কাশ্মিরে নিহত মাদরাসা শিক্ষককে যেভাবে ‘উগ্রবাদী‘ তকমা দেয় ভারতীয় মিডিয়া


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মে ২৭, ২০২৫, ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ /
কাশ্মিরে নিহত মাদরাসা শিক্ষককে যেভাবে ‘উগ্রবাদী‘ তকমা দেয় ভারতীয় মিডিয়া

কাশ্মিরের মাদরাসা শিক্ষক মুহাম্মদ ইকবাল ৭ মে সকালে নিহত হন – বিবিসি

ইকবালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাকে উগ্রবাদী বলে মিথ্যা অভিযোগ করতে শুরু করে। তবে স্থানীয় পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল যে ওই অভিযোগ সত্য নয়। ভাইয়ের মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গেলে এখনো ফারুক আহমেদ রাগে ফুঁসছেন। সীমান্তের অন্যপাশ থেকে উড়ে আসা গোলার আঘাতে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের পুঞ্চ শহরের বাসিন্দা মুহাম্মদ ইকবাল ৭ মে সকালে নিহত হন। আগের দিনই পেহেলগামের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান শাসিত কাশ্মিরে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত।

পাকিস্তান অবশ্য পেহেলগামের হামলায় তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। আহমেদ বলছিলেন, যে জিয়া-উল-উলুম মাদরাসায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করতেন, সেখানেই মারা যান তার ভাই ইকবাল। তবে তার মৃত্যুটা ছিল পরিবারের সামনে সমস্যার শুরু। ইকবালের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল তাকে উগ্রবাদী বলে মিথ্যা অভিযোগ করতে শুরু করে। তবে স্থানীয় পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল যে ওই অভিযোগ সত্য নয়।

‘কাটা ঘায়ে লবনের ছিটা‘

আহমেদ বলছিলেন, ‘আমার ভাই একজন শিক্ষক ছিল, কিন্তু তারা তার দাঁড়ি ও মাথার টুপি দেখেই তাকে উগ্রবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটা যেন আমাদের কাটা ঘায়ে লবনের ছিটা দেয়া। আমরা ইকবালকে হারিয়েছি আর তারপরই গণমাধ্যম তাকে অসম্মান করল। মৃত মানুষ তো আর নিজের হয়ে কিছু বলতে পারে না!‘

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চারদিন ধরে চলতে থাকা সামরিক সঙ্ঘাতের সময়ে পাল্টা-পাল্টি গোলাবর্ষণে ইকবালসহ মোট ১৬ জন নিহত হয়েছেন। পাকিস্তান ৪০ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে, তবে এর মধ্যে কতজন সরাসরি গোলাবর্ষণের কারণে মারা গেছেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। একদিকে যখন সামরিক সঙ্ঘাত বাড়ছিল, অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরেকটি লড়াই শুরু হয়– অনলাইন ও টেলিভিশনে ভুয়া খবর ছড়ানোর লড়াই।

ইকবালের পরিচয় নিয়ে যেমন গুজব ছড়ানো হয়েছিল, তেমনই টিভি ও সংবাদ পোর্টালসহ মূলধারার গণমাধ্যমে আরো নানা বিভ্রান্তিকর ও ভুল তথ্য ছড়িয়েছিল। এসব ভুয়া তথ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল যে পাকিস্তানের করাচী বন্দর ধ্বংস করে দিয়েছে ভারত। যদিও পরে ভারত সরকার নিজেরাই এই তথ্য ভুয়া বলে জানিয়েছিল।

কিছু কিছু ভুয়া খবর আবার চিহ্নিত করাও কঠিন ছিল, যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের মুখে এরকম কথা বসিয়ে দেয়া হয়েছিল যে তার দেশের দু’টি যুদ্ধবিমান সঙ্ঘর্ষে ধ্বংস হয়েছে।

মাত্রা ছাড়া ভুয়া খবর

ভারতের একটি স্বাধীন সংবাদ পোর্টাল নিউজ লন্ড্রির ম্যানেজিং এডিটর মনীষা পাণ্ডে বলছিলেন, ‘যে মাত্রায় ভুয়া তথ্য এবং যাচাই না করা তথ্য প্রচার করা হয়েছে গণমাধ্যমে, তা দেখে অবাক হয়ে যেতে হয়।‘ তিনি এটা অবশ্য মেনে নিয়েছেন যে চ্যানেলগুলো দর্শক টানার প্রতিযোগিতায় কিছুটা যে আবেগ উসকিয়ে দেয়ার মতো খবর করবে, এটা প্রত্যাশিত। তবে যে ‘উগ্র দেশপ্রেম এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন‘ভাবে ওই সঙ্ঘাতের সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে, তার মাত্রা ছিল অভূতপূর্ব, অন্তত তিনি আগে কখনো এমনটা দেখেননি।

চ্যানেলগুলোর এই দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ প্রচারের ফল আহমেদের থেকে বেশি বোধহয় আর কাউকে ভোগ করতে হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না নিউজ চ্যানেলগুলো কোথা থেকে আমার ভাইয়ের ব্যাপারে খবর পেয়েছিল।‘ ‘কার সঙ্গে কথা বলেছেন তারা? আমার ভাই যে উগ্রবাদী তার কী প্রমাণ ছিল তাদের কাছে?‘ প্রশ্ন আহমেদের। ঘটনার পরে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে, তবুও ওই পরিবারটি এখনো শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে জানা যায়

