ক্ষমতার রাজনীতির গতি-প্রকৃতি


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ১২, ২০২৫, ৪:৪০ অপরাহ্ণ /
ক্ষমতার রাজনীতির গতি-প্রকৃতি

প্রতিবেদকঃ

ক্ষমতা শব্দটি একটি গুণ বা অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। আর ক্ষমতা মানে দাঁড়ায়- সক্ষম হওয়ার অবস্থা বা কোনো কিছু করার সামর্থ্য। অন্যদিকে, ইংরেজি Power শব্দটির অর্থ to be able, অর্থাৎ করতে পারা। এটি পুরনো ফরাসি ভাষা হয়ে ইংরেজিতে এসেছে। উৎপত্তিগত দিক থেকে, চড়বিৎ এবং ক্ষমতাÑ দুটিই মূলত সক্ষমতা বা সামর্থ্য বোঝাতে ব্যবহৃত। ক্ষমতা এমন একটি শব্দ, যা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু শব্দটির প্রকৃত অর্থ বোঝার জন্য আমাদের যেতে হয় এর বাস্তব প্রয়োগের দিকে।

রাজনীতিতে ক্ষমতার অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যক্তির বিশ্বাস, আচরণ, কার্যক্রম প্রভাবিত করার সামর্থ। অনেকেই ক্ষমতার অর্থকে শক্তি প্রয়োগের সক্ষমতার দিকে নিয়ে যেতে চান। আসলে ক্ষমতার অর্থ শক্তি প্রয়োগের বিপরীত অর্থও ধারণ করে। ব্যক্তিক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার প্রয়োগকে নিষ্ফল ও নিষ্ক্রীয় করার কলা কৌশলকেও বোঝায়। অবশ্য ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য কাঠামো এবং প্রায়োগিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন। ক্ষমতা বিন্যাসের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক, স্তরক্রম, প্রক্রিয়া ও আইন গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারবাহিকতায় ক্ষমতার সাথে বৈধতা, আইনসম্মততা, যথার্থতা, ন্যায্যতা, সঙ্গততা, প্রামাণিকতা ও আধিকারিকতা সম্পর্কিত। ক্ষমতার প্রতিশব্দ হিসেবে কখনও কখনও ‘কর্তৃত্ব’ ব্যবহৃত হয়। এই কর্তৃত্বের সাথে সামাজিক কাঠামোর অনুমোদন এবং সতত আনুগত্যের প্রশ্নটি জড়িত।

এই তত্ত্ব কথার পর ক্ষমতার ব্যবহারিক দিকটি দেখা যাক। Oxford Dictionary of Politics বলছে, ক্ষমতা হলো, ÔThe ability to make people (or thinks) do what they wouldn’t otherwise have done. রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ক্ষমতা সম্পর্কিত অধ্যয়নের সূচনা ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে। এসময় Hume তার সু-বিখ্যাত গ্রন্থ Of The Original Contract গ্রন্থে ক্ষমতার উৎসমূল ব্যাখ্যা করেন। অবশ্য ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক তত্ত্বের কৃতিত্ব দেয়া হয় Niccolo Machiavelli কে। তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করেন ‘ন্যায় ও বৈধতা বহির্ভূত বিষয়’ হিসাবে। এভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দেখা হয় Might rather than right হিসেবে। রাষ্ট্রনৈতিকতা এবং অনৈতিকতার এই দ্বন্দ্ব বহমান থাকে বেশ কিছু কাল। প্রাচীনে এরিস্টটল ও প্লেটো রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করেন। মধ্যযুগে হবস, লক, রুশো রাষ্ট্রকে সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে বৈধতা দিয়েছেন। আধুনিক যুগে ইমানুয়েল কান্ট নৈতিকতা ও মানবমর্যাদার ভিত্তিতে রাষ্ট্র নির্মাণের কথা বলেছেন। জন স্টুয়ার্ড মিল স্বাধীনতা ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকারের কথা বলে আধুনিক রাজনৈতিক ক্ষমতায় জনপ্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা বিধান করেছেন। রবার্ট ডাল গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে বৈধতা নির্মাণ করেছেন। ডেভিড ইস্টন রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ইনপুট আউটপুট বৈধতা মডেল দিয়েছেন। জার্গেন হ্যাবারমাস নৈতিক আলোচনা ও জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক বৈধতার কথা বলেছেন। এভাবে আবর্তিত বিবর্তিত হয়েছে ক্ষমতার রাজনীতি অথবা রাজনীতির ক্ষমতা।

