আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলন ভালোঃ ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের আশা প্রতিদিন ভোর থেকে দিনব্যাপী চলে কেনাবেচা দাম কমে যাওয়ায় আশাহত চাষিরা
হাঁকডাকে মুখর আমের হাট
গোপালভোগ, খিরসাপাত, নাক ফজলি, ল্যাংড়া, হাড়িভাঙ্গা দিয়ে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত নওগাঁয় জমে উঠেছে আমের হাট। জেলার সাপাহার-নজিপুর আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসেছে আমের হাট। এবার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁয় ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের আশা করছে কৃষি বিভাগ। প্রতিদিন ভোর থেকে দিনব্যাপী চলে কেনাবেচা। অন্যদিকে উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম আমের হাট বসে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের পর সবচেয়ে বেশি আম বেচাকেনা হয় এ হাটে। সূর্য ওঠার আগে থেকে চাষিরা ভ্যান, ভটভটি এবং অটোরিকশায় ক্যারেট সাজিয়ে বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে নিয়ে আসেন বিভিন্ন প্রজাতির আম। ঈদের আগেই আমের বেচাকেনা শুরু হয়েছিল, তবে ঈদের পরেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসতে শুরু করে ব্যবসায়ীরা। গত কয়েকদিনের প্রচ- তাপদাহ ও গরমের কারণে আম পেকে যাওয়ায় প্রায় সব জাতের আম এক সাথে বাজারে এসেছে। ফলে কিছুটা কমে গেছে আমের দাম। অন্যদিকে জয়পুরহাটে ব্যাপক হারে গুটি আমের ব্যাপক ফলন হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে’র প্রতিবেদনে-
গোদাগাড়ী (রাজশাহী) উপজেলা প্রতিনিধি জানান, রাজশাহী অঞ্চলে অনুকূল আবহাওয়ায় থাকায় চলতি মৌসুমে আমের ভালো ফলন হয়েছে। মৌসুমের শুরু থেকে পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত স্বল্প বিরতিতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত হওয়ায় এ বছর আমের আকার বড় ও পুষ্ট হয়েছে। আমের গুণগত মানও বেশ ভালো। চলতি বছর এ অঞ্চলের বাগানগুলোতে গাছে গাছে আম ঝুলতে দেখে চাষিরা আশায় বুক বেঁধেছিলেন। আম বিক্রি করে ভালো পয়সা পাবেন। প্রচণ্ড গরম, ঈদুল আজহার ছুটিতে কুরিয়ার সার্ভিস বন্ধ থাকা, অফিস ছুটিসহ বিভিন্ন কারণে এবার ১৫ থেকে ২০ দিন আমের দাম পায়নি আম চাষিরা। গরমের কারণে আম একসাথে পেকে সামান্য বৃষ্টি, বাতাসে বেশির ভাগ আম পড়ে গেছে।
আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জ বলা হয় আর আমের বড় বাজার বলতে কানসাট বাজার বলা হয়। এখানে আমের মৌসুমে কয়েক হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাজশাহী চাঁপাইনবাগঞ্জ অঞ্চলে এখন হাজার হাজার বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে এ আমগাবান। আর চলতি আমের মৌসুমে আমকেন্দ্রিক লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, বানেশ্বর, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের, শিবগঞ্জ, নাচোল, গোমস্তাপুর, নওগাঁ জেলার সাপাহার, নিয়ামতপুর, মহাদেবপুর, পোরশা উপজেলার অধিকাংশ এলাকায় গড়ে উঠেছে শত শত একর জমিতে আমবাগান। আম চাষিরা জানান, ঈদের ছুটি, গরমে আগাম পাকা আম এবং অনলাইন ক্রেতাদের অনুপস্থিতি- সব মিলিয়ে দাম কমেছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় সবমিলিয়ে এ বছর আম চাষ হয়েছে ৮৭ হাজার ৩০৭ হেক্টর জমিতে। এখান থেকে প্রায় ১০ লাখ টন আম উৎপাদন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে কৃষি বিভাগ। যা থেকে আয় হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। যা অতিতের সব রেকর্ড ভাঙবে এবার।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফরের উপপরিচালক উম্মে সালমা জানান, এ বছর জেলায় ১৯ হাজার ৬০৩ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। এখান থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ২ লাখ ৬০ টন। আশা করছি, চাষিরা এবার আমের ফলন ভালো পাবেন। এ আম থেকে এবার অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা আয় হবে চাষিদের।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে দেশে ২৮ লাখ টন আম ফলনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় ১২ লাখ ৫৫ হাজার টন আম ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলাভেদে এবারও আম উৎপাদনে শীর্ষস্থানটি রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার। এ জেলায় চলতি মৌসুমে ৪ লাখ ৫৮ হাজার টন আম ফলনের আশা করা হচ্ছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আম উৎপাদনের জেলা নওগাঁয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার টন আমের ফলন হওয়ার আশাবাদ থাকলেও হাইব্রিড জাতের আম্রপালির ফলন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছু কম উৎপাদন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রাজশাহীতে ২ লাখ ৮৫ হাজার ৮৪৩ টন ও নাটোর জেলায় ১ লাখ ৪৩ হাজার টন আম ফলনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক ড. আজিজুর রহমান বলেন, রাজশাহী অঞ্চলে এবার আমের ফলন বেশ ভালো। তবে তাপপ্রবাহ, গরম ও একটানা কিছুদিন বৃষ্টিহীনতার কারণে আম দ্রুত পেকে যাচ্ছে। ঈদের লম্বা ছুটির কারণে আম চালান ও পরিবহণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। এতে আমের দাম কিছুটা কমেছে। এরপরও ফলন যেহেতু ভালো হয়েছে ফলে চাষিরা সেই ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন।
