শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরারের অনুরোধে সাড়া দেননি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) অনশনরত শিক্ষার্থীরা। তারা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনড় রয়েছেন। এছাড়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন ও জিরো পয়েন্ট ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেছে।
অপরদিকে কুয়েট সিন্ডিকেটের ১০২তম সভায় কুয়েটের সকল হলগুলো খুলে দেয়া ও সাময়িক বহিষ্কৃত ৩৭ শিক্ষার্থীর শাস্তি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ কিছু ছাত্রের ভিসির পদত্যাগ দাবির বিরোধীতা ও শিক্ষকদের অমর্যাদা করা, গায়ে হাত তোলা, থুথু দেওয়াসহ সব রকমের অপমান অপদস্থের সুষ্ঠু বিচার না হলে ক্লাস ও সকল কর্মকাণ্ড বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বুধবার সকালে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার কুয়েটে আন্দোলনরতদের মাঝে এসে বলেছেন, কুয়েটের সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে।
কুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রসঙ্গে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বা আমরা বর্তমান অন্তরবতি সরকার কোনও ব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলবো না, পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। কুয়েটের অংশীদার যারা ছিলেন তাদের নিয়ে কমিটি হচ্ছে, বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে তারা যে পরামর্শ দেবেন সেগুলো সরকার বিবেচনায় নেবে। তবে সমস্যা সমাধান করার যে প্রক্রিয়া সেটি আমরা তরান্বিত করছি। আশা করি, দ্রুত সমাধান হবে।
এ ছাড়া তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা যেন আর না ঘটে সে বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। পুরো সমাজ একটি অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে চলছে এবং সব যে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে সেটি ভাবাও বোধ হয় ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, আগের সরকারের সময়ে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করার সুযোগ-সুবিধা ছিল না এবং যখনই কেউ দাবি-দাওয়া উত্থাপন করতো তখন রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়তো তাদের উপরে। বর্তমানে রাষ্ট্র মনে করে যে, এখন একটি ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের দাবি-দাওয়া আমরা সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখছি। আমরা চেষ্টা করবো, তারা যেটি চাচ্ছে সেটি নিয়মের ও আইনের মধ্যে এবং যুক্তিসঙ্গত সমাধান করার। তারা হয়তো অতীতের মতো ভাবছে, সমাধান হবে না, কিন্তু আমরা অতিদ্রুত সমাধান করবো।’
এদিকে কুয়েট সিন্ডিকেটের ১০২ তম সভায় কুয়েটের সকল হলগুলো খুলে দেয়া ও সাময়িক বহিষ্কৃত ৩৭ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অনশনকারীদের ভিসির পদত্যাগ দাবির বিরোধীতা ও শিক্ষকদের অমর্যাদা করা, গায়ে হাত তোলা, থুথু দেওয়াসহ সব রকমের অপমান অপদস্থের সুষ্ঠু বিচার না হলে ক্লাস ও সকল কর্মকাণ্ড বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছেন। দাবি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসব্রিফিং করেছে শিক্ষক সমিতি।
ব্রিফিংয়ে বলা হয়, শিক্ষকদের গায়ে থুথু দেওয়া, অমর্যাদা করা, গায়ে হাত তোলাসহ সব রকমের অপমান অপদস্থের সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। দোষ থাকলে ভিসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আর দোষী না হলে ভিসির মর্যাদা সমুন্নত রাখা হোক। শিক্ষকদের অপমান অপদস্থের সুষ্ঠু বিচার হতে হবে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকরা ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড.শাহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, প্রফেসর ড. আশরাফুল গনি ভুইঁয়া প্রমুখ।
প্রেসব্রিফিংয়ে বলা হয়, শিক্ষকদের কথা পৌঁছানো লক্ষ্য। ১৮ ফেব্রুয়ারির ঘটনার জের ধরে বুধবার পর্যন্ত কুয়েট অশান্ত। উত্তরণের আশানুরূপ দিক নির্দেশনা নেই। শিক্ষা উপদেষ্টা ও ইউজিসির কমিটি তদন্ত করছে। আমরা কষ্ট নিয়ে এ আয়োজন করছি। ওই ঘটনায় শিক্ষকের মাথা থেকে রক্তও ঝরেছে। শিক্ষকরা ছাত্র ও প্রশাসনের সঙ্গে থেকে সুরাহার চেষ্টা করেছে। ছাত্রদের দাবি ছিল পাঁচটি। তার সবগুলোই যথোপযুক্তভাবে পূরণ করার চেষ্টা করেছে সিন্ডিকেটের সভায়। পরে ৫ দফা থেকে এখন দেখছি তা ৬ দফায় মোড় নিয়েছে। এটা নিয়ে শিক্ষকরা যৌক্তিক অবস্থান নেয় ও কথা বলে।
তারা বলেন, সময় যতো গড়ায় ততো ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছে। শিক্ষকদের প্রতিটি কাজের ভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হয়েছে। কুয়েট প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করার কারণে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা করা হয়েছে। নামাজ পড়তে না দেওয়া, ইন্টারনেট বন্ধ, বিদ্যুৎ পানি বন্ধ করার অভিযোগ উঠেছে। এগুলোর কোনোটাই সত্য নয়। ছাত্রদের মুখোমুখি শিক্ষকরা হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। এগুলোর সুযোগ অন্য কেউ নিতে পারে। বারবার শিক্ষকদের হেয় করা হচ্ছে। শিক্ষকদের বক্তব্য নিয়ে ট্রল করা হয়, শিক্ষকদের অসম্মানিত করা হয়, শিক্ষকদের বার বার নিগৃহীত করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন ব্যানারে ঘটনাটি ছড়িয়ে দিচ্ছে। কুয়েটে ফার্স্ট কেস হিসেবে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কিসের ফার্স্ট কেস।
