অন্তর্বর্তী সরকার মিয়ানমারকে একতরফা মানবিক করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না করে জাতিকে অন্ধকারে রেখে হঠাৎ কি জন্য, কার স্বার্থে এই করিডোর দেয়া হচ্ছে প্রশ্ন সচেতন মহলের। যুদ্ধরত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ পৌঁছাতে আরাকান আর্মির উত্থানে সীমান্তে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে মানবিক করিডোর দেওয়া নিয়ে সর্বত্র চলছে নানা বিতর্ক।
এতে করে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেউ কেউ এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্তের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন। কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের ‘বার্মা অ্যাক্ট’ এজেন্ডা বাস্তবায়নে গোপনে এই সিদ্ধান্ত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। কেউ কেউ বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে হঠাৎ করে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেওয়ার নেপথ্যে করিডোর ইস্যু থাকতে পারে। গত সোমবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে শর্ত সাপেক্ষে মিয়ানমারের বেসামরিক জনগণের জন্য করিডোর দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। কারণ, এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে।
তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে সহযোগিতা করব।’ পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জাতিসংঘের অনুরোধে এ ধরনের করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানালেও একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘কক্সবাজার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপন নিয়ে সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি। তবে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে’। অন্তর্বর্তী সরকারের এই দুই ধরনের বক্তব্যের ধূম্রজাল প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত করিডোর ইস্যুতে সুস্পষ্ট বক্তব্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা। এর আগে মার্কিন রণতরী আসার জন্য ২৯ জানুয়ারি ৯ মাসের জন্য সেন্টটমার্টিন যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘পররাষ্ট্রনীতি থেমে থাকে না। কিন্তু মিয়ানমারকে মানবিক করিডোর দেয়া নিয়ে কথা বলা পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এতে সন্দেহ হয়। সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা আছেন। এমন স্পর্শকাতর বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টার কথা বলা উচিত। প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানকে একই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পদেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি কোথায়? করিডোর কেমন হবে, কী যাবে, শর্ত কী হবে, তা অবশ্যই জানাতে হবে। এগুলো না জানালে সন্দেহ তৈরি হবে।’
চলতি বছরের প্রথমার্ধে গৃহযুদ্ধে পর্যুদস্ত মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকান রাজ্যে দুর্ভিক্ষ হতে পারে শঙ্কায় রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশকে ‘করিডোর’ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল জাতিসংঘ। এই অনুরোধে সরকার করিডোর দিতে সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু এবিষয়ে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ায় সৃষ্টি হয়েছে ধূম্রজাল। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টিটিভ ড. খলিলুর রহমান স¤প্রতি কক্সবাজারে বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বর্তমান অবস্থা রোহিঙ্গাদের নিরাপদভাবে প্রত্যাবাসন করা সম্ভব নয়। তবে তার জন্য সবধরনের ব্যবস্থা করছে সরকার। তিনি কক্সবাজার শহরের রাখাইন পল্লীতে জলকেলি উৎসব উপলক্ষ্যে ‘শুভ রাখাইন সাংগ্রেং ১৩৮৭’ শীর্ষক আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এতে সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, তার এই নেতিবাচক বক্তব্য করিডোর দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কিনা?
এদিকে বাংলাদেশ-রাখাইন মানবিক করিডোর নিয়ে সরকারের ঘোষণায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। দেখা দিয়েছে প্রচÐ বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এছাড়াও সা¤প্রতিক সময়ে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ঘিরে সরকারের নানা কর্মকাÐে দেখা দিয়েছে রহস্য। এবিষয়ে দেশবাসী কিছু জানে না। এখন দাবী উঠেছে এসব বিষয়গুলো দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার করতে হবে। দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে সরকারের এধরনের কোন সিদ্ধান্ত মেনেনেয়া হবেনা জানিয়েছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ।
কারো কারো অভিমত, জাতিসংঘের প্রস্তাবটি খ্রিস্ট-সাম্রাজ্যবাদীদের নীলনকশার অংশ। বলা হয়ে থাকে, মিয়ানমারের রাখাইন, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা তার অংশ বিশেষ নিয়ে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার কাজ অনেকদিন ধরে চলছে। এই রহস্যজনক করিডোর ও সেন্টমার্টিন নিয়ে রহস্যজনক কর্মকান্ড ওই ষড়যন্ত্রেই অংশ।
রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মিয়ানমারের বেসামরিক লোকজনের কাছে মানবিক করিডোর (হিউম্যান পেসেজ) দেওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, গাজাতে এখন যুদ্ধ চলছে। সেখানে যাওয়া যায় না। কিন্তু জাতিসংঘ থেকে সেখানে খাবার ওষুধ পাঠাতে হলে জর্ডান থেকে অথবা মিশর থেকে রাস্তা তৈরি করে, ওদিক দিয়ে গাজাতে পাঠানো হচ্ছে। ভালো কথা, মানবিকতার দরকার আছে। আমার কথা হচ্ছে আজকে বাংলাদেশকে ওই জায়গাতে পৌঁছাতে হলো। যে বাংলাদেশকে একটা (হিউম্যান পেসেজ) দিতে হচ্ছে। এটা অনেক বড় সিদ্ধান্ত।
এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের শান্তি শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা জড়িত আছে। সরকারের উচিত ছিলো এ বিষয়টা নিয়ে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলা। তারা এটা না করে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে হিউম্যান পেসেজ (মানবিক করিডোর) তারা দিচ্ছে। জাতিগতভাবে সাহায্য করতে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু এটা হতে হবে সকল মানুষের সমর্থনে। আমরা আরেকটা গাজায় পরিণত হতে চাইনা। আমরা যুদ্ধের মধ্যে জড়াতে চাইনা। এখানে এসে অন্য কেউ এসে গোলমাল করুক আমরা চাইনা। একে তো রোহিঙ্গাকে নিয়ে আমরা সমস্যায় আছি। আবার মানবিক করিডোর দিয়ে কোন ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হোক সেগুলো আলোচনা করে করিডোর দেওয়া উচিত ছিলো বলে আমরা মনে করি।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, সংসদ না থাকায় সরকার হয়তো মানবিক করিডোর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতোবড় ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা উচিত ছিল। সংস্কার ইস্যুতে সরকার দলগুলোর সঙ্গে প্রায় সংলাপ করছে। এটার ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। মার্কিনীরা যে কোনো সিদ্ধান্ত ধীরস্থিরভাবে নেয়। দেড়-দু’বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট করেছিল। ঠান্ডা মাথায় তাদের সুদূর প্রসারী সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে তারা হয়তো মানবিক করিডোর চাচ্ছে।
এ অঞ্চলে সম্পদ বেশি হওয়ায় সমুদ্র ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্র সেনাঘাঁটি করতে পারে। এমনকি মার্কিনীদের বঙ্গোপসাগরে উপস্থিতি ভারত নীরবে হজম করলেও চীন-রাশিয়াকে বিক্ষুব্ধ করবে। ফলে এই স্পট অদূর ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে যুদ্ধক্ষেত্র। মূলত মানবিক করিডোর ইস্যু এক সময় বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত দ্রæত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির প্রিন্সিপাল নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং আরাকান আর্মি দু’পক্ষই রোহিঙ্গাদের স্বার্থ বিরোধী। তাদের নির্যাতনেই লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করলে মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইনের সাথে মানবিক করিডোরে আমাদের আপত্তি নেই। তবে এর পেছনে অন্য কোন ষড়যন্ত্র থাকলে তা আমরা প্রত্যাখ্যান করব এবং সমর্থন করবো না।
মিয়ানমারের সাথে মানবিক করিডোর প্রসঙ্গে কক্সবাজার ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মনবিক সহায়তার জন্য সীমিত আকারে করিডোরকে আমরা স্বাগত জানাব। কিন্তু যে ষড়যন্ত্রের আভাস আমরা পাচ্ছি তাতে মনে হচ্ছে করিডোর বিষয়টি রহস্যজনক। শুধু আরাকান আর্মীর সুবিধার জন্য বা অন্য কোন উদ্দ্যেশ্যে করিডোর আমরা সমর্থন করিনা। আমাদের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে নানা ধরনের রহস্য সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এবিষয়ে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য দাবী করেন।
এ প্রসঙ্গে জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরী বলেন, মিয়ানমারের সাথে সরকার যে মানবিক করিডোর সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বলে আমরা শুনছি, এ বিষয়ে জাতি অন্ধকারে। এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে এ ধরনের একটি বিষয় নিয়ে আমরা বান্দরবান, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন ও রোহিঙ্গা নিয়ে নতুন কোন ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে কিনা। আমি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরোধিতা না করলেও এবিষয়টি জাতির কাছে স্পষ্ট করার দাবী জানাচ্ছি।
কক্সবাজার জেলা নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা আব্দুল খালেক নেজামী বলেন, করিডোরের নামে এখানে কোন খৃস্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রকে দেশের মানুষ মেনে নেবে না। আমরা চাই দ্রæত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হোক।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৪ এর মিজানুর রহমান এবিষয়ে বলেন, তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিয়ানমারের আরাকানে তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে চায়। জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মী কেউই রোহিঙ্গাদের বন্ধু নয়। তারা দেশে ফিরতে চায়। তাদের বাহানা দিয়ে অন্য কোন ষড়যন্ত্র তারা মানতে চায়না।
২০১৭ সালে আরাকান অঞ্চলের লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার জান্তা সরকার ও আজকের আরাকান আর্মি নামের মিয়ানমারের বিদ্রোহী শক্তির যৌথ অভিযানে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আজকের দিনে সবচাইতে বড় প্রশ্ন হলো বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় দেড় মিলিয়ন রোহিঙ্গাদের তাদের নিজের ভ‚মিতে প্রত্যাবাসন।
