতেই। তিনি গর্ব ভরে বলতে চান এ মাটি আমার মা এ দেশ আমার প্রাণ। যেমন: শত সন্তান সাধ করে এর ধুলি মাখি সারা গায়, বড়গৌরবে মাথা উঁচু করি মানুষ হইতে চায়।(জন্মেছি এই দেশে)। কবি আজীবন মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন সকল জরাজীনের অবসান ঘটিয়ে, নবীন রায় জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে এবং তারাই সফলতা লাভ করবে। তিনি বাংলার নবীন দামাল ছেলেদের বিজয় কামনা করেছেন। এ পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে হলে নবীনদের কে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। তাদেরকে নিজ হাতে পৃথিবীকে তাদের বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। ধুলিময় মলিন কর্দক্তমাক্ত পৃথিবীকে তারা সবুজ শ্যামলীময় সজ্জিত করবে। এখানে তারা স্বর্গের সুষমা বয়ে নিয়ে আসবে। তাদের জীবনে কোন দুঃখ-দৈণ্য থাকবে না। জীবনের সব হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে জীবনকে সুন্দর কবে সুচারূপে গড়তে হবে নবীনদের। তাদের শ্রমে এদেশের মানুষের অন্য বস্ত্রের সংস্থান হবে। যেমন: হাসি দিয়ে ফুল বিকশিত কর, অশ্রুর মধু দিয়া। মধুময় কর দুঃখ দৈন্য ব্যাথিত মানব হিয়া। তোমাদের শ্রমের মাটিতে ফলাও স্বর্ণ শস্য ভার। ক্ষুধায়ক্লিষ্ট মানুষ যেন গো ধরায় রহেনা আর (নওল কিশোর)। যৌবনের নতুন প্রাণ প্রাচুর্যয় পারে পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়তে। দুর্গম দুঃসাহসী অভিযাত্রী দল জীবনের মোহমায়া ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য উজ্জ্বল দুর্গম দুর্জয় পথে অগ্রসর হয়। মহাকালের এই যে গৌরব উজ্জ্বল কীর্তি এর দাবিদার তরুণ দল। চাঁদের সত্য সন্ধানী দৃষ্টিতে আগামীর দিন চির প্রতিভাত। বহমান নদীর স্রোতধারা যেমন সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে সাগরের দিকে অগ্রসর হয় করে ঠিক তেমনি তারাও দুর্গম দুর্জয় পথে এগিয়ে চলে এবং কাঙ্খিত বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে আসে। কোবির স্বাগত সম্ভাষণ। youth is the time to go flashing from on end of the world to the other both in mind and body. তরুণেরা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী। জীবনের না বলে কোন শব্দ তাদের অভিধানে লেখা নেই। দুর্গম ও দুঃসাহসী পথিকের বেশে তারা অগ্রসর হয় মৃত্যু ঘেরা অচিন পুরে।মৃত্যুঞ্জয়ী জীবন উল্লাসে তারা সম্মুখে এগিয়ে চলবেই। যেমন: ঝড়ের রাত্রে বৈশাখী দিনে বর্ষার দুর্দিনে। অভিযাত্রী নির্ভীক তারা পথ নয় ঠিক চিনে। হয়তবা ভুল তবু ভয় নাই তরুণের তাজা প্রাণ। পথ হারালেও হার মানে নাকো করে চলে সন্ধান (অভিযাত্রিক)। সাহিত্য হচ্ছে মানবহৃদয়ের একান্ত অভিব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ। মনুষ্য হৃদয়ের আকাঙ্খার প্রতিফল সাহিত্যে প্রকাশিত হয়। কবির ব্যক্তিগত জীবনের সুখ দুঃখ এতে ধরা পড়ে। কবি কৈশর জীবনে যে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়ে লালিত পালিত হয়েছিলেন। সেখানে তার হৃদয়ের একান্ত আপন তেমন কেউ ছিলনা। মানুষের হৃদয়ের নিজস্ব মৌলিক সত্ত্বায় মানুষ বিকশিত হয়। সেই সত্তা থেকে তাকে বিছিন্ন করতে চাইলে ব্যক্তি জীবনে দেখা দেয় সংঘাত ও পরস্পর মনঃপীড়া। কিন্তু কবি সাংসারিক জীবনে সেরকম বন্ধু সাহচর্য্ থেকে প্রায় বঞ্চিত ছিলেন বলা যায়। কিন্তু সৈয়দ নেহাল হোসেনের সঙ্গে পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হবার বন্ধু-প্রতিম সহচর্যে কবির নিজস্ব ব্যক্তিসত্তাটি পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়। যার ফলে সাহিত্য ক্ষেত্রে তিনি একের পর এক খ্যাতি অর্জন করেন। কিন্তু তার আকস্মিক বিয়োগের কবি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এ হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় কবি পুনর্বার দ্বার পরিগ্রহ পরিগ্রহ করেন করেন সত্যি কিন্তু হৃদয়ে সেই বাল্যবিবাহেরপ্রণয় জড়িত প্রথম প্রনয়ের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলির কথা তিনি কখনো বিস্মৃত হতে পারেননি। সিক্ত চাঞ্চল্য কুমারীর নারী জীবনের সংখ্যার ধন প্রনয়ের স্বপ্নের পুরুষের শিহরণ একান্ত শিহরণ, সেই স্মৃতি কখনো ভোলার নয়। জীবনে বসন্ত পুনর্বার এসেছে কিন্তু কবি নিরব।