গুমের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত র‍্যাবের গোয়েন্দারা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুন ১৪, ২০২৫, ১১:২৫ পূর্বাহ্ণ /
গুমের সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত র‍্যাবের গোয়েন্দারা
  • আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশে সংগঠিত গুমের ঘটনায় পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি (গোয়েন্দা পুলিশ) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর মতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সরাসরি জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। গুম-সংক্রান্ত ‘কমিশন অব ইনকোয়ারির দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হওয়া ৩৪৫ জন ব্যক্তির এখনও খোঁজ মেলেনি, র‌্যাবের গোপন বন্দীশালায় রাখা হয় ব্যারিস্টার আরমানেক, ভারতীয় গোয়েন্দাদের সম্পৃক্ততার তথ্য মিলছে তদন্তে-

আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশে সংগঠিত গুমের ঘটনায় পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি (গোয়েন্দা পুলিশ) এবং কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর মতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সরাসরি জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। গুম-সংক্রান্ত ‘কমিশন অব ইনকোয়ারির দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৭ শতাংশ গুমের ঘটনায় এই সংস্থাগুলো জড়িত ছিল। এমনকি, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং আদালতের সহযোগীর ভূমিকার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিখোঁজ হওয়া তিন শতাধিক মানুষকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমি মিলনায়তনে এক বিফ্রিংয়ে এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, গুমের সাথে যারা জড়িত তাদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতে হবে। সবাইকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। তিনি বলেন, যারা গুম হয়েছেন, তাদের ব্যাপারে আশু করণীয় বিষয় কী কী, তা জানতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘র‌্যাবের গোয়েন্দা সংস্থা সবচেয়ে বেশি গুমের সাথে জড়িত। র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স ভয়াবহ কিলার ও হত্যাকারী দল ছিল বলে জানিয়েছে গুম কমিশন। র‌্যাবের সদস্যরা পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য গুম ও খুনের সাথে জড়াত।’ তিনি আরো বলেন, ‘গুমের নির্যাতনের ভয়াবহতা নিয়ে জাদুঘর নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। গণভবনে র‌্যাবের নির্যাতন ও গুমের ঘটনা নিয়ে হরর মিউজিয়াম হবে।’

প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে, যদিও গোয়েন্দা শাখার পরিচালক ৫ আগস্ট পরিবর্তনের আগ থেকে ১৬ অক্টোবর ২০২৪ পর্যন্ত আমাদের সফরের মাধ্যমে তার পদে বহাল ছিলেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এডিজিকে (অপারেশনস) স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও নতুন এডিজির (অপারেশনস) অধীনেও প্রমাণ ধ্বংস অব্যাহত ছিল। পরবর্তীকালে গোয়েন্দা শাখার পরিচালককে একজন ভারপ্রাপ্ত পরিচালক দ্বারা স্থলাভিষিক্ত করা হলেও তথ্যে প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত ছিল। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের এপ্রিলে র‌্যাব গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত কর্মীদের তালিকার মতো কিছু মৌলিক তথ্যের জন্য পাঠানো চিঠিগুলো ২০২৫ সালের মে মাসের শেষ নাগাদও যথাযথ প্রতিক্রিয়া পায়নি। গুম কমিশন বলছে, র‌্যাব ইন্টেলিজেন্স উইং গত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আরেকটি গোপন আটক স্থান পরিচালনা করত। এ সুবিধাটি র‌্যাব সদর দফতর প্রাঙ্গণের মধ্যেই অবস্থিত ছিল। কথ্য ভাষায় এটিকে ‘ক্লিনিক’ বলা হতো। এটি একটি কাঠামোর মধ্যে অবস্থিত ছিল; যা অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘কাচের ঘর’ নামে পরিচিত ছিল। কারণ এর বাইরের অংশ কাচের প্যানেলযুক্ত ছিল।

  • গুমের সাথে র‌্যাবের গোয়েন্দারা সবচেয়ে বেশি জড়িত, ভিতরে তিনতলায় একসময় প্রায় ছয়টি ছোট আটক কক্ষ ছিল বলে জানা গেছে।

