কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না মহানগরীসহ খুলনার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামলেই ঘটছে মারামারি, গুলি, ছুরিকাঘাত, ছিনতাই ও হত্যাসহ নানা অঘটন। এতে করে রাজনীতিক, সাধারণ মানুষ আতংকে ভুগছেন। সর্বশেষ ৯ মাসে খুলনায় হত্যার ঘটনাই ঘটেছে ৭৭টি। আর এরমধ্যে নদী থেকে ও পরিত্যক্ত অবস্থায় অর্ধশতাধিক মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, মাদক, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি ও নারী ঘটিত কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন।
সাধারণ মানুষ ও নাগরিক নেতারা বলেছেন, ছিনতাই, মারামারি, কোপাকুপি, ছুরিকাঘাত এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। দীর্ঘ প্রায় দেড়যুগেরও পর আাবারো খুলনায় আবির্ভুত হলো সেই গুপ্ত বাহিনীর রগকাটার ঘটনা। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভাবে আতংকিত হয়ে পড়েছেন।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে জানুয়ারিতে সদর থানা এলাকায় একজন ও সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, ফেব্রুয়ারিতে সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, মার্চ মাসে সদর থানা এলাকায় একজন, এপ্রিল মাসে সদর থানা এলাকায় একজন ও আড়ংঘাটা থানা এলাকায় একজন, মে মাসে সদর থানা এলাকায় একজন, সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, লবনচরা থানা এলাকায় দুইজন ও হরিণটানা থানা এলাকায় একজন খুন হয়, জুন মাসে সোনাডাঙ্গা এলাকায় একজন ও হরিণটানা থানা এলাকায় খুন হয়েছে দুইজন, সদর থানায় একজন ও দৌলতপুর থানায় একজন, আগষ্ট মাসে সোনাডাঙ্গা থানায় তিনজন, লবনচরা থানায় একজন ও দৌলতপুর থানায় একজন, সেপ্টেম্বর মাসে হরিনটানা থানায় একজন ও ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত দৌলতপুর থানায় একজন ও খালিশপুর থানায় একজনকে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ।
তবে এটা শুধুমাত্র খুলনা মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের হিসাবে এই ২৩ টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। নগরীর ২৩ হতাকান্ডের মধ্যে ১৭ টির রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।এখনো ৬ টি হত্যাকাণ্ডের কোন রহস্য বা কারন উদঘাটন করতে পরেনি কেএমপি পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে গুলি করে, ধারালো অস্ত্রের দ্বারা ১২ টি হত্যাকান্ড ঘটেছে, শ্বাসরোধ করে তিনটি, থাপ্পড়ের আঘাতে একটি এবং অগাত কারনে চার জনকে হতা করা হয়েছে বলে কেএমপি পুলিশের দাবি।
এ ছাড়াও খুলনার একাধিক স্থানে অনেক অজ্ঞাত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। হত্যাকান্ড ছাড়াও গত নয় মাসে ঘটেছে অসংখ্য ছিনতাই, মারামারি, কোপাকুপি ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। সমগ্র খুলনা জুড়ে এখন মাদকে ভাসছে।
খুলনাবাসীদের অভিযোগ, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর খুলনায় খুনের ঘটনা বেড়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে খুলনায় হত্যাকান্ড শুরু হয়, যা চলতি বছরের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত এখনো চলমান রয়েছে। কোন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারাই প্রতিরোধ করতে পারছেনা।
খুলনার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের একাধিক নেতৃবৃন্দ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলার এতোটায় অবনতি ঘটেছে যা এখন প্রকাশ্য দিবালোকে উদিয়মান সাহসী তরুন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকেও তার নিজ বাড়ির সামনে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে। মহানগরীতে সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হতে সাহস পাওয়া যায়না। আর এখন আবার শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে খুনের ঘটনা। সব মিলিয়ে খুলনায় আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রাজনৈতিক ও নাগরিক নেতা জানান, কিছু কিছু সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশেও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, নগরীতে দিন দিন সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী লীগের পলাতক শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে মেট্রো এলাকার মধ্যেই মিছিল-মিটিং হতে দেখা গেছে। মিছিলের পর নামে মাত্র আওয়ামী লীগের রুট লেবেলের সমর্থকদের ধরলেও নির্দেশদাতারা থেকে যাচ্ছে অন্তরালে।
নাগরিকনেতা অড বাবুল হাওলাদার ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেন, খুলনার মানুষ সব সময়ই শান্তি প্রিয়। তাই খুলনাবাসী চায় শান্তিতে জীবনযাপন করতে। কিন্তু গত নয় মাস যাবত আবারো খুলনার সেই শান্তি বিনষ্ট হয়েছে এবং হচ্ছে। খুলনার পুলিশ প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিনিয়ত খুলনার কোন না কোন জায়গায় খুনের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা নামলেই বা রাতে খুলনাবাসীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করে। এখন আবার শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যাকান্ড। এর আগে সবগুলো অপরাধ কর্মকান্ডই ঘটছে রাতে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা খুলনাবাসীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
কমিশনারের বক্তব্য: এ দিকে সার্বিক বিষয়ে খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, বেশির ভাগ হত্যাকান্ডের ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে। অনেককে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে।
জেলা পুলিশের এ এস পি আনিসুজ্জামান জানান, চলতি বছরের গত নয় মাসে ৫৪ টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে প্রায় সবগুলোই উদঘাটন করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার আসামী গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেন।
কেএমপির মিডিয়া সেলের সহকারী কমিশনার খন্দকার হোসেন আহম্মদ বলেন, নগরীর আট থানার পুলিশ কর্মকর্তারা এখন তাদের মনোবল দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে। তাদেরকে স্হানীয়রা সহযোগিতা করলে খুলনার আইনশৃঙ্খলা আরো ভালো হবে বলে দাবি করেন।