শীত মৌসুমের জনপ্রিয় সবজি ফুলকপি সাদা রঙে দেখেই আমরা অভ্যস্ত। শহরের মানুষ বড়জোর কাছাকাছি জাতের সবুজ রঙের ব্রকলি চেনেন। কিন্তু নেত্রকোনার এক চাষি এ বছর উজ্জ্বল হলুদ আর গাঢ় বেগুনী রঙের ফুলকপি চাষ করে রীতিমত তারকা বনে গেছেন।
জানা যাচ্ছে, বর্ণিল এই ফুলকপিগুলোতে বিটা ক্যারোটিন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসায়ানিন্সের পরিমাণ বেশি থাকায় এগুলোর রয়েছে ক্যান্সারসহ আরো নানা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা। প্রান্তিক এই চাষি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, তিনি ২২ বছর ধরে কৃষিকাজ করেন। এটাই তার ও তার পরিবারের রুটিরুজি। কিন্তু এবার এই হলুদ আর বেগুনি ফুলকপি চাষ করার পরই প্রথম তাকে নিয়ে এতো আলোচনা হচ্ছে।
‘এতো ফোন পাচ্ছি, এতো কৃষক আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, যে আমি রীতিমত অভিভূত’, বলছিলেন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দূরের গ্রাম রসুলপুরের কৃষক সন্তোষ বিশ্বাস। তিনি এখন পরিকল্পনা করছেন, আসছে শীত মৌসুমে নিজের পুরো জমিতে রঙিন ফুলকপির চাষ করবেন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, এর বীজ বা চারা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। এমনকি গত শীতে, যখন ফুলকপি চাষের মৌসুম ইতোমধ্যেই শেষ, তখন যাদের কাছে এই চারা পেয়েছিলেন তারা নাকি জানতেনই না এটা ফুলকপির চারা।
জামালপুরের যে নার্সারি থেকে চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন ওই নার্সারির লোকজনই জানতেন না এগুলো ফুলকপির চারা, বলছিলেন সন্তোষ বিশ্বাস। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে কৃষি অধিদফতর আয়োজিত 'বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফসলের নিবিড়তাকরণ' প্রকল্পের আওতায় নেত্রকোনার জনা ত্রিশেক কৃষকের সাথে জামালপুর, শেরপুর আর টাঙ্গাইলের বিভিন্ন কৃষি খামার পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন সন্তোষ বিশ্বাস। জামালপুর সদরের এক খামারে চারাগুলোর সন্ধান পান তিনি।
‘ওরা বলছিল এগুলো ব্রকলির চারা। রঙটাও ঠিকঠাক বলতে পারেনি। বলছিল লাল আর গোলাপি হতে পারে।’ ‘শ তিনেক চারা ছিল ওদের কাছে। যদিও সিজন শেষ, কিন্তু আমি যেহেতু ব্রকলি আর ফুলকপি করি, তাই রঙিন দেখে বললাম, যতগুলো চারা আছে সবগুলো দিন।’ মৌসুম যদিও শেষ তারপরও বাড়িতে এনে কাঠা তিনেক জমিতে চারাগুলো পুঁতে দেন তিনি। তারপর খুব করে যত্ন করেন। বেশি করে ভার্মিকম্পোস্ট সার দেন জমিতে।
৪০-৪৫ দিনের মধ্যে তার ক্ষেতটি বর্ণিল হয়ে ওঠে। ভরে যায় উজ্জ্বল হলুদ আর গাঢ় বেগুনী রঙের ফুলকপিতে। বেগুনি ফুলকপিগুলোর এক একটির ওজন হয় দেড় কেজির ওপরে। আর হলুদগুলো হয় বারো শ’ থেকে চৌদ্দ শ’ গ্রামের। সন্তোষ বিশ্বাসের ক্ষেতে হওয়া উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের ফুলকপিটি মূলত কমলা বর্ণের হয়, জানা যাচ্ছে কৃষি বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও নিবন্ধ ঘেঁটে।
কোথায় মিলবে এই ফুলকপির চারা ও বীজ? সন্তোষ বিশ্বাসের পাঁচ সদস্যের পরিবারের রুটি-রুজি কৃষিকাজ। এক একরের সামান্য কিছু বেশি জমি রয়েছে তার। এর কিছু অংশে তিনি ধান চাষ করেন সারা বছরের খোরাকীর জন্য। বাকি জমিতে সবজি চাষ করেন। ‘বছরভরই কোনো না কোনো সবজি আমি করি যাতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু বিক্রি করা যায়’, বলেন সন্তোষ বিশ্বাস। পড়তি মৌসুমে শ’ তিনেক রঙিন ফুলকপি চাষ করেন সন্তোষ বিশ্বাস। তার ক্ষেতে উৎপাদিত ফুলকপি প্রদর্শিত হয়েছে সরকারের আয়োজিত উদ্ভাবনী মেলা আর কৃষি প্রদর্শনীগুলোতে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে সবজি চাষিরা তার সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেছেন। জানতে চাচ্ছেন, কোথায় পাওয়া যাবে এই ফুলকপির বীজ বা চারা? মুশকিল হচ্ছে, জামালপুরের যে খামারটি থেকে তিনি চারাগুলো এনেছিলেন, তখন তাড়াহুড়োয় তাদের ফোন নম্বর সংগ্রহ করতে পারেননি তিনি। এমনকি খামারটির নামও তার মনে নেই। শুধু জায়গাটা মনে আছে। ঢাকায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে যোগাযোগ করেছিলেন, তারাও খবর দিতে পারেনি তেমন। শুধু বলেছে, এই বীজ ভারতে পাওয়া যায়।