তারা বলেন, শিক্ষকরা সুনাম রক্ষায় অবিচল থাকবে, এটাকে ব্যাটেল গ্রাউন্ড বানিয়ে সুবিধা নিতে চাওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাই। অপরাধীদের শনাক্ত ও শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকরা প্রয়োজন হলে একাডেমিক কার্যক্রম থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখবে। শিক্ষকদের আহত করার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত ক্লাসে যাবে না। ছাত্রদের যৌক্তিক দাবির সঙ্গে আমরা একমত ভিসির নিয়োগে আমাদের হাত নেই। ওনাকে অপসারণের দায়িত্ব শিক্ষকদের নয়। ছাত্রদের পাঁচটি দাবির সাথে আমরা একমত। এভাবে বলার পরও ছাত্ররা শিক্ষকদের মর্যাদা দেয়নি। কিন্তু ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আমরা শিক্ষকরা কিছু করতে পারি না। আমরা কুয়েটের সুনাম রক্ষায় পদক্ষেপ নিতে পারি। রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস গঠনে ভিসিকে সময় দেওয়া দরকার ছিল। দাবি বাস্তবায়ন না হলে আমরাও আন্দোলনে নামতে প্রস্তুত আছি। ভিসিকে নিয়োগ দিয়েছেন সরকার। তাই সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। তবে সরকারকে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেতে হবে। তখন দোষী সাব্যস্ত হলে ভিসিকে অপসারণ হোক। দোষী না হলে ভিসির অপসারণের সুযোগ নেইে।
ওদিকে কুয়েটে আমরণ অনশনের তৃতীয় দিন অব্যাহত রয়েছে। অনশন চলাকালে বুধবার চারজন অসুস্থ হয়ে কুয়েট ও নগরীর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে বলে জানাগেছে। অনশন শুরু করা ৩২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৯জনই অসুস্থ হওয়ায় আন্দোলনে রয়েছেন ২৩ জন।
প্রেসব্রিফিংয়ে ছাত্ররা বলেন, তাদের দাবি পুরণ না করে ইউজিসির নেতৃবৃন্দকে কুয়েট ত্যাগ না করার আহবান জানান। পরে সন্ধায় তারা একটি প্রতিকী কফিন মিছিল বের করে।
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) উদ্ভূত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ ও শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো পর্যালোচনা করতে কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলটি দাবিগুলো পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া আশ্বাস দিয়েছে। বুধবার (২৩ এপ্রিল) বেলা ১১টার দিকে ইউজিসি প্রতিনিধিদল কুয়েটে পৌঁছায়। তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তনজিমউদ্দীন খান, বুয়েটের অধ্যাপক সাইদুর রহমান এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব আহমেদ শিবলী।
প্রতিনিধিদলের সসদস্যরা প্রথমেই অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। তারা অনশনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর চেষ্টা চালান। যদিও তারা একজনমাত্র শিক্ষার্থীকে অনশন থেকে সরিয়ে আনতে সফল হন। অন্য শিক্ষার্থীরা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যেতে দৃঢ় থাকেন। পরবর্তী সময়ে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের নিয়ে এক বৈঠক করেন। দীর্ঘ দুই ঘণ্টার এ বৈঠকে শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর সংঘটিত হওয়া হামলা, তাদের আন্দোলন ও দাবিগুলো তুলে ধরেন।
খুবি শিক্ষার্থীদের ব্লকেড: কুয়েট ভিসির পদত্যাগ দাবিতে খুলনার জিরোপয়েন্ট ব্লকেড করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। কুয়েটের শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে খুবি শিক্ষার্থী। বুধবার দুপুর ৩ টায় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল নিয়ে তারা জিরো পয়েন্ট মোড় অবরোধ করেন। এ সময় খুলনা-সাতক্ষীরা ও খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে পুলিশের অনুরোধ ও তীব্র গরমে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কথা ভেবে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিয়ে সড়কের একপাশে সমাবেশ করেন। এর আগে কুয়েট শিক্ষার্থীদের এক দফা দাবির সমর্থনে আজ সকাল থেকে ক্লাস বর্জন করেন খুবি শিক্ষার্থীরা। ফলে খুবির অধিকাংশ বিভাগে কোনো ক্লাস হয়নি।
এছাড়া কুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে নগরীর শিববাড়ি মোড়ে দুপুর ১২টার দিকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। খুলনা সচেতন নাগরিক সমাজ, রেড জুলাই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠন এ কর্মসূচির আয়োজন করে।
অপরদিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কফিন মিছিল বের করে। সন্ধ্যা সোয়া ৬ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে থেকে কফিন মিছিলটি বের হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বার বাংলার পাদদেশের সামনে দিয়ে মিছিলটি প্রশাসনিক ভবনের সামনে ভবনের সামনে অবস্থান নেয়।
আপনার মতামত লিখুন :