Bertrand Russel ক্ষমতার সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে The production of intended affects। প্রত্যাশিত প্রভাব হিসাবে বাস্তবভাবেই ক্ষমতাকে তিনি জনগণ আশ্রয়ী করতে চেয়েছেন। এই আশ্রয়ী প্রভাবের ৫ টি উপাদানের কথা ব্যাখ্যা করেছেন একদল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তাদের কথিত এই বিষয়াবলী হচ্ছে ক. শক্তি (Force) খ. সম্মত করানো (Persuasion) গ. কর্তৃপক্ষ (Authority) ঘ. শক্তি প্রয়োগ (Coercion) ঙ. কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ (Manipulation)। শক্তি প্রয়োগের দ্বারা বোঝানো হয়- ব্যক্তি ও সমষ্টির নিয়ন্ত্রণ। এভাবে জনগণকে শক্তির অনুবর্তী করে তোলা হয়। ব্যক্তি ও সমষ্টি পরোক্ষভাবে ক্ষমতার অনুবর্তী না হলে প্রত্যক্ষভাবে শক্তি প্রয়োগ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করা হয়। ক্ষমতার অনুকূলে নাগরিকদের প্ররোচনা, বোঝানো, রাজি করানো ও মন গলানোর মাধ্যমে রাজনীতিকরা নাগরিক সাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করেন। এটি বিপরীত অর্থেও হতে পারে। ক্ষমতাহীনরা ক্ষমতাবানদের তোষামোদ, খোষামোদ ও রাজি করানোর কার্যক্রমের মাধ্যমে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করতে পারেন। কর্তৃপক্ষ মানেই হচ্ছে ক্ষমতার বৈধকরণ।

আইনানুগতা, নিয়মানুবর্তিতা ও গণতান্ত্রিকতার মাধ্যমে ক্ষমতার প্রয়োগকে স্বাভাবিক ও সিদ্ধ করার মাধ্যমে কর্তৃত্বকে প্রায়োগিক করার ব্যবস্থা নেয় রাজনীতিকরা। ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেই কর্তৃত্ব তথা কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি। কর্তৃত্ব ও কর্তৃপক্ষের প্রতি সাধারণ জনগণের সতত আনুগত্য আশা করা হয়। অপরদিকে ক্ষমতা ব্যতিরেকেও কর্তৃত্বের ও আনুগত্যের বাস্তবতা রয়েছে। একজন ধর্মগুরু বা গোত্রপতি আনুগত্যের কারনেই নেতৃত্ব অর্জন করেন। আর শক্তি প্রয়োগ ক্ষমতার রাজনীতির একটি অনন্য অধ্যায়। ভীতি, অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের মাধ্যমে শক্তি প্রয়োগের বাস্তবায়ন ঘটে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, দেশ রক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনী শক্তি প্রয়োগের বাহন হয়ে ওঠে। দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও একই কাজে নিয়োজিত করা হয়। কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ করা হয় দৃশ্যত শক্তির প্রায়োগিক ব্যবহার ব্যতিরেকেই। সম্পদের কর্তৃত্বপূর্ণ বণ্টনের মাধ্যমে এবং নানা ধরনের লোভ-লালসার মাধ্যমে এমনকি চরিত্র হননের মতো নোংরা উপায় ব্যবহার করে হলেও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার বাস্তবতা পরিলক্ষিত হয়। এটা এতটা কুশলতার সাথে করা হয় যে, নাগরিক সাধারণ ভালো-মন্দ না বুঝেই ব্যবহৃত হয়। ধর্মের নামে ও আদর্শের নামে বা চেতনার নামে জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়। ফুকিয়ামার মতো সমাজবিজ্ঞানীরা একে মিথ্যা চেতনা অভিহিত করেছেন।

বস্তুত রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ক্ষমতা। এক বাক্যে বলা যায়, Politics is about power। রাজনীতির সবকিছুই ক্ষমতা নির্ভর। একাডেমিক আলোচনায় এবং গণমাধ্যমের আলাপচারিতায় সবসময় ক্ষমতাকেই রাজনীতির শীর্ষে স্থান দেওয়া হয়। যখনই কোনো অধ্যয়ন ও গবেষনাকর্ম পরিচালিত হয়, দেখা যায়, তা সামাজিক ও রাজনৈতিক বলয় আবর্তিত বিবর্তিত হচ্ছে। ব্যক্তি যখন এরকম ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা অর্জন করে তখন C. Wright Mills এর ভাষায় তারা হয় Power elite অথবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৬ সালে পরিচালিত গবেষনায় মিলস দেখান যে, ক্ষমতা পরিব্যাপ্ত Overlapping cliques দ্বারা। অর্থাৎ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পারিপাশির্^ক শীর্ষ দেশে ঝগড়া-ঝাটি, ব্যক্তিবিদ্বেষ ও কোন্দল একটি অনাকাঙ্খিত অনিবার্যতা। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবার ক্ষমতার পরিমাপক আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। এই পরিমাপক বা মাপকাঠি প্রভাব, প্রতিপত্তি, নেতৃত্ব, নির্বাচন ও সংকট সমাধানের সক্ষমতা দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়।

ক্ষমতার ভাগাভাগি বা অংশীদারিত্ব রাজনৈতিক ক্ষমতা বিশ্লেষণের আরেকটি উপজীব্য বিষয়। আমাদের দেশে অথবা অন্যত্র রাজনৈতিক জোট, আঁতাত বা ফ্রন্ট গঠনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু নির্ণয় করা যায়। সাধারণত নির্বাচনের পূর্বক্ষণে অথবা নির্বাচন পরবর্তী সরকার গঠনের প্রাক্কালে এ ধরনের জোট বা কোয়ালিশনের তৎপরতা লক্ষ করা যায়। এর দ্বারা রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক দলসমূহ ক্ষমতার দর কষাকষি করে থাকে। সাধারণত বাংলাদেশের মতো শতধাবিভক্ত তৃতীয় বিশে^র রাজনৈতিক বলয়ে এর প্রভাব বেশিই পরিলক্ষিত হয়। এসব দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা আদর্শ ও নৈতিকতা নির্ভর নয় অনেকাংশে। বরং পরস্পর বিপরীত অথবা নিপাতনে সিদ্ধ ঘটনায় বা জোটে আকীর্ণ রাজনৈতিক সমাজ। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এজন্য মজা করে বলেন, ‘ভাগাভাগির গণতন্ত্র’। সহমতের ভিত্তিতে ক্ষমতা ভাগাভাগি। শুধুমাত্র দলীয় পর্যায় নয়, তৃতীয় বিশে^র এসব দেশে ভাগাভাগির গণতন্ত্রের শরীক হচ্ছে গোত্র, গোষ্ঠী ও বিভিন্ন স্বার্থবাদী সম্প্রদায়। তবে মজার ব্যাপার এইসব আঁতাত বা জোট যে, নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দেয় এমন নয়। জড়াজড়ি যেমন আছে তেমনি ভাগাভাগিও আছে। যেসব দেশে স্বহৃদয় বর্তমান, সেখানে আপোষ ও সমঝোতার মাধ্যমে অভিন্ন সমাজ গড়ে ওঠে। অপরদিকে অগনতান্ত্রিক, অসহনশীল ব্যক্তিগত বিকারগ্রস্ত নেতৃত্ব দেশ, জাতি, রাষ্ট্রকে বিভক্তি ও বিপর্যয়ের দিকে নিক্ষেপ করে।

ক্ষমতার বিবিধ উৎস সম্পর্কে বিবিধ অধ্যয়ন ও গবেষণা আছে। সাম্প্রতিককালে John R. P. French Ges Bertram Raven একটি সমন্বয়ধর্মী ফর্মুলা বের করেছেন, যার মাধ্যমে জানা যায় ক্ষমতা কীভাবে একটি সমাজে সফল বা ব্যর্থ হয়। উভয়ই মনে করেন ক্ষমতা আর প্রভাব প্রতিপত্তি এক নয়। একটি নির্দিষ্ট বিষয় ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিন্যাস বোঝা যায়। ধরুন ‘ক’ ও ‘খ’ এর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ‘ক’ যদি ‘খ’ কে তার কৌশল প্রক্রিয়া ও পরাক্রম দ্বারা পরাজিত করতে পারে, তাহলে পরে ‘ক’ ক্ষমতাধর বলে চিহ্নিত হবে। এভাবে তারা মনে করেন ক্ষমতা হচ্ছে, মৌলিকভাবে আপেক্ষিক ও তুলনামূলক। এটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও বিষয়ের উপর প্রায়োগিক। কাঙ্খিত ফলাফল পেতে হলে পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগে কাঙ্খিত অনাকাঙ্খিত ফল লাভ হতে পারে। এসব তত্ত্ব কথা নতুন করে ব্যক্ত হয়েছে Gareth Morgan এর ১৯৮৬ সালের প্রকাশিত গ্রন্থ Images of Organization এ। এখানে ক্ষমতার বৈধতা ও অবৈধতার প্রশ্নটি আলোচিত হয়েছে। কৌশল, উত্তরাধিকার, শক্তি প্রয়োগ ও ষড়যন্ত্রের মতো বিষয়াবলীর মাধ্যমে যে ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে তা বৈধ নয়। এরূপ ক্ষমতাকে বলা হয়েছে অর্জিত ক্ষমতা বা ধারণকৃত ক্ষমতা। আর বৈধ ক্ষমতা হচ্ছে যেটি একটি নির্বাচনের মতো প্রথা পদ্ধতিতে সম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

রাজনৈতিক ক্ষমতা বিন্যাসে ব্যক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যক্তিগত গুণাবলীর কারণে আনুগত্য অর্পিত হয়। পারস্পরিক সম্পর্কসমৃদ্ধ ব্যক্তিগত গুণপনার কারণে। আবার কোনো কোনো ব্যক্তি জনগণকে আকৃষ্ট করার অপূর্ব ক্ষমতা ধারণ করেন। তৃতীয় বিশে^ এধরনের ক্ষমতাকে বলা হয় ঈযধৎরংসধঃরপ ষবধফবৎংযরঢ় বা সম্মোহনী নেতৃত্ব। বিশেষ কোনো সংকট ও সময়কে কেন্দ্র করে সম্মোহনী নেতৃত্বের বিকাশ ঘটতে পারে। একজন ব্যক্তির নির্দিষ্ট গুণাবলী- শক্তি, সাহস, সততা, কৌশল, বাগ্মীতা সম্মোহনী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারে। তৃতীয় বিশে^ উপনিবেশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে অথবা উত্তর উপনিবেশিক আমলে এধরনের সম্মোহনী নেতৃত্বের বিকাশ, পালন ও গ্রহণের আধিক্য লক্ষ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের মতো তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়াবলী জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। ঔপনিবেশিক সময় অতিক্রান্ত হলেও তৃতীয় বিশ্বের সমাজে বিশেষ ব্যক্তির আকর্ষণ সবসময় সর্বত্রই লক্ষ করা যায়। এরা হতে পারেন রাজনীতিবিদ, ক্রীড়াবিদ, সাহিত্যিক এবং নায়ক-নায়িকা।