এখন তিনি পরিকল্পনা করছেন সশরীরে জামালপুরের ওই খামারটিতে যাবেন, তথ্য সংগ্রহ করতে এবং সম্ভব হলে তাদের কাছ থেকে বীজ বা চারা সংগ্রহ করবেন। জামালপুরের কৃষি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে খোঁজ পাওয়া গেলো বাংলাদেশ অ্যাগ্রো কম্পোজিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের। জেলা সদরে এক একরের মত জমির উপর এই খামারটির বিশেষত্ব - তারা শুধু সবজির চারা উৎপাদন করে এবং সেটা তারা মাটিতে উৎপাদন করে না। তাদের চারা উৎপাদিত হয় কোকোফিডের মধ্যে।
সন্তোষ বিশ্বাস সম্ভবত এ খামারটি থেকেই রঙিন ফুলকপির চারা এনেছিলেন। কারণ এই খামারটিই গত বছরের শেষের দিকে ভারত থেকে কিছু রঙিন ফুলকপির বীজ এনেছিল পরীক্ষামূলকভাবে। রবি মৌসুমে তারা সেখান থেকে হাজার দুয়েক চারা উৎপাদন করে এবং বেশ সাড়া পায়। এ বছর রবি মৌসুম আসার বেশ আগেই খামারটি এরই মধ্যে কুড়ি হাজার চারার চাহিদা পেয়েছে, বিবিসিকে বলছিলেন বাংলাদেশ এগ্রো কম্পোজিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, তারা এখন ভারতের সাথে যোগাযোগ করছেন বীজের জন্য যাতে চাহিদা মোতাবেক চারা উৎপাদন করা যায়।
'হাই ভ্যালু ক্রপ' সন্তোষ বিশ্বাস এক একটি ফুলকপি বিক্রি করেছেন এক শ’ টাকার উপরে। যেখানে কদিন আগে সাদা ফুলকপি এক একটি তিনি বিক্রি করেছিলেন ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। এ সবজিটিকে একটি 'হাই ভ্যালু ক্রপ' বা উচ্চমূল্যের ফসল হিসেবে চিহ্নিত করে কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এটিকে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে কাজ করবেন।
‘আমার শহরেই যেহেতু সবজিটির চারা হচ্ছে, তাই আমরা আগামী মৌসুমি আমার জেলার কৃষকদের এটি চাষ করতে উদ্বুদ্ধ করবো’, বলছিলেন জামালপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক জাকিয়া সুলতানা। ‘কৃষকদের জন্য এটা করতে সোজা হবে। কারণ তাদের চারা সংগ্রহ করতে দূরের কোনো শহরে যেতে হবে না।’ এসব ফসল 'হাই ভ্যালু' হওয়ায় ‘কৃষকরা যাতে একটু বেশি বাজারমূল্য পায়, সেজন্য এ ধরণের ফসলের কৃষকদের আমরা আমাদের প্রদর্শনীগুলোতে আনার চেষ্টা করি’, বিবিসিকে বলেন জাকিয়া সুলতানা।
শুধু কি রঙেই পার্থক্য? অনলাইনে কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন আন্তর্জাতিক লেখকদের নিবন্ধ ঘেঁটে যেটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে স্বাদের দিক থেকে সাদা ফুলকপির থেকে খুব একটা আলাদা নয় রঙিন ফুলকপি। তবে সন্তোষ বিশ্বাসের খামারে হলুদ বর্ণের ফুলকপি হলেও, এসব নিবন্ধ পড়ে জানা যাচ্ছে এটির রঙ মূলত কমলা। অতিরিক্ত পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন থাকার কারণে এটার এমন রঙ। একই কারণে গাজরের রঙও কমলা হয়।
এই রঙের সবজিতে অন্য রঙের সবজির তুলনায় ২৫ গুণ বেশি ভিটামিন এ উপাদান থাকে। ফলে এগুলো বেশি পুষ্টিকর। বেগুনি ফুলকপি রান্নার পর বিবর্ণ হলেও কমলা ফুলকপি বিবর্ণ হয় না। তবে বেগুনি ফুলকপি সবচেতে স্বাস্থ্যকর। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অ্যান্থোসিয়ানিন্সের উপস্থিতির কারণে এটির রঙ এমন বেগুনি। অন্যান্য কিছু সবজি এবং পণ্যে এমন উপাদান পাওয়া যায়- যেমন বেগুনি রঙের বাঁধাকপি কিংবা রেড ওয়াইন। কমলা ফুলকপির মতো বেগুনি ফুলকপিতেও সাদা ফুলকপির তুলনায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অনেক বেশি থাকে।
বেগুনি ফুলকপি প্রদাহ উপশম, কার্ডিওভাসকুল্যার সমস্যা এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে উপকারী। রান্না করার পর এটির রঙ হালকা সবুজাভ হয়ে যায়। আরেকটি রঙের ফুলকপিও হয়, সেটির রঙ সবুজ। এটিতে ক্লোরোফিলের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। পশ্চিমা দেশে এটি ব্রকলিফ্লাওয়ার নামেও পরিচিত। কারণ ফুলকপি হলেও দেখতে অনেকটা ব্রকলির মত।
কৃষি কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, আমরা যে সাদা ফুলকপি চিনি, তার চেয়ে কিছুটা কম সময় লাগে এই রঙিন ফুলকপি চাষ করতে।
সূত্র : বিবিসি