প্রতিবেদনের মূল তথ্য: কমিশন মোট ১ হাজার ৮৩৭টি গুমের অভিযোগ পেয়েছে, যার মধ্যে ১ হাজার ৭৭২টি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৪২৭ জন ভুক্তভোগী ফিরে এলেও ৩৪৫ জন ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি ও সিটিটিসি ৬৭ শতাংশ গুমের ঘটনায় জড়িত। এছাড়াও ডিজিএফআই, এনএসআই এবং বিজিবির মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোরও গুমে সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

হাতের দুইটা বৃদ্ধাঙুলে নখও নাই: নিখোঁজের দুই বছর পর সন্তানের সন্ধান পেয়ে থানায় ছুটে গেলেন হতভাগা বাবা। থানার হাজতে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণ শীর্ণ ও রোগাক্রান্ত এক যুবক। হাজতের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা। প্রিয় বাবাকে দেখে বহু কষ্টে কিছুটা হাসি দিলেন। আদরের সন্তানকে দেখে বাবা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঁদতে পারছিলেন না। এক পলকে সন্তানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করলেন বাবা। কিন্তু এ কি অবস্থা! আদরের সন্তানের শরীরে শুধু নির্যাতনের চিহ্ন? আরেকটু কাছে গিয়ে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় জিজ্ঞেস করলেন, তোর নখগুলো কই গেল? হাত দেখা তো, পা দেখা। তোর দুই পায়ের নখ নাই। হাতের বৃদ্ধাঙুলে দুইটা নখও নাই। আগেতো এমন আছিল না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে বাবার কাছ থেকে সন্তানকে তুলে নেয়া এক ভুক্তভোগীর ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে গুমের শিকার ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। এমনই এক গুমের শিকার ভুক্তভোগীর বাবা নিখোঁজের দুই বছর পর সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। তিনি ও তার সন্তান গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের কাছে বর্ণনা করেছেন সেই ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। জানান, দুই বছর আগে তার ছেলেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন স্থানে ধরনা দিয়েও সন্তানের খোঁজ পাননি। এরই মধ্যে ছেলের শোকে তার স্ত্রীও মারা যান। হঠাৎ করেই তাকে একদিন কে বা কারা ফোন করে থানায় যেতে বলেন। ফোন পেয়ে তিনি থানায় ছুটে যান।

তদন্ত কমিশনকে তিনি বলেন, দুই বছর দুই মাস পর সন্তানকে থানা হাজতে দেখতে পান। এ সময় সন্তানের এমন অবস্থা দেখে নানা প্রশ্ন করেন। কিন্তু ছেলে কোনো জবাব দেয় না। শুধু হাসে। তিনি বলেন, এ সময় দেখি ছেলের হাত ও পায়ের নখ নাই। তিনি ডিউটিরত পুলিশের কাছে গিয়ে জানতে চান, আমার ছেলেকে কোথা থেকে এনেছেন। পুলিশ জানায়, সে র‌্যাব হেফাজতে ছিল। সেখান থেকে থানায় পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। পুলিশ তাকে বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ দিয়ে উকিলের সাথে যোগাযোগ করতে বলে। এক নজর চোখে দেখলেও ছেলেকে ছাড়িয়ে নিতে কোর্টের বারান্দায় ঘুরতে হয়েছে তাকে বহুদিন। কখনো কাশিমপুর কারাগার, আবার কখনো কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছেলেকে দেখতে ছুটে গেছেন। বহুকষ্টে ছেলেকে ফিরে পেয়েছেন তিনি। কিন্তু অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার ছেলে এখন অসুস্থ। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে সে। গুমের শিকার ভুক্তভোগী ছেলে কমিশনকে সেই নির্যাতনের বর্ণনা করে জানিয়েছেন, তাকে একটি অন্ধকার স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। চোখ বেঁধে প্রতিদিন লাঠি দিয়ে পেটাতো। শরীরে যন্ত্রণায় কাতর হলেও কান্নাকাটি এবং কোনো কথা বলতে দিতো না। শুধু দিন আর রাতের কথা বলা হতো তাকে। মাঝে মাঝে চেক করা হতো অসুস্থ হয়েছি কি না।

