কুরবানি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ও বিশেষ ইবাদত। হযরত আদম আলাইহিস সালামের যুগ থেকে তা চলে আসছে। তবে সব নবীর শরীয়তে এর পদ্ধতি এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে এর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূল সূত্র ‘মিল্লাতে ইবরাহীমী’তে বিদ্যমান ছিল। এ জন্য কুরবানিকে ‘সুন্নতে ইবরাহীমী’ বলা হয়। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানির কথা খোদ কুরআন মাজীদে উল্লেখিত হয়েছে এবং এর সঙ্গে জুড়ে আছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
বহু দিন ধরে ইবরাহীম (আ.)-এর কোনো সন্তান হচ্ছে না। ধীরে ধীরে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সন্তান জন্মের স্বাভাবিক বয়স পার হয়ে যায়। জীবনসন্ধ্যায় দাঁড়িয়েও তিনি আল্লাহ তা‘আলার কাছে নেক সন্তান প্রার্থনা করেন, ‘হে আমার রব! আমাকে নেক সন্তান দান করুন।’ (সূরা সাফফাত-১০০)। যত দিন যাচ্ছিল ইবরাহীম (আ.)-এর হৃদয়ে সন্তানের আকাক্সক্ষা ততই তীব্র হচ্ছিল এবং আল্লাহর কাছে ততই দুআ-কাতর হচ্ছিলেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর আকাক্সক্ষা পূরণ করে একজন সহনশীল পুত্রসন্তান দান করেন। এই সন্তানের নাম রাখেন ইসমাঈল।
একজন অশীতিপর বৃদ্ধ লোক সন্তানের মুখ দেখলে কত আনন্দিত হবে সহজেই অনুমেয়। ইবরাহীম (আ.) শুধু আনন্দিতই হননি; আল্লাহর শোকরে তাঁর হৃদয় ভরে যায়। তিনি শোকর আদায় করে বলেন, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাক দান করেছেন। নিশ্চয় আমার রব দুআ শ্রবণকারী।’ (সূরা ইবরাহীম-৩৯) ইবরাহীম (আ.) শামে বসবাস করতেন। একসময় আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো, পুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মা হা-জারকে যেন মক্কায় রেখে যান। মক্কায় তখন জনবসতি ও জীবনোপকরণ কিছুই ছিল না। তারপরও আল্লাহর নির্দেশ মতো তিনি তাঁদেরকে সুদূর মক্কায় রেখে যান।
ইসমাঈল (আ.) ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে শুরু করেন। তিনি যত বড় হচ্ছিলেন, তাঁর প্রতি পিতার ভালোবাসা তত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। যখন তিনি ছোটাছুটি করার বয়সে উপনীত হন তখন ইবরাহীম (আ.) এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। তিনি স্বপ্নে দেখেন, একমাত্র কলিজার টুকরোকে যবেহ করছেন। এটা যদিও স্বপ্ন ছিল; কিন্তু নবীগণের স্বপ্ন ওহীর মতো হয়ে থাকে। তাই এ স্বপ্নের অর্থ এই ছিল যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে ইবরাহীম (আ.)-কে একমাত্র সন্তান ইসমাঈল (আ.)-কে যবেহ করার আদেশ করা হয়েছে।
ইসমাঈল (আ.) যদিও ইবরাহীম (আ.)-এর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও দুআর ফল; কিন্তু তাঁর কাছে আল্লাহর আদেশ ছিল সবার উপরে। তিনি খুশিমনে এ আদেশ পালন করতে রাজি হয়ে গেলেন। কেননা, সন্তান আল্লাহ্ই দান করেছেন। এখন তিনিই তাকে যবেহ করার আদেশ করেছেন। তাঁর দেয়া সম্পদ তাঁর জন্য কুরবান করতে দ্বিধা কিসের? বান্দার জন্য এটা বরং সৌভাগ্যের বিষয়।
ইবরাহীম (আ.) অতীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন এবং সবগুলোতে চূড়ান্ত সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। এই আদেশ পালনেও নিজের দিক থেকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা যেহেতু দুইজনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল, তাই অপরজনের অভিমত জানা বা অন্তত অবহিত করা উচিত। এতে তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে পারবেন অথবা তার কোনো দ্বিধা থাকলে বুঝানো-সমঝানো যাবে।
ইবরাহীম (আ.) নিজ স্বপ্নের কথা সন্তানকে জানিয়ে তাঁর অভিমত জানতে চাইলেন, ‘হে আমরা বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি, তোমাকে যবেহ করছি। তাই তুমি চিন্তা করে দেখ, তোমার অভিমত কী?’ কিন্তু তিনি তো ছিলেন খলীলুল্লাহর পুত্র এবং ভাবী নবী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘হে আমার পিতা! আপনাকে যে আদেশ করা হয়েছে তা করে ফেলুন। আপনি আমাকে আল্লাহ চাহেন তো অবশ্যই ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।’ (সূরা সাফফাত-১০২)।
এটা ইসমাঈল (আ.)-এর গভীর জ্ঞান ও বিনয়ের পরিচায়ক। ইবরাহীম (আ.) তাঁর কাছে একথা বলেননি যে, আল্লাহ তোমাকে যবেহ করার আদেশ করেছেন; তিনি একটি স্বপ্নের কথা বলেছেন মাত্র। কিন্তু ইসমাঈল (আ.) বুঝে ফেলেছেন, এ স্বপ্ন মূলত আল্লাহর একটি আদেশ।
আপনার মতামত লিখুন :