ড. মাহবুব হাসান
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে- একথা সরবে বলা ঠিক হবে না। কারণ, সেখানে আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে যা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর কালো দাগ ফেলেছে। বিশেষ করে শেষ চারটি কেন্দ্রের ফল প্রকাশে রিটার্নিং অফিসারের নানা গড়িমসি, ফোনে ঊর্ধ্বতনদের কথা বলা এবং তারপর ফল ঘোষণা। এটা আগে কখনোই বলা হয়নি যে, ইভিএমের লাল বোতাম পরপর দুবার টেপা হলে সেই ভোট বাতিল হয়ে যাবে। কুসিক নির্বাচনে বেশ কিছু ভোট বাতিল হয়েছে। ৩৪৩ ভোটে জিতেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তার হারকে অবিশ্বাস্য মনে করছেন। তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন বলে পত্রিকায় খবর এসেছে।
বলা হচ্ছে, এই ভোট সুষ্ঠু হওয়ার অন্যতম প্রধান উদাহরণ হলো প্রতিপক্ষের ওপর তেমন কোনো হামলা বা পাল্টা হামলা হয়নি। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সমর্থকদের হামলা করার উদগ্র বাসনা থেকে থামিয়ে রাখার জন্য অবশ্যই নবনির্বাচিত মেয়র রিফাতকে ধন্যবাদ জানাতে হবে এবং যে সংসদ-সদস্য নির্বাচনী আইন ভেঙে কুসিক তফসিলে অবস্থান করেছিলেন, তিনি ইসির আইনকে তোয়াক্কা করেননি। কারণ হয়তো এটাই যে তিনি সরকারদলীয় এমপি এবং তিনি ইসির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাতে কার্পণ্য করেননি। এ থেকে একটি রাজনৈতিক সঙ্কেত পাওয়া যায় যে, যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এবং তিনি এমপি, তাই তাকে ধরা সহজ নয়। সেটাই দেখা গেল। বাহার নামের সেই এমপি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের চিঠি পাওয়ার পরও এলাকা ছেড়ে যাননি। এটাকে আইন অমান্য বলা যাবে কি না, তা নির্বাচন কমিশন ভালো বলতে পারবেন। পুলিশও তাকে এলাকা ছেড়ে যেতে বলেনি। কারণ, পুলিশ সরকারের অধীন, নির্বাচন কমিশনের নয়। সে বা তারা নিজেদের সরকারের কাছে দোষী সাব্যস্ত হতে রাজি নয়।
এই যে একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারের এমন আচরণ, তা দলকেন্দ্রিক চেতনার ফল। দলে গণতন্ত্র থাকলে, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি প্রচলিত থাকলে সংসদ সদস্যের আচরণেরও জবাবদিহিতা থাকত। তাহলে তিনি একটু হলেও ভয় পেতেন বা সজাগ হতেন। যেহেতু তাকে কোনোরকম জবাবদিহিতা করতে হবে না, তাই তিনি ইসির অনুরোধ রক্ষা করতে বাধ্য হননি। এতে করে কেবল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক চরিত্রই প্রকাশ পায়নি, আগামী দিনগুলোতে আওয়ামী রাজনীতির ধারা যে এ পথেই প্রবাহিত হবে, তাতে কোনো ভুল নেই। ঠিক এ কারণেই কি বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো আওয়ামী সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে চায় না? কুসিক নির্বাচন দেখিয়ে যারা বলছেন যে, জাতীয় নির্বাচনে বর্তমান ইসি যোগ্যতর, তারা ভুলে গেছেন যে এই টেস্টকেসটিকে আওয়ামী নেতারা টোপ হিসাবে উপহার দিয়েছেন। যদি তা-ই না হবে, ইসির এলাকা ছাড়ার অনুরোধপত্র বা নোটিশকে সম্মান দিয়ে সংসদ সদস্য বাহার এলাকা ছেড়ে যেতেন। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতারাও তাকে এলাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা বলতে পারতেন। এমনকি দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রীও বলতে পারতেন এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কেউ সে অনুরোধ করেননি। বরং সাংবিধানিক সংস্থা ইসির প্রতি অবজ্ঞাই প্রদর্শন করেছেন। ওই সংস্থাটি যে ঢাল নেই তালোয়ার নেই/নিধিরাম সর্দার বলের চিহ্নিত ও চিত্রিত সেটাই আবারো প্রমাণিত হলো।