র‌্যাবের গোপন বন্দীশালায় রাখা হয় ব্যারিস্টার আরমানকে: প্রতিবেদনে র‌্যাবের গোপন বন্দিশালার অস্তিত্ব এবং সেখানে বন্দিদের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার বন্দিশালাগুলো ছিল অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত। ব্যারিস্টার মীর আরমানের মতো অনেককে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে আটকে রাখা হয়েছে। কমিশনের তলবে র‌্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গোপন বন্দিশালা সম্পর্কে কিছুই জানেন না বলে দাবি করলেও, পরিদর্শনে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। জরাজীর্ণ, ভেঙে পড়া অবকাঠামো এবং পুরো এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি অবহেলার চেহারার ভবনটি ছিল গুম করে রাখার সেই আয়নাঘর ব্যারিস্টার মীর আরমানকে যে ঘরে রাখা হয়েছিল। সেটির নিচের মেঝেটি টাইলস দিয়ে ঢাকা এবং ঠাণ্ডা ছিল। তাকে সেখানে হাঁটার অনুমতি দেয়ার ঘটনাগুলো একটি স্পর্শকাতর স্মৃতি। আর গুম কমিশনের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় মেঝেটি ছিল একটি মোটা, অসম সিমেন্টের সø্যাব, স্পষ্টতই অসম্পূর্ণ। মনে হয় দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। কমিশনের দেয়া প্রতিবেদনে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমানকে আয়নাঘরে আটক রাখার বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রতিটি আটক সুবিধার নিজস্ব অপারেশনাল স্বাক্ষর ছিল একটি স্বতন্ত্র প্যাটার্ন। এর মধ্যে ছিল সেখানকার রক্ষীদের আচরণ, বাথরুমের সময়সূচি, পরিবেশিত খাবারের ধরন, পরিবেশের শব্দ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল ইঙ্গিত। ব্যারিস্টার আরমানের বিবরণেও কমিশন তার সাথে সামঞ্জস্যতা পেয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যারিস্টার মীর আরমানকে আসলে টিএফআই সেন্টারে রাখা হয়েছিল, যা র‌্যাব এক কম্পাউন্ডের মধ্যে অবস্থিত। কিন্তু র‌্যাব সদর দফতর দ্বারা পরিচালিত। আমরা প্রথম ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর টিএফআই পরিদর্শন করি। সেই সময়, কর্মকর্তারা আমাদের জানান যে স্থানটি কমপক্ষে দুই বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। পরিদর্শনের পর, এটি যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়েছিল। সুবিধাটি জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল, এর অবকাঠামো ভেঙে পড়েছিল এবং পুরো এলাকাটি দীর্ঘমেয়াদি অবহেলার চেহারা পেয়েছিল। গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, টিএফআই সাইটটি তিনটি স্বতন্ত্র বিভাগে বিভক্ত ছিল। একটি প্রশাসনিক এলাকা। বন্দীদের রাখার জন্য ব্যবহৃত একটি বৃহত্তর স্থান এবং জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতন কক্ষসহ একটি ছোট অঞ্চল। ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনা নির্যাতন বিভাগের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে নির্যাতন শাখার মধ্যে একটি ছোট এলাকা দীর্ঘমেয়াদি আটক ব্যক্তিদের রাখার জন্যও ব্যবহৃত হতো। গুম কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিদর্শনের সময়, মেঝের কিছু অংশে বর্গাকার চিহ্ন- গ্রিডের মতো ছাপ লক্ষ করেছি। যা টাইলিংয়ের অবশিষ্টাংশের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এর ফলে জুলাই এবং আগস্ট মাসে সুবিধাটিতে কর্মরত কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের সাক্ষাৎকারের সময় আমরা হারিয়ে যাওয়া টাইলস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করি। এই সময়ে আমরা ব্যারিস্টার আরমানকে তার চলাচলের পথের একটি মানচিত্র আঁকতে বলেছিলাম। যদিও তার বেশির ভাগ বন্দিদশায় চোখ বেঁধে রাখা হতো। অন্যান্য অনেক বন্দীর মতো তিনি তার অবস্থানের ধারণা ধরে রেখেছিলেন। তিনি কি ঘুরেছিলেন, সিঁড়ি বেয়ে নেমেছিলেন, নাকি সোজা হেঁটেছিলেন। তার ছবিতে, তিনি সিঁড়ি দিয়ে একটি ছোট ফ্ল্যাটে ওঠার বর্ণনা দিয়েছেন। তারপর সোজা হাঁটার পরে তার সেলে পৌঁছানোর জন্য একটি বাম মোড় নিয়েছিলেন। যখন আমরা নিজেরাই পথটি ট্র্যাক করেছিলাম, তখন এই পথটি বিদ্যমান বিন্যাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। আরমান যে সেলের বর্ণনা করেছেন সেখানে পৌঁছানোর জন্য, একজনকে ডানে, তারপর বামে, তারপর আবার বামে ঘুরতে হবে। এই অমিল আরো সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। তারপর ব্যারিস্টার আরমান তাকে পাঠানো একটি ছবিতে সূক্ষ্ম কিছু লক্ষ করলেন। দেয়ালের একটি অংশ থেকে আলো যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল তা বাকি অংশের থেকে কিছুটা আলাদা ছিল। তিনি পরামর্শ দিলেন যে এখানেই হয়তো তার ঘরের দরজা একসময় ছিল। এটি সিল করে দেয়া থাকতে পারে। এই পর্যবেক্ষণ তদন্তের গতিপথ বদলে দেয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কমিশনের প্রতিবেদন বলছে, ব্যারিস্টার আরমানের অন্তর্দৃষ্টির উপর ভিত্তি করে, আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আমাদের সহকর্মীদের সাথে যোগাযোগ করেছি। যারা ধারাবাহিকভাবে সমর্থন করে আসছেন। আমরা স্থানটির একটি চিত্র শেয়ার করেছি। তাদের দেয়ালের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক পরিমাপের তুলনা করতে বলেছি। আমাদের অনুমানটি সহজ ছিল। যদি সাত ফুটের বেশি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য থাকে- তবে এটি একটি মিথ্যা দেয়ালের পেছনে একটি গোপন কক্ষের উপস্থিতি নির্দেশ করতে পারে। আইসিটি সহকর্মীরা পরিমাপটি সম্পাদন করেন। ১০ ফুটেরও বেশি একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য খুঁজে পান তারা। যা আমাদের সন্দেহকে নিশ্চিত করে। পরে দেয়ালটি ভেঙে ফেলা হয়। কমিশন বলছে, এর পেছনে আমরা একটি গোপন কক্ষ আবিষ্কার করি। প্রায় অক্ষত। যা ব্যারিস্টার আরমানের বর্ণনার সাথে প্রতিটি বিবরণের সাথে মিলে যায়। এটি অন্যান্য বিভিন্ন প্রমাণসহ, নিশ্চিত করে যে তিনি তার আট বছরের বেশির ভাগ সময় সেই স্থানে বন্দী অবস্থায় কাটিয়েছেন।