পুঠিয়া (রাজশাহী) উপজেলা সংবাদদতা জানান, পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে আমের দাম না পেয়ে চাষিরা হতাশ হয়ে পড়েছে। এবার আমের ভালো ফলন হয়েছে। আমের দাম পরে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের কথা বলছে ব্যবসায়ীরা। অতিরিক্ত গরমে আম আগেভাগে পয়ে যাওয়া ও দীর্ঘ দিন ঈদের ছুটি থাকায় ব্যাংকের লেনদেন বন্ধ ও পশু কুরবানির পর হাটে পাইকারী ক্রেতার অভাবে আমের দাম পড়ে গেছে।
আমচাষিরা জানান, গত বছর এবারের তুলনায় আমের দাম দ্বিগুণ ছিল। ঈদের ছুটিতে ১০ দিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। ঈদের ছুটির পর ক্রেতা না থাকা বাজারে প্রচুর আমের আমদানি থাকলেও ক্রেতা না থাকায় আমের দাম পড়ে গেছে। এ বছর আমের ভরা মৌসুমে ঈদুল আযহা উদযাপন হওয়ার কারণে আমের বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। এতে আমের দাম কমে গেছে। এছাড়াও বর্তমানে বানেশ্বর বাজারের প্রতি মণ আমের সাথে ৪ থেকে ৫ কেজি টোল নিচ্ছে পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এতে আম বাগান মালিকেরা আরো আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, নওগাঁর সাপাহার উপজেলা এখন আমের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে এবং দেশের সবচেয়ে বড় আম বাজার এখন এই উপজেলায়। চলতি মৌসুমে দেশের বৃহত্তর আমের হাট নওগাঁর সাপাহার ইতোমধ্যে ক্রেতা ও বিক্রেতার পদচারণার সরগরম হয়ে উঠছে। যদিও ঈদের আগেই এই হাটে আমের বেচাকেনা শুরু হয়েছে, তবে ঈদের পরেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আমের পাইকারদের এই হাটে পুরোদমে দেখা গেছে। আবহাওয়া জনিত কারণে এবার ম্যাংগো ক্যালেন্ডারের সূচি ছাড়াই সকল জাতের আম পাকতে শুরু করে, ফলে হাটে সকল জাতের আমের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ম্যাংগো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২২ মে গুটি জাতের আমের মধ্যে দিয়ে আম পাড়া কার্যক্রম শুরু হয় তবে ধারাবাহিক ভাবে গোপালভোগ, খিরসাপাত, নাক ফজলি, ল্যাংড়া, হাড়িভাঙ্গা চলমান থাকলেও সময়ের আগেই দেখা মেলেছে আম্রপালি,বারি-৪ ও ব্যানানা ম্যাংগো আমের।
সাপাহার উপজেলা আম আড়ৎদার সমবায় সমিতি লিমিটেডের সহ সভাপতি জয়নাল আবেদীন জানান, তুলনামূলকভাবে এবছর আমের ফলন কম হলেও আমের সাইজ অনেক ভালো হয়েছে। ইতোমধ্যে আমের বেপারীরা কেনা বেচা শুরু করে দিয়েছে। ওজন বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাশ্ববর্তী রোহনপুর, ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং কানসাটের ব্যবসায়ীরা ৫০ থেকে ৫২ কেজিতেই মণ হিসেবে আম ক্রয় করছেন।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, এবছর ৯ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, জয়পুরহাটে সাধারণত ব্যাপক হারে গুটি আমের ব্যাপক ফলন হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা জানান, আমের জন্য এ জেলা তেমন বিখ্যাত না হলেও স্থানীয় জাতের নাক ফজলী, খিরসাপাত, বারি ৪ ল্যাংড়া, গোপালভোগ আম বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদরের সূত্রে জানা যায় ’ জেলায় চলতি ২০২৪-২৫ মৌসুমে সাড়ে ৬ শত হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে এতে আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়নি। এ ছাড়াও বে-সরকারি পর্যায়ে চার শতাধিক ছোট ছোট আমের বাগানও রয়েছে। স্থানীয় জাতের মধ্যে ’নাকফজলী’ সুবর্ণরেখা, সুরমাফজলী, ক্ষিরশাপাত, আশ্বিনা, গোপালভোগ, লেংড়া আম বেশ জনপ্রিয়।
সাতক্ষীরা জেলা সংবাদদাতা জানান, সাতক্ষীরায় আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। সরকারি হিসেবে ৬৮ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে সাতক্ষীরার উৎপাদিত আমের মধ্য থেকে গোবিন্দভোগ, হিমসাগর ও ল্যাংড়া আম বিদেশে রফতানি হচ্ছে। একই সাথে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাতক্ষীরার আম সরবরাহ করা হয়ে থাকে। সাতক্ষীরা খামার বাড়ি জেলার আমচাষিদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করে দিয়ে থাকে। ফলে, দিনে দিনে চাষিরা আম উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।