তিনি জীবনের প্রিয় স্বপ্ন বাসরকে সাজাতে তৎপর হচ্ছেন না, তিনি আত্মবিহ্বলের ন্যায় অদৃশ্য শিহরণে অভিভূত। তাকে দেখলে যেন মনে হয় তিনি গভীর চিন্তায় বিভোর। জীবনের এ-আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় সঙ্গীকে বরণ করতে তিনি উৎসাহ বোধ করছেন না। কারণ তার সেই প্রথম প্রাণের স্মৃতি হৃদয়ে দোলা দিচ্ছে এবং তিনি সেই কারণে আসন্বন বসন্তকে স্বাগত জানাতে নিস্পৃহ। তাই বসন্তের প্রাচুর্যের মধ্যে কবির মনে পড়ছে কুহেলী উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্প শূন্য দিগন্তের পথে। রিক্ত হস্তে তাহারেই পড়ে মনে। ভুলিতে পারিনা কোনমতে (তাহারেই পড়ে মনে)। অনেক বেদনা ঘন ঘটনা ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামাল এর জীবন অতিবাহিত হয়েছিল। সেই জন্যই বোধ হয় তার কাব্যের সর্বত্র একটা বিষাদের ছায়া লক্ষ্য করা যায়। প্রকৃতির অপূর্ব চিত্রকল্প সুফিয়া কামালের কবিতার আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। অত্যন্ত গভীর অনুভূতি ও মমতায় আপ্লুত হয়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক রূপ ও সৌন্দর্যকে তিনি তুলে ধরেছেন পাঠকের সম্মুখে। কবি সুফিয়া কামাল সুদীর্ঘকাল সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহচর্য তিনি পেয়েছিলেন এবং নজরুল ইসলাম তাকে কাব্য রচনা জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য সুফিয়া কামালের জীবনের একটি বিশেষ অনুপ্রেরণার উৎস। বিশ্বকবি তার কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং বলেন যে, তোমার মত একজন মহিলাকে যে এত সুন্দর কবিতা লিখতে পারে এটি আমি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। কবি সুফিয়া কামাল এর জীবনে বহু জ্ঞানেগুণী সান্নিধ্য পেয়েছেন এবং তাদের সাহচয্যে নিজেকে খাঁটি একজন কবি হিসেবে মেলে ধরতে পেরেছেন। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা থাকলে শত প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে যে সাহিত্য সাধনা করা যায় কবি সুফিয়া কামাল তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কবিতা রচনা ছাড়াও তিনি আজীবন বিভিন্ন সমাজ সংস্কার মূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তিনি নারী শিক্ষার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন এবং নারী উন্নয়নের জন্য তার সাধনা লেখনির মাধ্যমে তিন ফুটিয়ে তুলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ গুলো নিম্নরূপ :কাব্য: সাঝের মায়া, মায়া কানন, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী প্রশস্তি ও প্রার্থনা, দীওয়ান মৃত্তিকার ঘ্রান , অভি যাত্রিক মোর যাদুদের সমাধি পরে, স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন । উপন্যাস : অন্তর, গল্পগুচ্ছ: কেয়ারকাটা। স্মৃতি কথা মূলক গ্রন্থ: একাত্তরের ডায়েরী। শিশুতোষ গ্রন্থ: ইতলবিতোল ও নওল কিশোরের দরবারে। কবি সুফিয়া কামাল তার কবি প্রতিবার জন্য অনেক পুরস্কার লাভ করেন। যেমন: ১, বাংলা একাডেমী পুরস্কার ২, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক, ৩, একুশে পদক, ৪, বুলবুল ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার, ৫, মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি। এ মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিনগুলিতে মানুষের জন্য কিছু না করতে পারার অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছট করেছেন যেটি তার সমসাময়িক বক্তব্যে সুচারুরূপে ফুটে উঠেছে। তিনি ১৪০৬ বঙ্গাব্দের ১০ আষাড় এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করেন। আমরা হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে এ মহীয়সী নারীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তার মৃত্যুতে আমরা নিঃসন্দেহে একজন মহৎ কবি প্রাণ মানুষকে হারিয়েছি যে ক্ষতি কখনোই পূর্ণ হবার নয়। সরকার তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় পাবলিক লাইব্রেরীর নামকরণ করেছেন তার নামে। তিনি এ নশ্বর পৃথিবী থেকে চলে গেলেও তার সাহিত্য কর্মের মধ্যে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন নিঃসন্দেহে।

লেখকঃ প্রফেসর, বাংলা বিভাগ, দারুল উলুম চৌমুহনী ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা।