দক্ষিণাঞ্চলের বৃহত্তম স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (খুমেক) প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজারের বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। কিন্তু হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) শয্যা সংখ্যা মাত্র ২০টি। শহরের অন্য দুই সরকারি হাসপাতালে রয়েছে আরও মাত্র ১০টি। সব মিলিয়ে ২৬ লাখ মানুষের জন্য সরকারি পর্যায়ে কার্যকর আইসিইউ শয্যা মাত্র ৩০টি। ফলে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীদের হতে হচ্ছে চরম ভোগান্তির শিকার।
গত ২৮ অক্টোবর বরগুনার বামনা উপজেলা থেকে ছেলের চিকিৎসার জন্য খুমেকে ছুটে এসেছিলেন রোজিনা বেগম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে আব্দুল্লাহ জ্বর ও শ্বাসকষ্টজনিত জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয়। চিকিৎসার একপর্যায়ে চিকিৎসকরা আইসিইউতে নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় তাকে আইসিইউতে ভর্তি করা যায়নি। ২৯ অক্টোবর হাসপাতালের বারান্দায় মারা যান আব্দুল্লাহ।
রোজিনা বেগম বলেন, ডাক্তাররা বলেছেন আইসিইউতে নিতে হবে। অনেক চেষ্টা করেও আইসিইউ খালি পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, আইসিইউতে নেয়ার পরও যদি বাচ্চাটা মারা যেতো, তাও মনকে বুঝ দিতে পারতাম, চেষ্টা করেছি বাঁচে নাই। কিন্তু আমি তো সেটাও পারলাম না।
কাগজে কলমে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৫০০ শয্যার হলেও বাস্তবে প্রতিদিন ভর্তি থাকে ১৫০০-১৭০০ রোগী। হাসপাতালটিতে রয়েছে দুটি আইসিইউ। মোট শয্যা মাত্র ২০টি। খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতালে আছে মাত্র ১০টি আইসিইউ শয্যা। আর খুলনা সদর হাসপাতালে আইসিইউর কোনো সুবিধা নেই।
খুলনার ফুলতলা উপজেলার বাসিন্দা আমেনা খাতুন তার স্বামীকে নিয়ে গত সপ্তাহে হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছেন আইসিইউ বেডের খোঁজে। তার ভাষায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এক হাসপাতাল থেকে আরেকটায় দৌড়েছি। কেউ বলে বেড নাই, কেউ বলে নাম লেখেন, পাওয়া গেলে জানাবো। কিন্তু রোগী কি এত সময় অপেক্ষা করতে পারে?
শয্যা সংকটের কারণে আইসিইউর প্রবেশদ্বার থেকে প্রতিদিন ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে গুরুতর রোগীদের। হাসপাতালের সামনে থাকা ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগেরই অভিযোগ, একটি অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল হয়েও সংকট এত দীর্ঘদিন কেন চলছে?
বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি শেখ আশরাফ উজ জামান বলেন, খুলনা অঞ্চল শুধু খুলনার মানুষের জন্য নয়, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, বরগুনা, পিরোজপুরসহ বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগীরা আসে। অথচ এখানে মাত্র ২০টি আইসিইউ। এটা উন্নয়ন বৈষম্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ থাকলেও সেখানে সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন আর খরচ সাধারণ মানুষের বাইরে। হাসপাতাল ভেদে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ প্রতিদিন। যা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন যেই পরিমাণ রোগী থাকে, সেই হিসেবে অন্তত ৫০ থেকে ৬০টি আইসিইউ বেড জরুরি। ইতোমধ্যে আইসিইউ বাড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দ এবং প্রকল্প অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।
খুলনা বিশেষায়িত হাসপাতালের পরিচালক ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, আমাদের এখানে আইসিইউ বাড়ানোর জায়গা নেই। তবে ৬টি নতুন এইচডিইউ শয্যা যুক্ত করার চেষ্টা চলছে। ১০টি আইসিইউ পর্যাপ্ত নয় এটাও সত্য।
খুলনা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, আইসিইউ বেড সংখ্যা যেমন কম, তেমনি জনবল, মনিটরিং ব্যবস্থাও সীমিত। খুমেকসহ সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের অতিরিক্ত চাপ থাকা সত্ত্বেও সমন্বিত উদ্যোগ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য আইসিইউ শুধু চিকিৎসা নয়, শেষ ভরসা। খুলনা অঞ্চলের মানুষের সেই শেষ ভরসাই আজ চরম সংকটে। অবিলম্বে শয্যা বাড়ানো না হলে প্রতিদিনই এভাবেই হারাতে হবে অসংখ্য ‘আব্দুল্লাহ’-কে।