ফারুক আহমেদ বলছিলেন যে ৭ মে তার ভাই প্রতিদিনের মতোই সকালে মাদরাসায় যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। তবে ফিরে আসে তার প্রাণহীন দেহটা। দুপুরের মধ্যে তারা তাকে বাড়ির কাছেই একটি কবরস্থানে দাফন করেন।

পরিবারের সদস্যরা ব্যস্ত ছিলেন ইকবালের দাফন কার্যে। তাই বেশ কিছুটা সময় পর্যন্তও তারা জানতেনই না যে সংবাদমাধ্যমের একাংশে একটা মিথ্যা খবর দেখানো হচ্ছে। বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তাদেরই এক আত্মীয়ের কাছে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ কেউ ফরোয়ার্ড করে। ওই মেসেজটি ছিল একটি নামকরা নিউজ চ্যানেলের একটি ভিডিও ক্লিপ। সেখানেই দাবি করা হয় যে ভারতীয় সেনাবাহিনী একজন ‘উগ্রবাদীকে‘ হত্যা করেছে, খবরের সাথে স্ক্রিনে ইকবালের ছবি ভেসে উঠেছিল।

আহমদ বলেন, ‘আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপরেই আরো মানুষ আমাদের ফোন করতে শুরু করেন। তারা জানতে চাইছিলেন যে ঘটনাটা আসলে কী, কেন গণমাধ্যমে ইকবালকে উগ্র বলে খবর দেখাচ্ছে!‘

পুলিশের বিবৃতি

ইকবাল আহমেদকে ‘উগ্রবাদী‘ বলে বর্ণনা করে খবর দেখিয়েছিল জি নিউজ, এবিপি এবং নিউজ ১৮-সহ আরো কয়েকটি চ্যানেল। এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ওই চ্যানেলগুলোর সাথে যোগাযোগ করেছে বিবিসি।

একটি চ্যানেল দাবি করেছিল যে ইকবাল পাকিস্তান শাসিত কাশ্মিরে ‘উগ্রবাদী শিবিরের ওপরে ভারতীয় হামলায়‘ নিহত হয়েছেন এবং তিনি পাকিস্তান-ভিত্তিক ‘উগ্রী গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার একজন উগ্রবাদী‘ ছিলেন।

আহমেদ বলছিলেন, ‘আমাদের পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে পুঞ্চে বসবাস করছেন। এটা তারা কিভাবে বলল যে আমার ভাই পাকিস্তানে ছিল? তাদের (গণমাধ্যমের) লজ্জিত হওয়া উচিত।‘ ইকবালের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এত ব্যাপকভাবে এবং এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল যে ৮ মে পুঞ্চ পুলিশ একটি বিবৃতি প্রকাশ করে স্পষ্ট করে যে সীমান্তে পাল্টাপাল্টি গোলাবর্ষণের সময়ে মাদরাসার ভেতরেই মারা গেছেন তিনি।

‘পুঞ্চ পুলিশ এই ধরনের মিথ্যা তথ্য দৃঢ়ভাবে খারিজ করছে। মৃত মৌলানা মুহম্মদ ইকবাল এলাকার একজন সম্মানিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং কোনো উগ্রবাদী সংগঠনের সাথে তার কোনো যোগ ছিল না।‘ তবে এই বিবৃতিটা যখন আসে, ততক্ষণে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। আহমদ বলেন, ‘তার আগেই তো ভুয়া খবরটা ভারতের লাখ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।’ তিনি আরো বলছিলেন যে নিউজ ১৮ চ্যানেলটি ছাড়া আর কেউই ওই ভুলের জন্য প্রকাশ্যে তার কাছে বা তাদের নিজেদের দর্শকদের কাছে ক্ষমা চায়নি।

আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ভাবনা

ফারুক আহমেদ বলেছিলে যে তিনি চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, তবে তাতে কিছুটা সময় লাগবে, কারণ তার পরিবারকে তো দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকার লড়াইটা লড়তে হচ্ছে এখন। ইকবালের দুই স্ত্রী ও আট সন্তান রয়েছে। তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য।

আহমেদ বলছিলেন, সরকার যে কয়েক লাখ ভারতীয় টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে, তা দিয়ে তো মাত্র এক বা দুবছর চলতে পারে। তাই ভবিষ্যতের জন্য চিন্তাভাবনা এখন থেকেই শুরু করতে হবে তাদের। ‘পুরো পরিবার আমার ভাইয়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। সে খুবই শান্ত এবং ভদ্র মানুষ ছিল, বাচ্চাদের পড়াতে খুব পছন্দ করত।‘ বলছিলেন আহমেদ।

‘কিন্তু এসব কথা এখন দুনিয়ার মানুষকে কে জানাবে! অনেকের কাছে আমার ভাই তো এখনও একজন উগ্রবাদী। তাই তাকে মেরে ফেলা সঠিক কাজ হয়েছে। তারা আর আমাদের কষ্ট বুঝবে কী করে?‘  প্রশ্ন ফারুক আহমেদের।

সূত্র : বিবিসি