যদি নির্বাচন কমিশন সেক্রেটারিয়েটের পুরো জনবল নিয়োগ পেত, যদি সরকারের কাছ থেকে জনবল ধার নিতে না হতো, যদি ইসির অধীনে নিজস্ব পুলিশ বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা থাকত, তাহলে সংসদ সদস্যকে কুসিকের নির্বাচনী এলাকায় থাকতে দিত না তারা। নির্বাচনী আইন অমান্য করাই যে সব রাজনীতিকের রাজনৈতিক এজেন্ডা ও মনোভঙ্গি, সেসব রাজনীতিককে গণতান্ত্রিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত করা দুরূহ। আমরা চাই রাজনীতিকদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ যেখানে আচরণবিধি মেনে চলার শিক্ষা দেয়া হবে এবং তাদের সাংস্কৃতিক মেধার বিকাশ ঘটাতে সহায়ক হবে।
মেয়র নির্বাচনে এবারই প্রথম কোনো হানাহানি ঘটেনি এবং কোনো ব্যক্তি হত্যার শিকার হননি। এর জন্য রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডার, স্থানীয় প্রশাসন, ইসির দায়িত্বশীলতাকে ধন্যবাদ জানাই। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার রক্ষায় তারা অবদান রেখে জাতিকে শঙ্কামুক্ত রেখেছেন।
২.
বিএনপির মহাসচিব আবারো বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবেন না। এবার কুসিকের অন্তত দু’জন প্রার্থী ছিলেন বিএনপির, যারা পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ওই দু’জনই দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন। নির্বাচিত মেয়রের চেয়ে ৩৪৩ ভোটে হেরেছেন সাক্কু। আর তৃতীয় হয়েছেন যিনি তিনি ২৯ হাজারেরও বেশি ভোট পেয়েছেন। ওই দু’জনের ভোট এক করলে সাক্কুরই বিজয়ী হওয়ার কথা। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে জিততে হলে কী করতে হয়, আরিফ সেটা দেখিয়েছেন। দক্ষিণ কুমিল্লার বিএনপির আহ্বায়কের শ্যালককে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। অথবা তিনি সাক্কুর বিরোধিতার জবাব দিয়েছেন এবার তার বিরোধিতা করে। অন্তর্দলীয় কোন্দলে যে সাক্কু হেরেছেন সেটা বলা যায়। আবার এটাও বলা যায় যে, ইভিএমের কারসাজিতে বা রিটার্নিং অফিসারের তিন ঘণ্টার দেরি করে ফল প্রকাশের খেসারত দিতে হলো সাক্কুকে, নাকি ফোনকলের ভেতরে লুকিয়ে আছে ফল উল্টে দেবার ঘটনা, সেই বিষয়ে গভীর তদন্ত হওয়া জরুরি।
তার পরও সাক্কু জিতে গেলেও কি বিএনপি বলবে তারা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে? আমার মনে হয় না। তারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে আওয়ামী লীগের অধীনে। তাদের মূল দাবি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগ নানাভাবে বিএনপি ও তার অ্যালিদের খুঁচিয়ে, উসকে দিতে অব্যাহত কথার তীর, ব্যঙ্গাত্মক শ্লেষ করছেন। তাতে বিএনপি আক্রমণাত্মক রাজনীতিতে আসছে না। বিএনপি ধ্বংসের রাজনীতি পরিত্যাগ করেছে, এমনটা নয়। তাদের রাজনীতি ভাঙচুরের পথ পরিহার করে চলছে বলেই মনে করা যায়। যুক্তি আর বুদ্ধির খেলা রাজনীতিকে যারা হানাহানিতে নিয়ে যেতে চায়, তারা গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী। আমরা সেই রাজনীতি সমর্থন করতে পারি না।
রাজনীতিকে জনগণমুখী করতে হলে রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারের রাজনীতির সংস্কার জরুরি। নীতি-আদর্শ ও গণতান্ত্রিক আচরণ ইতিবাচক করে চর্চার অধীন করতে হবে, এর বাইরে থেকে কোনো কিছুই সঠিক বলে পরিগণিত হবে না।