আর এটা স্পষ্ট ছিল যে ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ব্যারিস্টার আরমানের মুক্তির পর ঘরটি সিল করে দেয়া হয়েছিল। আর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা যখন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি, তখন কক্ষটি সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টির আড়ালে ছিল। গোপন করার ঘটনাটি আগস্ট এবং অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে পরিদর্শন টিমের সফরের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে থাকতে পারে। হাসিনা সরকারের পতনের পরেও জবাবদিহিতা বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত প্রমাণ ধ্বংসের এটি একটি স্পষ্ট উদাহরণ। গুম কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলছেন, ব্যারিস্টার আরমানের মতো মামলা, যেখানে ভুক্তভোগীরা ফিরে এসেছিলেন এবং শক্তিশালী প্রমাণ বিদ্যমান ছিল। তাই অপরাধীদের জবাবদিহি করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা বিন্দু প্রদান করে। তার নিখোঁজের জন্য দায়ী একই কর্মকর্তাদের অনেকেই একই সময়ে টিএফআই সেলের দায়িত্বে ছিলেন। যখন অন্যান্য ভুক্তভোগীর র‍্যাবের গোয়েন্দা শাখা অপহরণ করেছিল এবং আর কখনো তাদের দেখা যায়নি। বলা হয়েছে, এটি প্রমাণ করে যে ন্যায়বিচার সম্ভব এবং যারা কমান্ডে আছেন তারা নাগালের বাইরে নন।

শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা: প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এক র‍্যাব কর্মকর্তার অবৈধ আদেশ অমান্য করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তল্লাশির সময় গণভবনে দুটি র‌্যাব কর্মকর্তার নথি পাওয়ার ঘটনা এর প্রমাণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। জেনারেল (অব.) আকবর কমিশনকে জানিয়েছেন যে, তিনি হুম্মাম কাদের চৌধুরীর গুমের বিষয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করেছিলেন।

ডিবির ভূমিকা: পুলিশের ইউনিটগুলোর মধ্যে ডিবি বিরোধী দলের নেতাকর্মী, অ্যাক্টিভিস্ট এবং সন্দেহভাজন অপরাধীদের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখতো। নির্বাচন ও আন্দোলনের সময় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ে ডিবির তৎপরতা বাড়তো।

ভারতীয় ও বিদেশী সম্পৃক্ততা: গুমে ভারতীয় সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে কমিশন। কিছু ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে অথবা নির্যাতনের সময় হিন্দিভাষী ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। এমনকি আমেরিকান এবং ইংরেজিভাষী ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যও উঠে এসেছে।

নির্যাতনের পদ্ধতি: প্রতিবেদনে অর্ধশতাধিক ভুক্তভোগীর নির্যাতনের বর্ণনা এবং তাদের ক্ষতবিক্ষত দেহের ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে। ঝুলিয়ে পেটানো, হাত-পা বেঁধে মারধর, নখ তুলে ফেলা এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার মতো নির্মম পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলা বা রেললাইনে ফেলে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনাও পাওয়া গেছে।

গোয়েন্দা সংস্থার জড়িত হওয়া: ডিজিএফআইর ‘আয়নাঘর’ নামক কুখ্যাত গোপন বন্দিশালার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবদুল্লাহিল আমান আযমী, রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান, কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমানসহ শতাধিক ব্যক্তি বন্দি ছিলেন এবং তাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো। প্রতিবেদনে আদালতকে ‘সহযোগীর ভূমিকায়’ থাকার কথা বলা হয়েছে। দীর্ঘ সময় গুম করে রাখার পর আদালতে সোপর্দ করার সময় ভুক্তভোগীদের ভয় দেখানো হতো, যাতে তারা মিথ্যা জবানবন্দি দেন। অনেক ক্ষেত্রে বিচারকরাও পুলিশের পক্ষে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কমিশন বলছে, পুরো বিচার ব্যবস্থায় গুমের প্রভাব পড়েছে।

ভুক্তভোগীদের পরিচয়: ২৫৩টি ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া গেছে, যা ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের ৩৬ জেলায় ঘটেছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫১টি ঘটনা ২০১৭ সালে ঘটে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ১০ জন শিশু ছিল। ২২৮ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে, যাদের ৬৬ জন ছিলেন শিক্ষার্থী। ভুক্তভোগীদের এক দিন থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত গুম করে রাখা হয়েছিল। গুম হওয়া ১০১ জনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা রয়েছে, যার মধ্যে ৩৭ জন বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের, ৩১ জন ইসলামী ছাত্রশিবিরের এবং ২৫ জন জামায়াতের কর্মী ছিলেন। দুজন আওয়ামী লীগেরও সদস্য ছিলেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তথ্য দিতে গড়িমসি করেছে। এমনকি ৫ আগস্টের পর কিছু থানা পুড়িয়ে দেওয়ার অজুহাতে নথি পোড়ার দাবি করা হয়েছে, যা কমিশন সন্দেহজনক বলে মনে করে। ভয়ের পরিবেশের কারণে অনেক ভুক্তভোগী এখনও মুখ খুলতে ভয় পান।