মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্মম গণহত্যার স্মৃতি নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আছে কুমিল্লার লাকসাম বেলতলি বধ্যভূমি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১০ হাজারেরও বেশি নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি অবহেলিত। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য বিবেচনায় সম্প্রতি বেলতলি বধ্যভূমিকে দ্রুত সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
লাকসাম উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবদুল বারী মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সাধারণ মানুষসহ ট্রেনের যাত্রীদের পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে এখানে মাটিচাপা দিয়েছে। বেলতলি বধ্যভূমিতে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে মাটিচাপা দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল আজগরা বাজারে পাকিস্তান বাহিনীর বোমারু বিমানের আক্রমণে আনুমানিক ২৬ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। রক্তাক্ত আজগরা বাজার তখন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর নেতৃত্বে ছিলেন হাজী আলতাফ আলী। ১৫ এপ্রিল পাকিস্তান আর্মি চূড়ান্তভাবে লাকসাম দখলের পর প্রধান সড়ক ও রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন বিহারি আবদুল মান্নানের মালিকানাধীন চাঁদপুর টোব্যাকো কোম্পানিকে (থ্রি-এ সিগারেট ফ্যাক্টরি) বেছে নেয় যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে। এটি ‘মিনি ক্যান্টনমেন্ট’ নামে পরিচিত ছিল।
ব্রিটিশ আমল থেকেই লাকসাম রেলওয়ে জংশনটি সুপরিচিত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লাকসাম স্টেশন থেকে নিরীহ-নিরপরাধ পুরুষ ও নারী যাত্রীদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে এই বধ্যভূমিতে মাটিচাপা দিত। ‘মিনি ক্যান্টনমেন্টে’ ইলেকট্রিক শক দিয়ে লাশ নিয়ে আসা হতো এখানে মাটিচাপা দেওয়ার জন্য। যাদের দিয়ে দিনের বেলা গর্ত খোঁড়ানো হতো, তাদেরই রাতে ব্রাশফায়ার করে এই গর্তে ফেলা হতো।
এমন নির্মম চিত্র দেখে এ জনপদের মানুষ আতঙ্কিত হলেও যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে যাননি। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর বিভিন্ন কমান্ড লাকসামে অবস্থানরত দখলদার পাক হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। দুই দিন প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাক বাহিনী লাকসাম থেকে পশ্চিম দিকে মুদাফরগঞ্জ হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালাতে থাকে। পালানোর সময় মিত্র বাহিনী চুনাতি নামক গ্রামে এবং মুক্তিবাহিনী শ্রীয়াং ও বাংলাইশে পাক বাহিনীকে মুখোমুখি আক্রমণ করে। এতে অসংখ্য প্রাণহানিসহ অনেক পাক সেনা বন্দি হয়। অবশেষে ১১ ডিসেম্বর ভোরে যৌথ বাহিনী লাকসামকে শত্রুমুক্ত বলে ঘোষণা দেয়।