এ নিয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস চীন রাশিয়া ও মিয়ানমারসহ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। ইতিমধ্যে সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে একজন নিরাপত্তা উপদেষ্টাও নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি বিষয়টি দেখভাল করেছেন। ইতোমধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার জান্তা সরকার সম্মতও হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তঃদেশীয় বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতেই রাখাইন অঞ্চল মাদক, অস্ত্র এবং নারী ও শিশু পাচারের অবাধ ক্ষেত্র হিসাবে পরিচিত। মানবিক করিডোর দিয়ে এসব অবৈধ কারবার বাড়বে, এমন আশঙ্কাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রশ্ন হলো, করিডোর না থাকায় কি এসব অপকর্ম বন্ধ আছে? রাখাইন থেকে যারা বিশেষ করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে চায়, তারা এই করিডোর সহজেই ব্যবহার করতে পারবে। এর ফলে অনুপ্রবেশ আরো বেড়ে যাবে। এ কথা কারো অজানা নয়, মিয়ানমার থেকে প্রতিদিনই অত্যাচারিত, নিপীড়িত ও ঘরবাড়ি হারানো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে।
গত কয়েক মাসে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বারবার প্রমাণিত হয়েছে, মিয়ানমার জান্তা সরকার যেমন রোহিঙ্গাদের মিত্র নয়, তেমনি আরাকান আর্মিও তাদের মিত্র নয়। জান্তার নিরাপত্তা বাহিনী, জঙ্গী ও আরাকান আর্মির সদস্যরা সবাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা এক সময় একজোট হয়েই রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা-নির্যাতন, বাড়িঘর দখল ও অগ্নি সংযোগের তাÐব চালিয়েছে। আরাকান আর্মির কর্তৃত্ব দখলের পরও তারা একই ধরনের আচরণের শিকার হচ্ছে। এছাড়াও স¤প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তে আরাকান আর্মীর তৎপরতা নানা ধরনের প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। আরাকান কর্মকাÐে সীমান্তের জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছে। তাদের সন্দেহ সীমান্তে মানবিক করিডোর! আরাকান আর্মির স্বার্থে?
সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবিক করিডোরের বিষয়টি বাংলাদেশের সম্মতির ওপরই কেবল নির্ভর করে না। এ জন্য মিয়ানমারের জান্তা সরকারের অনুমোদন লাগবে। সে সরকার অনুমোদন দেবে কি না, সে রকম কোনো তথ্য এপর্যন্ত জানা যায়নি। আর এখন যেহেতু রাখাইন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে সুতরাং এ বিষয়ে তাদের অনুমোদনও জরুরি। এ ব্যাপারে আরাকান আর্মির অভিমতও জানা যায়নি। একযোগে দু’পক্ষই অনুমোদন দেবে কি না, সেটা একটা প্রশ্ন। একপক্ষ দিলে অন্য পক্ষ না করে দেবে কিনা সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। বস্তুত করিডোর বাস্তবায়ন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং রাখাইনের দখলদার আরাকান আর্মির সম্মিলিত ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
জান্তা সরকার আগাগোড়াই রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে গড়িমসি প্রদর্শন করে আসছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গার পুনর্বাসনে জান্তা সরকার রাজি হলেও এর প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। কারণ, রাখাইন জান্তা সরকারের হাতে নেই। এখন যাদের হাতে রাখাইন, সেই আরাকান আর্মির সিদ্ধান্ত ও সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে অপরিহার্য। বাংলাদেশ একটি কঠিন সমস্যার মধ্যে পড়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট তার জন্য বড় রকমের মাথা ব্যথার কারণ। সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিপার্শ্বিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে বাংলাদেশ।
মূলত মিয়ানমারে বর্তমান দুইটি পক্ষ। একটি পক্ষ আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ, অর্থাৎ জান্তা সরকার। অন্যপক্ষ আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ ও স্বীকৃত নয়, অর্থাৎ আরাকান আর্মি। বাস্তব কারণেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে সচেষ্ট রয়েছে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতাড়ন বন্ধ এবং দ্রæততম সময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসনে সবচেয়ে কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারে চীন। মানবিক করিডোর বাস্তবায়নেও তার সহযোগিতা আবশ্যক।
চীন মিয়ানমারের একমাত্র বন্ধু, যার সঙ্গে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি- উভয়ের সুসম্পর্ক রয়েছে। তার দ্বারাই সম্ভব উভয় পক্ষকে এক জায়গায় নিয়ে আসা। চীন বাংলাদেশেরও অকৃত্রিম বন্ধু। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সা¤প্রতিক চীন সফরের সময় চীন রোহিঙ্গা সংকট নিরসন ও রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। দেশবাসী আশা করছে, সরকার চীনের সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে।
এ প্রসঙ্গে চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘ভেতরের খবর আমরা জানি না। আমরা জানি মানবিক করিডোরের জন্য জাতিসংঘ অনুরোধ করেছে। কী কী শর্তে এই করিডোর দেওয়া হবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কাছে করিডোরের সম্প‚র্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে, যাতে কখন কী যাচ্ছে, কীভাবে যাচ্ছে, কোন লোকেশনে যাচ্ছে, তা জানা যায়। নিয়ন্ত্রণ না থাকলে এমন কিছু যেতে পারে, যেটা উচিত না।’
আপনার মতামত লিখুন :