কিডনিতে পাথর নিয়ে আর কোন ভাবনা নয়


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৯, ২০২৪, ৯:৩৯ পূর্বাহ্ণ /
কিডনিতে পাথর নিয়ে আর কোন ভাবনা নয়

ডা. মোঃ ওবায়দুল কাদীর

আমাদের শরীরের কয়েকটি অঙ্গ যেমন: পিত্তথলি, কিডনি, অগ্ন্যাশয়ে পাথর তৈরি হতে পারে। এর মধ্যে কিডনি পাথর আমাদের দেশে প্রায়ই দেখা যায়। বিশেষ করে আধুনিক জীবন পদ্ধতি ও খাদ্যাভ্যাসের কারনে ইদানীং কিডনি পাথর রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাথর হওয়ার প্রক্রিয়া

আমাদের শরীরের বিপাক [metabolism] ক্রিয়ায় যেসব বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয় প্রস্রাবের সঙ্গে তা বেরিয়ে যায়, কিছু কিছু কারণে এ উপাদানগুলো দ্রবীভূত অবস্থা থেকে ঘনীভূত ও কঠিন হয়ে স্ফটিক বা ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এই স্ফটিকের চারপাশে আরও কণা জমে ধীরে ধীরে বড় হয়ে পাথর হয়। পাথর তৈরির উপাদান প্রস্রাবের মধ্যে থাকলেও স্বাভাবিক অবস্থায় সেগুলো দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে।
১) কিছু কিছু উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম ইউরিক এসিড এগুলোর ঘনত্ব বা পরিমাণ বেড়ে গেলে পাথর হতে পারে।
২) এই উপাদানগুলোর স্ফটিকায়ন বা ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রস্রাবের মধ্যে থাকা কিছু পদার্থ যেমন সাইট্রেট, ম্যাগনেসিয়াম জিনক ইত্যাদি বাধা দান করে প্রস্রাবে এই স্ফটিকায়ন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারী পদার্থগুলো কমে গেলে পাথর হতে পারে।

পাথর হওয়ার কারণ : পাথর হওয়ার বড় একটা কারণ শরীরে পানিস্বল্পতা। যাঁরা গরম আবহাওয়ায় কাজ করেন এবং পর্যাপ্ত পানি পান করেন না, তাঁদের শরীরে পানির পরিমাণ কমে পাথর তৈরির আশঙ্কা বেশি। তাই মরুভূমিতে, মধ্যপ্রাচ্যের গরম দেশগুলোতে কিডনি পাথরের রোগী বেশি পাওয়া যায়। বিশেষ করে আমাদের প্রবাসী ভাই যারা মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করেন তাদের মধ্যে প্রচুর কিডনি পাথরের রোগী পাওয়া যায়।
২) প্রস্রাবে বারবার সংক্রমণ পাথর হওয়ার আরেকটা কারণ
৩) মূত্র প্রবাহে বাধা
৪) খাদ্যাভ্যাস যেমন অতিরিক্ত রেডমিট
৫) কিছু মেটাবলিক রোগ যেমন হাইপার প্যারাথাইরয়েড রেনাল টিউবুলার এসিডোসিস, নেফ্রোক্যালসিনোসিস এবং
কিছু জন্মগত ত্রুটিজনিত কারণেও কিডনিতে পাথর হয়।
প্রয়োজন ছাড়া অযথা অতিরিক্ত ভিটামিন সেবন বিশেষ করে ভিটামিন সি ডি যা অক্সালেট ও ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব বৃদ্ধি করে।

পাথরের প্রকারঃ কিডনির পাথরগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রায় ৯০% পাথর সাধারণ এক্সরেতে দেখা যায়। যেমন- ক্যালসিয়াম অক্সালেট, মিক্সড অক্সালেট অক্সালেট ও ফসফেট। ট্রিপল ফসফেট ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও আলুমিনিয়াম ফসফেট। প্রায় ১০% সাধারণ এক্সরেতে দেখা যায় না যেমন : ইউরিক এসিড পাথর। জ্যানথিন পাথর। সিস্টিন পাথর।

কিডনি পাথরের লক্ষণসমূহ :
অনেক ক্ষেত্রেই কিডনিতে পাথরের কোনো লক্ষণ নাও থাকতে পারে। মেরুদ- বা অন্যান্য ব্যথার চেকআপের সময় ধরা পড়ে। কিডনির পাথরের জন্য ব্যথা হলে পেটের উপরের দিকে অথবা নিচের পিঠের দুই পাশে ডানে বা বাঁয়ে মাঝে মৃদু ব্যথা হতে পারে।
রক্তবর্ণের লাল প্রস্রাব, ব্যথা, জ্বালাপোড়া থাকতে পারে।
ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বা অল্প একটু প্রস্রাব হয়েই আর না হওয়া।
মাঝে মাঝে প্রস্রাবের সঙ্গে ছোট ছোট পাথর যেতে পারে।
কখনো কখনো কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হতে পারে
ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে।
পাথর যদি কিডনি নালি বা ইউরেটারে নেমে আসে তাহলে ওপরের পেট বা পিঠের পাশ থেকে কুঁচকির দিকে বা পেটের নিচের দিকের দুই পাশে বা কোমরে তীব্র বা প্রচ- ব্যথা হয় এবং সঙ্গে বমি বমি ভাব ইত্যাদি থাকে।
মূত্রনালী বা ইউরেটারে আটকে গেলে তীব্র ব্যথার সঙ্গে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর হতে পারে।
এটা একটা ইউরোলজিকাল ইমার্জেন্সি।

