পটুয়াখালীঃ

প্রায় একযুগ আগে ৩৩ শতক জমি কিনেছেন কৃষি শ্রমজীবী মিজানুর রহমান। এখন চায়ের সঙ্গে মুদি দোকানি। তবে ছোট্ট পরিসরে। ওই দোকানের আয় দিয়ে চলছে ছয়জনের সংসার। পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দিকে যেতে লোন্দা সেতু পেরিয়ে ওপার গেলেই ডান দিকে বেড়িবাঁধের বাইরে বসবাস মিজানুরের। অস্বাভাবিক জোয়ারের সময় থাকেন পানিবন্দি। বর্ষা মৌসুমে অমাবস্যা- পূর্ণিমায় ঘরের মধ্যে পানি ঢোকে।

এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস মিজানুরের। দশ বছরের চরম দুর্ভোগের পরে ঘরের ভিটি অনেক উঁচু করেছেন। শুধু মিজানুর নন, সেতুর ডান দিকটায় মিজানুরের ভাইসহ আরও ৭/৮টি পরিবারের বসবাস। বাঁদিকেও অসংখ্য বসতি। বর্ষা মৌসুমে জোয়ারে থাকেন পানিবন্দি। পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা এরা। টিয়াখালী নদী তীরের জেগে ওঠা চরে বসতি তাদের।

ধানখালীর সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন তালুকদার জানান, শুধু লোন্দা থেকে নমরহাট বাজার পর্যন্ত এভাবে বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে প্রায় হাজার পরিবার। পুরো ইউনিয়নে রয়েছে আরও অন্তত পাঁচশ' পরিবার। তিনি জানালেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এসব পরিবারে প্রাণহানির ঝুঁকি থাকছেই। তারপরও ঝুঁকি নিয়ে মানুষগুলো বসবাস করছেন।

কখনও এরা দুর্যোগকালে বাড়ি ছেড়ে সংলগ্ন আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থান নেয়। কখনও বিপদে পড়ছে। এসব মানুষের বসতি দিন দিন বাড়ছে। কারণ বেড়িবাঁধের স্লোপে থাকত এসব পরিবার। এখন বাঁধের উন্নয়নসহ ওইসব এলাকা অধিগ্রহণ করা হয়েছে। রাস্তা গুলো সম্প্রসারণ করা হয়েছে। বাঁধের স্লোপ থেকে এরা উচ্ছেদ হয়ে গেছে।

চম্পাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান দেবপুরে আটটি। গোলবুনিয়ায় সাতটি, পাটুয়ায় ১৫-২০টি পরিবার অস্বাভাবিক জোয়ারে পানিবন্দি হয়ে থাকে। চরম ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস তাদের।

সাবেক চেয়ারম্যান এবিএম হুমায়ুন কবির জানান, তার ইউনিয়ন বালিয়াতলীর চরনজীব থেকে বাবলাতলা বাজার পর্যন্ত প্রায় দুইশ' পরিবার ছাড়াও পক্ষিয়াপাড়া বাজার থেকে শনিবারের বাজার পর্যন্ত আরও সাত-আটটি পরিবার বাঁধের বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে।

ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ দেলওয়ার হোসেন জানান, ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব ডালবুগঞ্জে ৪১ ঘর। গাববাড়িয়া বাঁধ থেকে মেহেরপুর পর্যন্ত ৪৫টি। ডালবুগঞ্জ, ধানখোলা সুইস, রসুলপুর, পেয়ারপুর, ফুলবুনিয়ায় ৪০টি এবং মনযাতলী, খাপড়াভাঙ্গা ও বরকৃতিয়ায় আরও কলাপাড়ায় সাত হাজার পরিবারের ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ৩০টি পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে।

মিঠাগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী হেমায়েত উদ্দিন জানান, ইউনিয়নের তেগাছিয়া বাজারের আশপাশে ২৫টি। মিঠাগঞ্জে তিনটি, মেলাপাড়া ৪০টি, উত্তর চরপাড়া ৬৮টি, দক্ষিণ চরপাড়ায় ১০টি এবং মধুখালীর লেকের দুইপাড়ে অনন্ত ৬০টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে।

লতাচাপলীর সাবেক চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা জানান, এই ইউনিয়নের ১৮৭০টি পরিবার অস্বাভাবিক জোয়ারের সময় পানিবন্দি থাকে। এসব পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে।

ধুলাসার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুর রহিম জানান, এখানকার গঙ্গামতি, চরগঙ্গামতি ও কাউয়ারচরে অন্তত তিন হাজার পরিবার খুব ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে। এদের বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক জোয়ারে বাড়িঘর পর্যন্ত ছাড়তে হয়। সিডরে এখানে প্রাণহানি ঘটে চার জনের।

লালুয়ার সাবেক চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস জানালেন, বেড়িবাঁধের বাইরের ঝুঁকিপূর্ণ সহস্রাধিক পরিবার বসবাস করছে। এক যুগ ধরে বেড়িবাঁধ না থাকায় এসব পরিবারে এখন জীবিকার দুর্ভোগ পরিণত হয়েছে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে।

নীলগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান বাবুল মিয়া জানান, নীলগঞ্জের আবাসনে বসবাসরত পরিবারগুলোসহ বাঁধের বাইরের শত শত পরিবারের বসবাস ঝুঁকিতে। অন্তহীন ভোগান্তি তাদের। একই দৃশ্য ১২টি ইউনিয়নের সর্বত্র। এভাবে অন্তত সাত হাজার পরিবার বেড়িবাঁধের বাইরে চরম ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস করছে।

এসব পরিবারের কমপক্ষে ৩০ হাজার মানুষ জীবন, সম্পদের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। এদের অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সময় বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কাটে বিনিদ্র রাত। জলোচ্ছ্বাস আতঙ্কে রয়েছে হাজার হাজার পরিবার। লোন্দার ২৫০ পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের জন্য একটি রিং বেড়িবাঁধ মেরামতের দাবিতে ভুক্তভোগী মানুষ মানববন্ধন, প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে আসছেন। কিন্তু দুর্গতি কমছে না।

সর্বশেষ পূর্ণিমার প্রভাবে বুধ ও বৃহস্পতিবারের অস্বাভাবিক জোয়ারে ভাসতে দেখা যায় এসব পরিবারের বাড়িঘর। জোয়ারের সময় থাকছেন পানিবন্দি। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রবিউল ইসলাম জানান, ইতোমধ্যে জমিসহ সেমিপাকা ঘর দিয়ে প্রায় ৯০০ পরিবারকে নিরাপদ আবাসন দেওয়া হয়েছে।