এক্ষেত্রে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে ব্যক্তির জনপ্রিয়তা। নেতিবাচক দিকটি হচ্ছে, এই জনপ্রিয়তাকে নির্ভর করে ক্ষমতা অর্জন। অনেক ক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিরা অযোগ্যতা, অনিয়ম, অন্যায় এবং দুর্নীতির দাতারা আক্রান্ত হয়ে পরে। এর পরিণতিও শুভকর হয় না। বিশেষজ্ঞগণ ক্ষমতার একটি স্বতন্ত্র ধারারও উল্লেখ করেন। এটা হচ্ছে কোনো ব্যক্তির বিশেষায়িত জ্ঞান, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা নির্ভর। এধরনের ক্ষমতা সাধারণত সুনির্দিষ্ট এবং সীমিত। এটা তাদের মেধা, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান দ্বারা বিশেষভাবে গুণান্বিত। তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা তাদেরকে বিশেষ অবস্থায় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষমতা দেয়। তারা যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম। এসব গুণাবলীর বিশেষ কারণে, বিশেষ সময়ে তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। জনগণের সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের পর তার প্রতি আনুগত্য, আস্থা ও সম্মান প্রদর্শন করে। একজন প্রকৌশলী অথবা একজন চিকিৎসক অথবা একজন সেনানায়ক, স্থান কাল পাত্রভেদে জনগণ বা জাতির আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারে।

একটু আগে আমরা বিশেষজ্ঞ ক্ষমতার বিভিন্ন দিক আলোকপাত করেছি। এখন আমরা দেখবো সেবা বা অবদান পরবর্তী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি। এটিকে আমরা সহজভাবে ক্ষমতা তথা অবদান পরবর্তী পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি মানুষের উপকারে বড় ভূমিকা রাখে তাহলে পরে প্রতিদানে তারাও অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ফলে ঐসব ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষে ক্ষমতা অনুশীলন ও চর্চা সহজ হয়ে ওঠে। এর বিস্তৃতি ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, দাপ্তরিক, পদোন্নতি ও অন্যবিধও হতে পারে। সাধারণভাবে এটি স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলে এটি নেতিবাচক ফলদায়কও হতে পারে। এতে ক্ষমতার ঊর্ধ্বগতি না হয়ে অধোগতি হতে পারে।

এ নিবন্ধে আমরা ক্ষমতা তথা ক্ষমতার রাজনীতির গতি-প্রকৃতি ও বিষয়-বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছি। বিজ্ঞানের সূত্র যেমন পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় সেরকম সমাজবিজ্ঞানে অবিকল অনুরূপ না হলেও এর নিজস্ব বিধি ও ব্যাকরণ রয়েছে, যা বিজ্ঞানের প্রায় সমরূপ। নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক Every action has its equal and opposite reaction। তেমনি ক্ষমতার রাজনীতির সূত্র মোতাবেক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ক্ষমতা মহৎ ব্যক্তিকে মহিমান্বিত করে। সার্বিক ক্ষমতা সার্বিকভাবেই দুর্নীতিগ্রস্থ করে তোলে। Lord Acton-এর সেই বিখ্যাত উদ্বৃতিটি সবাই জানেন, Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely. Great men are almost always bad men। মহৎ মানুষেরাও যে ভুল করতে পারে এই উদ্ধৃতিতে তার উল্লেখ আছে। মনীষী প্লেটো রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য দার্শনিক রাজা চেয়েছেন। অবশেষে বিদ্যায় সমর্পিত না হয়ে আইনে সমর্পিত হয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা ক্ষমতার ভারসাম্যের মাধ্যমে উপসংহারে পৌঁছেছেন।