কিডনি পাথরের পরীক্ষা : কিডনিতে পাথর হয়েছে সন্দেহ করলে চিকিৎসক কিছু পরীক্ষা যেমন প্রস্রাব, আল্ট্রাসনোগ্রাম ও এক্সরে করে পাথরের উপস্থিতি নিশ্চিত হন। এরপরে সে পাথরের জন্য সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণের জন্য আইভিইউ অথবা সিটি স্ক্যান করতে হয়।

প্রাথমিক চিকিৎসা : রোগ নির্ণয়ের পর যথাযথ চিকিৎসার আগ পর্যন্ত সাধারণ ব্যথানাশক paracetamol/ Anti spasmodic প্রয়োজন হতে পারে।
যথাযথ বা নির্দিষ্ট চিকিৎসা : অনেক রোগীই ওষুধ চান, যা খেলে পাথর গলে বের হয়ে যাবে। সত্যিকার অর্থে এমন কোনো কার্যকরী ওষুধ নেই। তাই পাথর ছোট হলে নিজেই বের হয়ে যেতে পারে, তবে পাথর বড় হলে অপারেশন করে বের করতে হয়। পাথর কিডনির ভেতর থাকলে কিডনির ক্ষতি হয়। সেজন্যে যথাসময়ে পাথর অপসারণ করে পুনরায় যেন না হতে পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক।
কিডনির আধুনি চিকিৎসা :
পাথর ১ সে.মি. থেকে ছোট হলে সেগুলো এমনিতেই কিছু ওষুধের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়, কোনোরকম অপারেশন লাগে না। বড় পাথরগুলোর জন্য অপারেশনের প্রয়োজন হয়। আগে এ ধরনের পাথরের জন্যে পেট কেটে অপারেশন করতে হতো, তবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন পেট না কেটে নানাভাবে চিকিৎসা করা যায়। যেমন –
১) শক-ওয়েভ দিয়ে গুড়ো করে বের করা যায় (ঊঝডখ)
২) পিঠে ছোট ছিদ্র করে ( PCNL) মাধ্যমে বের করা যায়
৩) শক-ওয়েভ বা ছিদ্র ছাড়াও প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে RIRS-LASER, URS-ICPL, LITHOLAPEXY ইত্যাদি পদ্ধতিতে কিডনি, মূত্রনালী ও মূত্রথলির পাথর বের করা যায়।

প্রতিকার : গবেষণায় দেখা যায় একবার যেসব রোগীর কিডনি পাথর হয়েছে, পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০% রোগীর আবার পাথর হতে পারে। অপারেশন করে অপসারিত পাথর কেমিকেল এনালাইসিস করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে পাথর রোগ থেকে প্রতিকার পাওয়া যায়।
প্রতিরোধ : খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন ও পর্যাপ্ত পানি পান করা কিডনি পাথর প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
পানি বা তরল খাবার শরবতÑ দিনে ২.৫ থেকে ৩ লিটার

সুষম খাদ্য
সবজি বেশি খাবেন : ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন রেডমিট কম
যেসব খাদ্যে অক্সালেট বেশি থাকে তা কম খেতে হবে যেমন, পালংশাক, স্ট্রবেরি, মাখন, চকলেট, দুগ্ধজাতীয় খাবার।

লবণ পরিমিত
প্রয়োজন ব্যতিরেকে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট না খাওয়া
ওজনাধিক্য বা স্থূলতা থাকলে ওজন নিয়ন্ত্রণ
মেটাবলিক সমস্যা বা জন্মগত ত্রুটি চিকিৎসা করতে হবে।
এছাড়াও একেবারে শুয়ে বসে না থেকে নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক শ্রমের মাধ্যমে শরীরকে সচল রাখা।

উপসংহার
উপযুক্ত খাদ্যাভ্যাস ও সচল জীবন মেনে চললে কিডনি পাথর রোগ প্রতিরোধ করা যায়। পাথর হলেও দুশ্চিন্তার কিছু নেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে সফল্ভাবে কিডনি পাথরের সকল প্রকার চিকিৎসা সম্ভব। আশাব্যঞ্জক কথা হলো কিডনি পাথর চিকিৎসার সকল অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশে আছে।